ছোট গল্প : নীলকণ্ঠ লাইব্রেরি ও একুশের আলো

পিনাকী রঞ্জন পাল

(এক)
নীলকণ্ঠ লাইব্রেরির সামনে দিয়ে হেঁটে গেলে একটা পুরনো বইয়ের গন্ধ ভেসে আসে। ধুলো জমা কাঠের তাকের ফাঁক দিয়ে সেই গন্ধ উড়ে এসে রোদ্দুরের সঙ্গে মেশে। দোকানটা বড় নয়, তবে একসময় ছিল স্বপ্নের মতো। জলপাইগুড়ির কদমতলা মোড়ে বহু বছরের চিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই বইয়ের দোকানটা, যেন বাংলা ভাষার এক অনুচ্চারিত সাক্ষী।

অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী দোকানের কাঠের কাউন্টারের পেছনে বসে থাকেন। বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে, তবু চোখের তারায় এখনও উজ্জ্বলতা টিকে আছে। সারাদিন বইগুলোর ধুলো ঝাড়েন, পাতা উল্টে দেখেন, যেন সেগুলো তার পুরনো বন্ধুর মতো। বাংলা সাহিত্যের যত দিকপাল— বিভূতিভূষণ, শরৎচন্দ্র, মানিক, জীবনানন্দ— তাদের বইগুলো একেবারে সামনের তাকেই রাখা। অথচ এখন যারা আসে, তারা মোটা ইংরেজি উপন্যাস চায়। ফিকশন, থ্রিলার, ম্যানেজমেন্ট বই চায়। বাংলা বইয়ের দিকে খুব কম লোকের নজর পড়ে।

এই দোকানেই একসময় কলেজপড়ুয়া ছেলেমেয়েরা আড্ডা দিত, তাদের হাতে হাতে ঘুরত বিভূতিভূষণের “আরণ্যক” থেকে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের বিভিন্ন কবিতার বই। এখন সেইসব আড্ডা ফুরিয়েছে।

আর ঐশী? অনিরুদ্ধবাবুর একমাত্র মেয়ে। দশম শ্রেণির ছাত্রী, শহরের বিখ্যাত ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ে। নতুন প্রজন্মের ছটফটে, স্মার্ট মেয়ে। কিন্তু বাংলা বইয়ের পাতায় তার মন বসে না। তার দুনিয়া একেবারে আলাদা। স্কুলের বন্ধুরা ইংরেজিতেই কথা বলে, বাংলা বলাটা যেন “বোরিং”! বাবার দোকানটা তার কাছে পুরনো দিনের স্মৃতির মতো, যেটা হয়তো সময়ের সঙ্গে মিলিয়ে যাবে একদিন।

অনিরুদ্ধবাবু বোঝেন এসব। মেয়ের কাছে তার বইয়ের দোকানটা গর্বের কিছু নয়, বরং একটা বোঝা। বুকের মধ্যে কোথায় যেন কষ্টটা জমে ওঠে, কিন্তু প্রকাশ করেন না। শুধু দিনের শেষে বইগুলোর পাতা উল্টে দেখেন আর ভাবেন— একদিন হয়তো ঐশীও বুঝবে, ভাষা শুধু কথা বলার মাধ্যম নয়, ভাষা আত্মপরিচয়ের এক বিশাল আকাশ।

(দুই)
২০ ফেব্রুয়ারির সন্ধ্যা। বাইরে কদমতলার রাস্তার বাহারী লাইটগুলো জ্বলে উঠেছে, দোকানের সামনে দিয়ে ছুটে চলেছে টোটো, বাইক, স্কুটি। অফিস ফেরত মানুষের ভিড় রাস্তায়।

ঐশী স্কুল থেকে ফিরেই দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ব্যাগটা ছুড়ে দিল। মুখ গম্ভীর। কপালে ভাঁজ। অনিরুদ্ধবাবু দোকানের কাউন্টারে বসে একটা পুরনো বইয়ের মলাট ঠিক করছিলেন, মেয়ের এমন বিরক্ত মুখ দেখে তাকালেন।

— “বাবা, আমাদের স্কুলে কাল ইন্টারন্যাশনাল মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ ডে নিয়ে একটা কম্পিটিশন হচ্ছে। প্রত্যেক ক্লাস থেকে একজন করে ভাষার ওপর স্পিচ দেবে। আর আমাকে বলেছে ক্লাসের পক্ষ থেকে দিতে!”

অনিরুদ্ধবাবু হাসলেন। – “এ তো ভালো খবর!”

— “ভালো? বাংলায় স্পিচ দিতে হবে! আমি কী বলব? বাংলায় বলার অভ্যাসই নেই আমার!”

ঐশী দম ফেলল। যেন বিশাল কোনো বিপদের মধ্যে পড়ে গেছে।

অনিরুদ্ধবাবু এবার চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে দোকানের এক কোণে বসলেন। মেয়ে একটু রাগ দেখাচ্ছে, তবু ভেতরে ভয়ও লুকোনো আছে। তাকের উপর হাত বুলিয়ে একটা পুরনো বই নামালেন— বাংলা ভাষার ইতিহাস। বইটার পাতাগুলো হলুদ হয়ে গেছে, কিন্তু তার ভেতরের কথা আজও সতেজ।

বইটা মেয়ের হাতে দিয়ে বললেন, — “জানো, বাংলা ভাষার জন্য কত মানুষ প্রাণ দিয়েছে?”

ঐশী চুপ। কিছুক্ষণ মুখ কুঁচকে থাকল, তারপর বলল, — “শুনেছি… কিন্তু ঠিকঠাক জানি না।”

অনিরুদ্ধবাবু এবার ধীরে ধীরে বলতে লাগলেন ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির কথা। ঢাকার রাজপথে ছাত্রদের মিছিল, পুলিশের গুলি, সালাম, রফিক, বরকতদের রক্তে ভিজে যাওয়া রাজপথ… ঐশী একদম চুপ করে শুনছিল।

তারপর বাবা বললেন, — “তবে শুধু বাংলাদেশেই নয়, বাংলার অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই আমাদের এখানেও কম ছিল না। আমাদের এই দোকান, যেখানে তুমি বসে আছো, এখান থেকেই একসময় কিছু তরুণ বাংলা ভাষার প্রচার-প্রসারে কাজ করেছিল। এখানে বসেই বাংলা সাহিত্যচর্চা হতো, বই নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলত। সেই সময়ের ছেলেরা ভাষার জন্য প্রাণ দেয়নি ঠিকই, কিন্তু তারা বাংলাকে ভালোবেসেছিল প্রাণ দিয়ে।”

ঐশী বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। এমন আগুনঝরা চোখ সে আগে কখনো দেখেনি। এতদিন বাবা শুধু পুরনো বই নিয়ে বসে থাকতেন, ও ভেবেছিল, বাবা শুধু একটা বইয়ের দোকান চালান। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে, বাবার বুকের মধ্যে একটা ভাষার ইতিহাস লুকিয়ে আছে।

বাইরে কদমতলার রাস্তা তখন অনেকটাই নিঃশব্দ, বাতাসে শীতের আমেজ। ঐশী পায়ের আঙুলে মাটি চেপে ধরে বলল, — “বাবা, তুমি কি আমাকে একটু সাহায্য করবে?”

অনিরুদ্ধবাবু হাসলেন। দোকানের বাতির নিচে তার ছায়া যেন আরেকটু দীর্ঘ হয়ে উঠল।

(তিন)
রাত তখন গভীর। বাইরে শীতের বাতাস ধীর লয়ে বইছে, ঘরের কোণে আলো-আঁধারিতে বইয়ের পাতাগুলো যেন কেঁপে কেঁপে উঠছে। ঐশী টেবিলের সামনে বসে আছে। একদিকে বাবার দেওয়া বাংলা ভাষার ইতিহাস, অন্যদিকে পুরনো কিছু সংবাদপত্র— তার পাতাগুলোয় ভাষা আন্দোলনের সময়ের খবর ছাপা।

প্রথমে পড়তে পড়তে বিরক্ত লাগছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে যেন একটা অন্যরকম অনুভূতি কাজ করল তার ভিতরে। পঞ্চাশের দশকের ছবি, মিছিলের শ্লোগান, পুলিশের বুটের শব্দ— সব মিলিয়ে তার মনে হতে লাগল, ভাষার জন্য লড়াই শুধু ইতিহাসের পাতায় নেই, সেটা যেন তার সামনে জীবন্ত হয়ে উঠছে।

কখন রাত কেটে গেল, বুঝতেই পারেনি ঐশী। কেবল মনে হল, এতদিন সে ভুল করেছিল। যে ভাষায় বাবা তাকে ছোটবেলায় গল্প বলতেন, যে ভাষায় তার ঠাকুমার মুখে শুনেছিল পুরনো দিনের স্মৃতি, সেই ভাষার প্রতি এত উদাসীন ছিল সে!

২১ ফেব্রুয়ারি। সকালে স্কুলের অডিটোরিয়ামের মঞ্চে দাঁড়িয়ে আছে ঐশী। সামনে শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী, বিচারকের সারি। বুকের মধ্যে হালকা ধুকপুক, কিন্তু কণ্ঠে এক অদ্ভুত দৃঢ়তা।

— “ভাষা শুধু কথা বলার মাধ্যম নয়, ভাষা আমাদের পরিচয়। যে ভাষার জন্য মানুষ প্রাণ দিয়েছে, সেই ভাষাকে ভুলে গেলে, আমরা নিজেদেরই ভুলে যাব।”

তার কণ্ঠ ধীরে ধীরে দৃঢ় হয়ে উঠল। বাংলা ভাষার ইতিহাস, ভাষা আন্দোলন, জলপাইগুড়ির মতো শহরেও বাংলা টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম— সব উঠে এল তার কথায়।

সারা অডিটোরিয়ামে নিস্তব্ধতা। সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনছে।

পেছনের সারিতে দাঁড়িয়ে আছেন অনিরুদ্ধবাবু। মেয়ের কণ্ঠ শুনে তার চোখ ভিজে এল। এতদিন তিনি ভেবেছিলেন, তার মেয়ে বাংলা ভাষাকে আপন করে নিতে পারবে না। কিন্তু আজ সে ভাষার কথা বলছে, এমনভাবে বলছে, যেন সেটা তার আত্মার এক অংশ।

সন্ধ্যায় ঐশী বাড়ি ফিরল। বাবার দোকানের সামনে এসে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। দোকানটা আজ আর ছোট লাগছে না। ভিতরের পুরনো বইয়ের গন্ধে আজ যেন নতুন করে ভাষার ভালোবাসা খুঁজে পেল সে।

সে ধীরে ধীরে ঢুকে বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

— “বাবা, একটা বাংলা উপন্যাস দেবে? পড়তে চাই।”

অনিরুদ্ধবাবু প্রথমে অবাক, তারপর হাসলেন। তাক থেকে একটা বই নামিয়ে দিলেন। ঐশী সেটা হাতে নিয়ে দেখল— পদ্মানদীর মাঝি।

বাইরের বাতাসে তখন শিমুল-কাশের গন্ধ, আর বাবার চোখে আলো।

(শেষ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *