লেখক পঙ্কজ সেন
ভারতের স্বাধীনতার তিন বছর পরেই ১৯৫০ সালে জলপাইগুড়ি শহরের প্রাণকেন্দ্র ডিবিসি রোডে গড়ে উঠেছিল একসময়ের প্রখ্যাত সিনেমা হল “রুপশ্রী” (উত্তরবঙ্গের মধ্যে সর্বপ্রথম ডলবি ডিজিটাল সিনেমা হল)।যা গড়ে তোলেন নগেন গাঙ্গুলী এবং পরবর্তীতে সম্ভবত এর মালিকানা হাতবদল হয়ে শহরের বিখ্যাত দাগা (রামানন্দ দাগা) পরিবারের হাতে যায়। এই হলের সর্বপ্রথম প্রদর্শিত ছবি হল বাংলা সিনেমা “বিদ্যাসাগর”। জলপাইগুড়ির সেনপাড়ার বাসিন্দা স্বর্গীয়া বেলা রানী পাল চৌধুরী “রূপশ্রী” নামটি দিয়ে হলের অনুষ্ঠিত লটারি প্রতিযোগিতায় ১০০ টাকা পুরস্কার জিতেছিলেন। এক সময়ে সদ্য
কলেজ পড়ুয়া প্রেমিক-প্রেমিকাদের মধ্যে দেখা করার অন্যতম ক্ষেত্র ছিল শহরের এই সিনেমা হলগুলি। নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত হিন্দি এবং বাংলা সিনেমার স্বর্ণযুগে এই হলগুলোতে দর্শকের ভিড় সামলাতে অনেক সময় পুলিশের সাহায্য পর্যন্ত নিতে হতো, আর সেই সময়ে টিকিট ব্ল্যাকারদের সাথে দর্শকদের হাতাহাতি ছিল নিত্যদিনের ঘটনা।যেমন শোলে(১৯৭৫), কুরবানী (১৯৮০), গুরুদক্ষিণা (১৯৮৮), নাগিনা (১৯৮৯), অমর সঙ্গী (১৯৮৯) ইত্যাদি সুপার ডুপার হিট সিনেমার শো চলাকালীন সময়ে মাঝেমধ্যেই পুলিশের সাহায্য নিতে হতো ভিড় সামলাতে।হঠাৎ করে অল্প সময়ের জন্য বিদ্যুৎ চলে গেলে সারা হলজুড়ে দর্শকের তীব্র চিৎকার ও সিটি… এই পরিবেশ আর হয়তো কোনোদিনও ফিরে আসবেনা। শোনা যায়, ঋষি কাপুর-জয়াপ্রদা অভিনীত “সরগম” ছবিতে “ডফলি বালে” গানটিতে দর্শকরা আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে দর্শকাসনে বসেই পর্দায় টাকা-পয়সার ছুড়ছিলেন। আবার ঋষি কাপুর-ডিম্পল অভিনীত “ববি” ছবির টিকিট হলে আসার তিনদিন আগেই অগ্রিম বিক্রি হয়ে যায়।। ১৯৭৩ সালে রাজেশ খান্না-ডিম্পলের বিবাহের দিন রূপশ্রীর কর্তৃপক্ষ হলে উপস্থিত সকল দর্শককে কোকাকোলা খাওয়ান। এ ছাড়াও এই সময়ে প্রতিদিন ৩টি শোতেই ১রিল করে এই বিবাহের অনুষ্ঠান দেখানো হয়েছিল।

এমনও সময় গিয়েছে শহরের দুটি হলে একসঙ্গে একই সিনেমা চলছে, যেমন : মেয়নে পেয়ার কিয়া, রাম তেরি গঙ্গা মইলি, কহনা পেয়ার হেয়, সাথী ইত্যাদি। মিঠু মুখার্জি অভিনীত বিখ্যাত বাংলা ছবি “আশ্রিতা”র পোস্টারটি দীর্ঘদিন ধরে হলের ভেতর ব্যালকনিতে ওঠার দুইদিকের সিঁড়িতে লাগানো ছিল। রূপশ্রীর এক অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, এর পাশেই অবস্থিত ছিল নিরালা হোটেল আর আপ্যায়ন। হলে প্রবেশের সিঁড়িতে কলেজ পড়ুয়াদের আড্ডা মারার সেই স্মৃতি আজও অনেককে ব্যাথাতুর করে তোলে। নয়ের দশকের শেষভাগে জুড়ে রূপশ্রী সহ শহরের অন্যান্য হলগুলোতে জনসমাগম থাকলেও পরবর্তীতে শহরে কেবল টিভির আগমনের ফলে প্রতিযোগিতার বাজারে সিনেমা হলগুলো পিছিয়ে পড়ে এবং দর্শকের উপস্থিতিতে ভাটা পড়ে। জনপ্রিয় এই রূপশ্রী হল কালের অমোঘ নিয়মে ২০০৫ সালে আচমকা বন্ধ হয়ে যায়, এই হলে প্রদর্শিত সর্বশেষ সিনেমা ছিল অমিতাভ অভিনীত”এক আজনবী”(হিন্দি)। আজও আমরা যখন এই রাস্তা দিয়ে যাই, সকলের চোখ অন্তত একবার হলেও রুপশ্রীর সেই স্থানের দিকে পড়বেই। তোমাকে যে আমরা আজও ভুলতে পারিনি “রুপশ্রী”, তুমি যে আমাদের মনের অনেক গভীরে জায়গা করে আছো।