ছোট গল্প :পপের প্রভুভক্তি

পিনাকী রঞ্জন পাল

অনেক বছর আগেকার কথা। জলপাইগুড়ি শহর তখন খুব বেশি জাঁকজমকপূর্ণ ছিল না। চারদিকে ছিল সবুজ বনানী আর খোলা মাঠ। লোকসংখ্যাও এখনকার মতো এত বেশি ছিল না। মানুষের জীবনযাত্রা ছিল সরল, প্রযুক্তির জগৎ তখনও সেভাবে ঢুকে পড়েনি। সন্ধ্যার পর শহরের রাস্তাগুলোয় টিমটিমে বাল্বের হলুদ আলো জ্বলে উঠত। কাজ সেরে বাড়ি ফেরার পথে মানুষজন তাড়াহুড়ো করত, কারণ রাত গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তা আরও জনশূন্য হয়ে যেত।

আমাদের বাড়ি ছিল শহরের প্রান্তে, নিরিবিলি জায়গায়।ছোট্ট একটি ইটের গাঁথুনি দেওয়া কর্গেটের টিনের চালের ঘর। সামনেই ছিল একটা ছোট বাগান। পেছনে ফাঁকা মাঠ, যেখানে বর্ষাকালে জল জমত, আর শীতকালে কুয়াশায় ঢেকে যেত পুরো এলাকা। আমরা ছিলাম ছয় জনের এক সুখী পরিবার—বাবা, মা, আর আমরা চার ভাইবোন। আর ছিল আমাদের পরিবারের এক বিশেষ সদস্য, আমাদের পোষ্য কুকুর পপ।

আমার বাবা ছিলেন এক প্রাইভেট কোম্পানির কর্মচারী। প্রতিদিন সকালে সাইকেল নিয়ে কাজের জন্য বেরিয়ে পড়তেন। শহরের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে তাকে যেতে হতো। আর কাজ সেরে ফিরতে ফিরতে প্রায় রাত হয়ে যেত। আমাদের মা ছিলেন সংসারের স্তম্ভ। তিনি ঘর সামলাতেন, আমাদের পড়াশোনার দেখভাল করতেন, আর বাবার জন্য অপেক্ষা করতেন। আমাদের পরিবারের সবার চোখের মণি ছিল পপ। একেবারে ছোটবেলা থেকেই পপ আমাদের সঙ্গী।

পপ আমাদের জীবনে এসেছিল এক অদ্ভুত ঘটনার মাধ্যমে। একদিন শীতের রাতে বাবা কাজ থেকে ফেরার পথে একটা কুকুরছানাকে রাস্তায় কুঁকড়ে থাকতে দেখেন। তাকে দেখে বাবার মায়া হয়। তিনি পলিথিনে মুড়িয়ে কুকুরছানাটিকে নিয়ে বাড়ি ফেরেন। প্রথমে মা একটু আপত্তি করেছিলেন, কারণ সংসার খরচের মধ্যেই আমাদের চার ভাইবোনের লালনপালন করতে বেশ হিমশিম খেতে হচ্ছিল। কিন্তু পপের মায়াবী চোখ আর বাবার অনুরোধে মা তাকে ঘরে রাখতে রাজি হন। সেই থেকেই সে আমাদের পরিবারের অংশ হয়ে ওঠে। পপের সঙ্গে আমাদের বন্ধন খুব দ্রুতই গভীর হয়ে যায়। সে শুধু আমাদের পোষ্য নয়, আমাদের বন্ধু, আমাদের পাহারাদার। পপ যেন বুঝত, আমরা ওর কাছে শুধু প্রভু নই, ওর পরিবারও। সে বুঝতে পারত আমাদের অনুভূতি, আমাদের কথা।

বর্ষাকাল তখন পুরোদমে চলছে। সেদিন সকাল থেকে আকাশ কালো মেঘে ঢাকা, সঙ্গে একটানা বৃষ্টি। বর্ষাকালের সেই একরাশ বৃষ্টি যেন থামার নামই নিচ্ছিল না। জলপাইগুড়ির রাস্তা ভিজে কাদামাখা। বাবা প্রতিদিনের মতোই সাইকেল আর ছাতা নিয়ে কাজে বেরিয়ে গেলেন। মা বারবার বলছিলেন, “আজ বৃষ্টি এত হচ্ছে, তুমি কাজ না গেলে হয় না?” বাবা মুচকি হেসে বললেন, “কাজে না গেলে সংসার চলবে কীভাবে?” আমাদের পড়াশোনার চাপ ছিল বলে আমরা ঘরেই ছিলাম।

বৃষ্টি দুপুরের পর থেকে আরও বাড়ল। বিকেল নাগাদ আমাদের বাড়ির সামনের বাগান জলমগ্ন হয়ে গেল। মা বারবার বলছিলেন, “বৃষ্টি এত বাড়ছে, তোমাদের বাবা কীভাবে ফিরবে?” আমরা জানতাম, বাবা বরাবরের মতোই সময়মতো ফিরবেন।

সন্ধ্যার দিকে বিদ্যুৎ চলে গেল। ঘরে তখন শুধু হারিকেনের আলো। আমরা চার ভাইবোন বিছানায় বসে পড়ছিলাম। বৃষ্টি যেন ঝমঝমিয়ে নেমেই চলেছে। পপ বারান্দায় বসে ছিল। তার চোখ বারবার বাড়ির গেটের দিকে। মা বারান্দা থেকে ওকে ঘরে ডাকলেন, “পপ, এত ভিজছিস কেন? ঘরে আয়।” কিন্তু পপ আসতেই চাইল না। সে যেন বাবার আসার অপেক্ষায় দরজার বাইরে চোখ রেখে বসে ছিল।

রাত বাড়তে থাকল। বাবা সাধারণত সাড়ে আটটার মধ্যে ফিরতেন। কিন্তু সেদিন নয়টা বাজলেও বাবার কোনো খোঁজ নেই। মা একটু উদ্বিগ্ন হয়ে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন। আমরা বুঝতে পারছিলাম, মায়ের মনে দুশ্চিন্তা বাড়ছে। কিন্তু পপ তখনও নড়েনি। তার চোখ বারান্দার গেটের দিকে। তার ভেতরেও একটা অস্থিরতা কাজ করছিল।

আমরা ভাইবোনেরা শুতে চলে গেছি। ঘুম না আসায় শুয়ে শুয়ে গল্প করছিলাম। পপ তখনও বারান্দায় বসে ছিল। তার অস্থিরতা আমাদের চোখে পড়ছিল। সে বারবার গেটের দিকে তাকাচ্ছিল, কখনো সামনের পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াচ্ছিল, কখনো আবার বসে পড়ছিল।

ঠিক তখনই বাইরে থেকে সাইকেলের বেলের টুংটাং শব্দ পাওয়া গেল। পপ এক লাফে উঠল, যেন তার প্রাণ ফিরে পেল। সে আনন্দে চিৎকার করতে করতে গেটের দিকে ছুটে গেল। আমরা জানালার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, বাবা ভেজা সাইকেল নিয়ে গেট খুলে ভেতরে ঢুকছেন। পপ বাবার গায়ে লাফিয়ে পড়ল।

বাবা ভিজে একাকার। মা গামছা এনে দিলেন, “তুমি এত ভিজে গেছ, একটু গা মুছে নাও।” বাবা গামছা দিয়ে গা মুছতে মুছতে সাইকেলটা বারান্দার এক পাশে রেখে ঘরে ঢুকে পড়লেন। মা বললেন, “পপ, এখন আর বাইরে থেকে কী লাভ? ঘরে আয়।” কিন্তু পপ তখনও ঘরে ঢুকতে নারাজ।

বাবা তখন ভেতরে বসে খাচ্ছেন। মা বাবাকে বললেন, “পপ আজ একটু অদ্ভুত আচরণ করছে। বাইরে থেকে আসতে চাইছে না।” বাবা মুচকি হেসে বললেন, “ও বুঝি রেগে আছে, সারা দিন একা ছিল।”

খাওয়া শেষ করে বাবা বিছানায় এলেন। মা হারিকেন নিভিয়ে শুতে গেলেন। তখনই দরজায় আঁচড়ানোর শব্দ। আমরা বুঝতে পারলাম, পপ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কুই কুই করছে।

মা বললেন, “তুমি দরজা খুলে দাও তো। ও বোধহয় এখন ঘরে আসতে চাইছে।” বাবা দরজা খুলে বললেন, “আয় ভেতরে।” কিন্তু পপ ভেতরে না ঢুকে বাবার সাইকেলের দিকে দৌড় দিল। সে তার পেছনের পায়ে ভর দিয়ে সাইকেলের ওপর লাফিয়ে উঠল।

বাবা অবাক হয়ে বললেন, “পপ, কী হয়েছে?” মা এসে দাঁড়ালেন। তিনি বললেন, “তুমি সাইকেলটা আজ ঘরে ঢোকাওনি, তাই তো?” বাবা হাসলেন, “আরে হ্যাঁ, বৃষ্টির তাড়ায় ভুলে গেছি।”

পপের অদ্ভুত আচরণ দেখে বাবা সাইকেলটা ঘরের ভেতরে নিয়ে এলেন। পপ এবার শান্ত হয়ে ঘরে ঢুকে নিজের জায়গায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। মা বললেন, “ওর এ বুদ্ধি সত্যিই প্রশংসনীয়। ভাবতেও পারিনি, এমন কিছু করতেও পারে।”

পপের সেই রাতের কাজ আমাদের মনে গভীর ছাপ ফেলেছিল। আমরা বুঝতে পারলাম, পপ শুধু আমাদের পোষ্য নয়, সে আমাদের পরিবারের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তার এই প্রভুভক্তি শুধু আমাদের নয়, আশপাশের প্রতিবেশীদেরও মুগ্ধ করেছিল।

এরপর পপ আরও অনেকবার তার প্রভুভক্তি ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে। একবার বাড়িতে চোর ঢুকেছিল। পপের চিৎকারে আমরা সবাই উঠে পড়ি। চোর পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। আরেকবার ছোট ভাই পুকুরে পড়ে যাচ্ছিল, পপ তাকে টেনে তুলেছিল।

পপ আমাদের জীবনের এমন এক অধ্যায়, যার স্মৃতি আজও অমলিন। পপ আমাদের শিখিয়েছে যে ভালোবাসা ও ভক্তি শুধু মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। তার প্রভুভক্তি আর ভালোবাসা আমাদের পরিবারকে একত্রে বেঁধে রেখেছিল। পপ শুধু একটা কুকুর নয়, আমাদের পরিবারের একজন সদস্য, আমাদের রক্ষাকর্তা ছিল, যার কথা ভাবলে আজও আমাদের মন ভরে ওঠে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *