বাংলার রাজনীতিতে এক অভিনব ব্যক্তিত্ব সাধন পান্ডে

বিশেষ প্রতিবেদন, অরুণ কুমার : বাংলার রাজনীতির অঙ্গনে প্রিয়রঞ্জন, সুব্রত, সৌমেন, অজিত পাঁজার সাথে যে নামটি উঠে আসে তা হল সাধন পান্ডের নাম। জীবন যুদ্ধে দীর্ঘ লড়াইয়ের শেষে প্রয়াত হলেন রাজ্যের মন্ত্রী সাধন পাণ্ডে। রবিবার মুম্বইয়ের হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন রাজ্যর ক্রেতা দফতরের মন্ত্রী সাধন পাণ্ডে। তবে বর্তমানে তাঁর কোনও পোর্টফোলিও ছিল না। সত্তরোর্ধ্ব মন্ত্রী তথা তৃণমূল নেতা সাধন পাণ্ডের মৃত্যুতে শোকজ্ঞাপন করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।


এই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের জীবন নানান বৈচিত্রে ভরপুর। সত্তরের দশকের শেষের দিক থেকে মানিকতলা বড়তলা এলাকায় রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন তিনি। এলাকার তৎকালীন সবচেয়ে প্রভাবশালী কংগ্রেস নেতা অজিত পাঁজার অনুগামী বলে পরিচিত ছিলেন সাধন। অজিত পাঁজার হাত ধরেই এআইসিসি-তে নিজের যোগাযোগ হয়েছিল তাঁর। অল্প সময়েই সর্বভারতীয় কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক রাজেন্দ্রকুমারী বাজপেয়ীর ঘনিষ্ঠ হন। কলকাতার কয়েকজন প্রথম সারির নেতার পাশাপাশি তিনিও ঘনঘন দিল্লি যাতায়াত করতেন।


এই সাধন পাণ্ডের রাজনৈতিক জীবন বরাবরই উত্তর কলকাতা কেন্দ্রিক। টানা ন’বার রাজ্য বিধানসভার সদস্য হয়েছেন তিনি। এর মধ্যে ১৯৮৫ থেকে ২০০১ পর্যন্ত ছিলেন কংগ্রেসের বিধায়ক। ২০০১ থেকে আমৃত্যু তৃণমূলের বিধায়ক। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় কেবলমাত্র সুব্রত মুখোপাধ্যায়ই তাঁর থেকে বেশি বার বিধায়ক হয়েছেন। এই বিষয়ে উল্লেখ করতে হয় যে,
১৯৮৪ সালের ডিসেম্বরে লোকসভা নির্বাচনে কলকাতা উত্তর-পূর্ব আসন থেকে জিতে প্রথমবারের জন্য সাংসদ হন অজিত। তার পরেই বড়তলার বিধায়ক পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৮৫ সালের মার্চে বড়তলা বিধানসভার উপনির্বাচন হয়। সেই নির্বাচনেই সাংসদ অজিত ও রাজেন্দ্রকুমারীর সমর্থনে প্রার্থী হয়ে জয়লাভ করেন সাধন।


এরপর গঙ্গার উপর দিয়ে প্রচুর জল গড়িয়ে গেছে।
আশির দশক থেকে নববুই এর দশকের উত্তরণ ঘটেছে। রাজনীতির আকাশে এসেছে নানান পরিবর্তন। এরপর ১৯৯৮ সালে কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূল গঠন করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ওই বছরেরই ফেব্রুয়ারিতে লোকসভা নির্বাচনে কলকাতা উত্তর-পূর্ব আসন থেকে তৃণমূল প্রার্থী হন অজিত পাঁজা। সেই নির্বাচনে তাঁর বিরুদ্ধে কংগ্রেসের প্রার্থী ছিলেন সাধন। কিন্তু লোকসভায় তাঁর শোচনীয় পরাজয় হয়। দু’জনে একসঙ্গে কংগ্রেসে থাকাকালীনই একদা রাজনৈতিক গুরু অজিত পাঁজার সঙ্গে সাধনের মনোমালিন্য চরমে পৌঁছেছিল।

সাধন পান্ডে কংগ্রেসের রাজনীতিতে কোনও বড় নেতার অনুগামী না হলেও, এক স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন । ২০০১ সালের বিধানসভা ভোটের আগে কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেন। ২০০১ এবং ২০০৬ সালে তৃণমূল প্রতীকেই বড়তলার বিধায়ক হন। তবে ২০০৬ সালে ভোটে জয়ের পরেই মমতার সঙ্গে সঙ্ঘাত বাঁধে বড়তলার বিধায়কের। প্রকাশ্যে দলবিরোধী মন্তব্য করতে শুরু করেন তিনি। কিন্তু সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময় যাবতীয় বিবাদ ভুলে দলের আন্দোলনে যোগ দেন। এরপর বিধানসভার আসন পুনর্বিন্যাসের কারণে ২০০৯ সালে লুপ্ত হয়ে যায় সাধনের বড়তলা কেন্দ্র। নতুন বিধানসভা কেন্দ্র হয় মানিকতলা। ২০১১ সালে মানিকতলায় তাঁকে প্রার্থী করেন মমতা। জিতে মমতার প্রথম মন্ত্রিসভায় ক্রেতা সুরক্ষা দফতরের মন্ত্রী হন তিনি। ২০১৬ এবং ২০২১ সালের ভোটে জিতেও ওই দফতরের মন্ত্রী হন তিনিই। এর সঙ্গে স্বনির্ভর গোষ্ঠী এবং স্বনিযুক্তি দফতরের মন্ত্রীও ছিলেন সাধন। বিধানসভা ভোটে কখনও পরাজিত না হওয়ার নজির নিয়ে বিদায় নিলেন তিনি। এটাই সাধন পান্ডের জীবনে সবথেকে বড় কৃতিত্ব তথা বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসেও।

২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে তিনি মানিকতলা
থেকে তৃণমূলের টিকিটে জয়ী হন। মন্ত্রী হয়েছিলেন। কিন্তু তারপরই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। বছর দশেক আগে তাঁর কিডনি প্রতিস্থাপন হয়েছিল। তারপর থেকেই ভালো-মন্দ মিশিয়ে চলছিল। এই অবস্থাতেই তিনি রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ দফতর সামলেছেন। এবারও তিনি বিধানসভায় প্রতিদ্বন্দ্বিতায় করেন। প্রচার পর্বে একবার অসুস্থ হয়ে ভর্তি হন হাসপাতালে। তারপর কয়েকদিনের মধ্যেই বাড়ি ফিরে আসেন।

২০২১-এর জুলাই মাসে তিনি ফের অসুস্থ হয়ে পড়েন। ফুসফুসের সংক্রমণে আক্রান্ত মন্ত্রীকে কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তিনি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন। ভেন্টিলেশনে রাখা হয় তাঁকে। তারপর মুম্বইয়ের হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। অবশেষে জীবন-যুদ্ধে হার মানলেন বর্ষীয়ান মন্ত্রী। ৭১ বছর বয়সেই থেমে গেল তাঁর পথ চলা।

ক্রেতা সুরক্ষা দফতরের পাশাপাশি রাজ্যে স্বনির্ভর ও স্বনিযুক্তি দফতরের মন্ত্রী ছিলেন সাধন পাণ্ডে। তবে তাঁর অসুস্থতা দীর্ঘায়িত হওয়ায় দুটি দফতর সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের হাতে তুলে দেওয়া হয়। তারপর সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের প্রয়াণের পর হাতবদল হয়। সাধন পাণ্ডের হাতে থাকা সমস্ত দফতরই অন্যদের বণ্টন করে দেওয়া হয়। তবে দফতরহীন মন্ত্রী রেখে দেওয়া হয় সাধন পাণ্ডেকে।

এই সাধন পাণ্ডের প্রয়াণে শোকপ্রকাশ করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় টুইটারে লেখেন, আমাদের দীর্ঘদিনের সতীর্থ, দলীয় নেতা এবং ক্যাবিনেটের মন্ত্রী সাধন পাণ্ডে প্রয়াত হলেন। দীর্ঘদিন ধরে ওঁর সম্পর্কে সুসম্পর্ক ছিল আমার। ওঁর প্রয়াণে আমি মর্মাহত। ওঁর পরিবার, পরিজন, বন্ধু বান্ধব ও অনুগামীদের প্রতি সমব্যাথী আমি। মন্ত্রী সাধন পাণ্ডের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেন রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়ও।

বাংলার সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে এক অভিনব ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন এই সাধন পান্ডে। তার প্রয়াণে শূন্যতার সৃষ্টি হলেও বিধানসভা নির্বাচনে পরাজিত না হওয়া এক বিধায়ক হিসেবে তাঁর তৈরি করা কৃতিত্ব বা নজির ইতিহাসে স্থান পাবে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

photo credit facebook

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *