ছোট গল্প : এক অসমাপ্ত প্রেমকাহিনী

লেখক : পিনাকী রঞ্জন পাল

জলপাইগুড়ি শহরের একটি বুকশপের উপরের তলায় ছিল অভিজ্ঞানের স্টুডিও। রং, ক্যানভাস আর ব্রাশের মাঝে হারিয়ে যেত সে। প্রতিটি ক্যানভাসে তার স্বপ্ন, তার অনুভূতির ছাপ রাখত সে। একদিন, স্টুডিওর নিচ থেকে আসা একটি মিষ্টি সুরে তার মন মুগ্ধ হয়ে ওঠে। তাকিয়ে দেখে, একটি মেয়ে গিটার বাজিয়ে গান গাইছে। সেই মেয়েটির নাম ছিল অনিন্দিতা।

অনিন্দিতা ছিল একজন স্বাধীন চেতনার গায়িকা। তার সুরে ছিল জীবনের সব রং। অভিজ্ঞানের রং আর অনিন্দিতার সুর মিলে মিশে এক নতুন সৃষ্টির জন্ম দিল। দুজনে মিলে তারা একসাথে কাজ করতে শুরু করল।

দুজনের মধ্যে একটি গভীর বন্ধন গড়ে উঠল। তারা উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন কোণায় ঘুরত, নতুন নতুন জায়গা আবিষ্কার করত। তারা একসাথে চায়ের দোকানে0 বসে গল্প করত, রাস্তার পাশে বসে ছবি আঁকত। তাদের জীবন ছিল স্বাধীন, সৃজনশীল এবং রঙিন।

কিন্তু তাদের এই সম্পর্ক সহজ ছিল না। তাদের মধ্যে অনেক মতভেদ হত। কিন্তু তারা সবসময়ই একসাথে সমাধান খুঁজে বের করত।

দিন গড়িয়ে যাওয়ার সাথে সাথে তাদের বন্ধুত্ব প্রেমে পরিণত হল। তাদের মধ্যে একটি গভীর আবেগ জন্ম নিল। তারা একে অপরকে অনুপ্রাণিত করত, সাহায্য করত। তাদের প্রেম ছিল একটি সুন্দর গল্প, যা ক্যানভাসে রাঙা হয়ে উঠত আর সুরে মিশে যেত।

তারা যখন তাদের প্রেমের কথা সবার সামনে স্বীকার করতে চাইল, তখন তাদের পরিবারের পক্ষ থেকে অনেক বাধা এল। অভিজ্ঞানের বাবা চাইত না যে তার ছেলে একজন সঙ্গীতশিল্পীকে বিয়ে করুক। অনিন্দিতার বাবা চাইত না যে তার মেয়ে একজন শিল্পীকে বিয়ে করুক। কিন্তু অনিন্দিতা আর অভিজ্ঞান তাদের প্রেমের জন্য লড়াই করতে প্রস্তুত ছিল।

অনেক কষ্টের পর অনিন্দিতা আর অভিজ্ঞানের পরিবার তাদের সম্পর্ক মেনে নিল। তারা বিয়ে করল। বিয়ের পর শিলিগুড়ি শহরে একটি ছোট্ট বাড়ি ভাড়া নিয়ে তারা নতুন জীবন শুরু করল। বাড়িটি ছিল তাদের ক্যানভাস, যেখানে তারা রং আর সুরের মিশেলে নতুন নতুন সৃষ্টি করত।

অভিজ্ঞান তার স্টুডিওকে বাড়ির এক কোণে সাজিয়ে নিয়েছিল। রং, ব্রাশ আর ক্যানভাসের সাথে তার পুরনো বন্ধুত্ব নতুন করে জাগিয়ে তুলেছিল। অনিন্দিতা তার গিটার আর কীবোর্ড নিয়ে বাড়ির আরেক কোণে সুর তৈরি করত। তাদের বাড়িটি এখন ছিল এক সৃজনশীলতার আধার।

দিনের পর দিন তারা একসাথে কাজ করত, একসাথে খেত, একসাথে ঘুমাত। তাদের জীবন ছিল এক সুন্দর স্বপ্ন। কিন্তু একদিন অনিন্দিতা বুঝতে পারল যে সে আর আগের মতো সুর তৈরি করতে পারছে না। সে অনুপ্রেরণা হারিয়ে ফেলেছে।

অভিজ্ঞান তার এই অবস্থা দেখে খুব চিন্তিত হয়ে পড়ল। সে অনিন্দিতাকে নিয়ে পাহাড়ে ঘুরতে যায়। পাহাড়ের শান্ত পরিবেশে অনিন্দিতা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে উঠল। সে পাহাড়ের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে গেল। সেখানে বসে সে একটি নতুন গান রচনা করল।

পাহাড় থেকে ফিরে অনিন্দিতা আবার আগের মতো সুর তৈরি করতে শুরু করল। অভিজ্ঞানও তার নতুন ছবি আঁকা শুরু করল। তাদের জীবনে আবার নতুন এক অধ্যায় শুরু হল।

কিন্তু এই সুখের জীবন বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। কয়েক বছরে অনিন্দিতা সঙ্গীত জগতে বেশ নামডাক করে ফেলল। এখন সে বেশিরভাগ সময় কলকাতাতেই থাকে। এদিকে অভিজ্ঞান অনিন্দিতাকে ছেড়ে থাকতে থাকতে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ল। দিনের পর দিন তাদের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে লাগল। তারা আর আগের মতো একসাথে সময় কাটাত না। অনিন্দিতা তার গানে নিজেকে হারিয়ে ফেলত আর অভিজ্ঞান তার অতীতের স্মৃতিতে।

একদিন, অনিন্দিতা অভিজ্ঞানকে বলে, “আমি আর তোকে আগের মতো ভালোবাসতে পারছি না। আমি মনে করি আমাদের পথ আলাদা হওয়া যাওয়া উচিত।”

অভিজ্ঞানের মাথায় যেন পৃথিবী ভেঙে পড়ল। সে কখনো ভাবেনি যে তার প্রিয় মানুষ তাকে ছেড়ে চলে যাবে। সে অনেক কষ্ট করে অনিন্দিতাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করল কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ হল।

অবশেষে, তাদের বিচ্ছেদ হয়ে গেল। তাদের সুন্দর স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। অভিজ্ঞান তার বাকি জীবন একা কাটাতে লাগলো। সে তার সব কষ্ট তার ছবিতে প্রকাশ করত। তার ছবিগুলোতে দুঃখ, একাকীত্ব, আর বিচ্ছেদের বেদনা প্রতিফলিত হত।

কিন্তু অনিন্দিতা কলকাতায় নতুন করে জীবন শুরু করল। অনিন্দিতা আর অভিজ্ঞানের প্রেমের গল্প ছিল এক অসমাপ্ত সুর। এমন একটি সুর যা শুরু হয়েছিল সুন্দরভাবে কিন্তু শেষ হয়েছিল একটি বিষাদে।

© পিনাকী রঞ্জন পাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *