ফুটবলের মাঠে বিপ্লবীর হানা

পিনাকী রঞ্জন পাল

আজ থেকে প্রায় ৭৩ বছর আগের কথা। ১৯৩৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর মেদিনীপুরের বিপ্লবীরা খেলার মাঠেই হত্যা করেছিল জেলার ম্যাজিস্টেট বি ই জে বার্জ সাহেবকে। আর এই ঘটনার নায়ক হলেন সেদিনকার মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র অনাথবন্ধু পাঁজা।

এর আগে মেদিনীপুরের দুজন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বিপ্লবীদের হাতে নিহত হন। তাই বার্জ সাহেব নিজের বাংলো থেকে বার হতেন না। অন্যদিকে ম্যাজিস্ট্রেটের নিরাপত্তা বলয় আগের চাইতে অনেক কঠোর করা হয়েছে। ইংরেজ সৈনিক সবসময় সতর্ক। তারা নজর রাখছে সব ছেলেমেয়েদের ওপর। একটু সন্দেহ হলেই চলছে ধরপাকড়, অমানুষিক অত্যাচার, জেল-দ্বীপান্তর আর ফাঁসি। বিপ্লবীদের তবুও দমানো যায়নি। তারাও গোপনে নানারকম পরিকল্পনা করছে। সুযোগ পেলেই অত্যাচারের বদলা নেওয়া হচ্ছে।

বার্জ সাহেব ছিলেন ভালো ফুটবল খেলোয়াড় এবং তিনি শহরের টাউন ক্লাবের সভাপতিও ছিলেন। ফুটবল মরশুম শেষ হয়ে গেলে তাঁকে আর বাইরে নাও পাওয়া যেতে পারে। এই ভেবেই বিপ্লবীরা তাঁকে ফুটবল মাঠেই শেষ করার পরিকল্পনা নেয়। সিদ্ধান্ত হয় টাউন ক্লাবের সঙ্গে মহামেডান ক্লাবের ফুটবল খেলার দিন মাঠেই বার্জ সাহেবকে খতম করতে হবে, আর এই কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয় অনাথবন্ধু পাঁজা এবং মৃগেন্দ্রনাথ দত্তের ওপরে। সপ্তম শ্রেণির ছাত্র অনাথের বাড়ি ছিল সবং থানার জলবিন্দু গ্রামে। আর কলেজের সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র মৃগেনের বাড়ি ছিল মেদিনীপুর শহরেই।

খেলা শুরু হবার কিছুক্ষণ আগে অনাথ আর মৃগেন মাঠে আসে। তাদের দুজনের কাছে আছে দুটি গুলি ভরা রিভলবার। সারা মাঠে ছড়িয়ে আছে বড়ো বড়ো পুলিশ অফিসার। অনাথ আর মৃগেন খেলোয়াড়দের সঙ্গে অনুশীলন করছে। যেমন খেলার আগে সব খেলোয়াড়রা করে। কিছুক্ষণ পরে বার্জ সাহেবের গাড়ি মাঠে ঢুকল। দক্ষিণদিকের গোলপোস্টের কাছে পৌঁছে সাহেব গাড়ি থেকে নামলেন। খেলার জন্য একেবারে তৈরি হয়ে এসেছেন বার্জ সাহেব। খেলা শুরু হতে সামান্য সময় বাকি।

মৃগেন অনুশীলন করতে করতে বলটা খুব জোরে সাহেবের দিকে কিক করল। ভাবখানা এমন যেন ভালো খেলোয়াড়কে সে বল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে। অনাথ তিরবেগে ছুটল বলটা ধরতে। কিন্তু তার আসল উদ্দেশ্য তো আর বল ধরা নয়, সে সাহেবের কাছাকাছি যেতে চায়। দৌড়ে চলে এল বার্জ সাহেবের কাছে। এসেই বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে রিভলবার সাহেবের দিকে তাক করেই গুলি। উত্তেজনায় প্রথম গুলিটা সাহেবের গায়ে লাগল না। প্রাণভয়ে সাহেব থরথর করে কাঁপছে। ওদিকে অনাথ আজ মরিয়া। তাকে আজ যে কোনো উপায়ে সাহেবকে মারতেই হবে। নিমেষে ধাক্কা দিয়ে নীচে ফেলে অনাথ চেপে বসল সাহেবের বুকের ওপর। তারপর রিভলবারের বাকি সবটা গুলি গেঁথে দিল বার্জ সাহেবের বুকে।

মাঠে উপস্থিত সকলের কিছু বোঝার আগেই ঘটে গেল এতবড়ো ঘটনা। তারপর ? হঠাৎ পুলিশবাহিনীর হুঁশ হল। তারাও গুলি চালাল। পুলিশের গুলিতে বার্জ সাহেবের বুকের ওপরেই লুটিয়ে পড়ল অসম সাহসী কিশোর বিপ্লবী অনাথবন্ধু পাঁজা। পালাতে গিয়ে মৃগেন ধরা পড়ল পুলিশ সুপার মিঃ নটন জোন্স এর হাতে। সেও আহত হয়েছিল। পুলিশের অমানুষিক অত্যাচারে সেই রাতেই মারা গেল মৃগেন্দ্রনাথ দত্ত।

Photo Credit- google.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *