এই পৃথিবীতে আমাদের মধ্যে কেউ ভীষণ লম্বা তো, কেউ ততটাই বেঁটে। কেউ এত রোগা যেন ফুঁ মারলেই উড়ে যাবে, আবার কেউ এত মোটা যে তাকে নড়াচড়া করাবার জন্য হাতির সাহায্য নিতে হয়। মোটাদের কথা যখন উঠলোই তখন কয়েকজন বিশ্বপ্রসিদ্ধ স্থূলকায়দের কথা বলছেন পিনাকী রঞ্জন পাল।
১৯৪১ সালে আমেরিকার ওয়াশিংটন রাজ্যের বেনব্রিজ আইল্যান্ডে এক শিশুর জন্ম হয়। তার নাম ছিল জন ব্রোয়ার মিনেক। ছেলেবেলা থেকেই জন মোটা হতে শুরু করে এবং সারাজীবন এই রোগ তার সঙ্গী হয়ে ছিল।
জন শুধু মোটাই ছিলেন না, প্রকৃতি তাকে উচ্চতাও বেশ দিয়েছিল। তিনি ৬ ফুট ১ ইঞ্চি লম্বা ছিলেন। ১৯৬৩ সালে তার ওজন ছিল ১৮১ কিলোগ্রাম। তখন জন ছিলেন এক ট্যাক্সিচালক। জনের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার ওজনও বাড়তে থাকে। ১৯৬৬ সালে তার ওজন বেড়ে দাঁড়ায় ৩১৭ কিলোগ্রাম। ১৯৭৬ সালে জনের ওজন হয়েছিল ৪২২ কিলোগ্রাম। বেঢপ চেহারার জন ভীষণ দুঃখী ছিলেন। ১৯৭৮ সালে তিনি শ্বাসকষ্ট এবং হৃদরোগে আক্রান্ত হন। চিকিৎসার জন্য তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। জনকে বাড়িতে স্ট্রেচার-এ তোলার জন্য ১২ জন লোককে হাত লাগাতে হয়েছিল। হাসপাতালের কোনো বিছানাই তার ওজন সহ্য করতে না পারায় শেষে দুটো বিছানা জুড়ে অকে শোয়ানো হয়। তাকে বিছানায় শোয়ানোর জন্যও ১৩ জন লোকের প্রয়োজন হয়েছিল। জন নিজে পাশ ফিরতে পারতো না, ১৩ জন কর্মচারীর একটি দল তাকে পাশ ফিরিয়ে শুতে সাহায্য করতেন। হাসপাতালে ভর্তির সময় জনের ওজন ছিল ৬৩৫ কিলোগ্রাম।
হৃদযন্ত্র ঠিকমতো কাজ না করায় তার শরীরে জল জমে গিয়েছিল। দু’বছর হাসপাতালে চিকিৎসা করে জানের শরীর থেকে আটকে থাকা জল বার হয়েছিল। এই সময় ওকে শুধুমাত্র প্রতিদিন ১,২০০ ক্যালোরি ভোজন দেওয়া হতো। এর ফলে তার ওজন কমে ২১৬ কিলোগ্রামে দাঁড়ায়।
হাসপাতাল থেকে খুশি মনে বাড়ি ফিরলেন জন। কিন্তু ঘরে ফিরতেই মোটা হবার রোগ তাকে আবার জাপটে ধরে। মাত্র এক সপ্তাহেই তার ওজন ১১ কিলোগ্রাম বৃদ্ধি পেয়েছিল। এ কারণে তাকে আবার হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। মৃত্যু পর্যন্ত মোটা হবার রোগ তার সঙ্গী ছিল। ১৯৮৭ সালের ১০ সেপ্টেম্বর জনের মৃত্যু হয়। মৃত্যুর সময় তার ওজন ছিল ৩৬৩ কিলোগ্রাম।
জন ব্রোয়ার-এর নাম সর্বাধিক ওজনের ব্যবধানের স্বামী-স্ত্রী রূপেও গিনেস বুকে লিপিবদ্ধ রয়েছে। ১৯৭৮ সালের মার্চ মাসে জনের ওজন ছিল ৫৮৮ কিলোগ্রাম আর তার স্ত্রীর ওজন ছিল ৫০ কিলোগ্রাম। অর্থাৎ দু’জনের মধ্যে ওজনের পার্থক্যই ছিল ৫৩৯ কিলোগ্রাম।
১৯৯০ সালে ৪২ বর্ষীয়, ৬ ফুট লম্বা অতি ভীমাকৃতি চেহারার ওয়াল্টার হাডসন হঠাৎই সংবাদের শীর্ষে উঠে আসেন। ৫৬৭ কিলোগ্রাম ওজনের এই পুরুষ বাড়ির বাথরুমের দরজার মাঝে আটকে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে হাডসনকে বার করার পরে তার খাবারের পরিমাণ প্রচুর কমিয়ে ফেলতে হয়।
এই ভীমাকৃতি পুরুষ দীর্ঘ ১৬ বছর পর্যন্ত একই কামরাতে বন্দি ছিলেন। নিজের শরীরের ওজন ১৬৯ কিলোগ্রাম কমিয়ে ফেলার পরই তিনি বাড়ির অন্য কামরায় যেতে পেরেছিলেন। এই ঘটনায় তাঁর আনন্দের সীমা ছিল না, কারণ কারও সাহায্য ছাড়াই তিনি এক কামরা থেকে অন্য কামরাতে ঘুরে বেড়াতে পারছিলেন।
বাথরুমের দরজায় আটকে যাবার পরে পুষ্টি বিশেষজ্ঞ ডিক গ্রিগোরীর তত্বাবধানে হাডসনের ভোজন তালিকায় ব্যাপক পরিবর্তন করা হয়। গ্রিগোরীর তৈরি তালিকা অনুযায়ী হাডসন ফল, শাকসব্জি, কমলালেবুর রস খেতেন। মাংস একদম খেতে পারতেন না। আর প্রতিদিন দেড় গ্যালন জল অবশ্যই পান করতে হতো। এরফলে হাডসনের ওজন কমে দাঁড়ায় ৩৬৩ কিলোগ্রাম। পুষ্টি বিশেষজ্ঞ গ্রিগেরির পরিকল্পনা ছিল যে, বসন্তকালে হাডসনকে নিজের ক্লিনিকে নিয়ে যাবেন আর ততদিন সেখানে রাখবেন যতদিন না হাডসনের ওজন কমে যায়। হাডসন’ও বলেছিলেন যে তিনি স্বয়ং হেঁটে বাড়ির বাইরে যাবার চষ্টা করবেন।
১৯৯১ সালে হাডসনকে, বাহামার ওজন কমাবার এক চিকিৎসা কেন্দ্রে নিয়ে যাবার কথা ছিল। টেলিভিশনের ক্যামেরাম্যানেরা হাডসনের ঘরের বাইরে জমা হয়েছিলেন, যাতে দীর্ঘ ১৭ বছর একই ঘরে বন্দি থাকার পরে ভীমাকৃতি হাডসনের বাইরের দুনিয়াতে ফেলা প্রথম পদক্ষেপকে তারা ক্যামেরাবন্দী করে বিশ্ববাসীকে উপহার দিতে পারেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হাডসন সাহস হারিয়ে ফেলেন। তার প্রথমে মনে হয়েছিল তিনি পারবেন ঘরের বাইরে যেতে, কিন্তু তার পা দুটো শরীরের ওজন সহ্য করতে অসমর্থ ছিল। হতাশ হাডসন কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।
স্থূলকায় আকারের জন্য হাডসন নিজের শোয়ার ঘরের বিছানাতেই সর্বদা শুয়ে থাকতেন। এক কামরায় নিজের পৃথিবীতে হাডসন কিছুই পরতেন না, শুধু একটি চাদরই ছিল তাঁর পোশাক।
জীবিত ব্যক্তিদের মধ্যে আমেরিকার টি. জে. অ্যালবার্ট জ্যাকসন দশাসই চেহারার অধিকারী। তাঁর জন্ম ১৯৪১ সালে। বর্তমানে তাঁর বুকের ছাতি ৩০৫ সেমি, কোমর ২৯৪ সেমি আর ওজন ৪৪৫ কিলোগ্রাম। ব্রুকলিন, আমেরিকার মাইকেল হেবরস্কর জন্ম হয়েছিল ১৯৫৪ সালে। বিশ্বের ওজনদার পুরুষদের মধ্যে মাইকেল অন্যতম। ১৯৮৮ সালে তার ওজন ছিল ৪৪৫ কিলোগ্রাম। ১৯৯০ সালে ১০৫ কিলোগ্রাম’ ওজন কমিয়ে ফেলেন তিনি। ওজন কমানোয় এটি একটি বিশ্বরেকর্ড।
আমেরিকার চিকিৎসকেরা ১৯৮২ সালের ১৪ মার্চ নিউইয়র্কের এক হাসপাতালে এক ব্যক্তির অপারেশন করেছিলেন। সেই ব্যক্তির ওজন ছিল ৩৬২ কিলোগ্রাম। তার পেটের উপরিভাগ থেকে অপারেশন করে ৬৭ কিলোগ্রাম অতিরিক্ত চর্বি সরানো হয়েছিল। এই চর্বি সরাবার জন্য মেশিনের সাহায্য নেওয়া হয়েছিল।
স্থূলাকার চেহারার অধিকারী শুধু পুরুষরাই নয়, মহিলারাও এক্ষেত্রে খুব একটা পিছিয়ে নেই। বিশ্বের সর্বাধিক ওজনদার মহিলার খেতাব বর্তমানে রয়েছে আমেরিকার নিউ ইয়র্ক শহরের রোজি কার্নের্মুলার দখলে। ১৯৪৪ সালে জন্ম হওয়া রোজির ১৯৮৮ সালের ১৩ মার্চ ওজন ছিল ৩৮৫ কিলোগ্রাম।
বিশ্বের ওজনদার মহিলাদের অন্যতম ছিলেন পার্সী পালে ওয়াশিংটন। ওনার মৃত্যু হয়েছিল ১৯৭২ সালের ৯ অক্টোবর এক হাসপাতালে। হাসপাতালের ওজন মাপার মেশিনের ক্ষমতা ছিল ৩৬২.৮ কিলোগ্রাম পর্যন্ত, কিন্তু পার্সীর ওজন ছিল প্রায় ৩৯৯.১ কিলোগ্রাম। শুধু পুরুষ বা মহিলাই নয়, কিছু শিশুও অত্যধিক ওজনের জন্য প্রসিদ্ধ হয়েছেন। ইটালীর সিঙ্গ কারমোলিয়া ১৯৫৫ সালে এক ১০.২ কিলোগ্রাম ওজনের পুত্র সন্তানের দিয়েছিলেন। ব্রাজিলের ‘মহাশিশু বেরিডিয়ানো ডোস স্যান্টোস-এর জন্ম হয়েছিল ১৯৭৮ সালে। পাঁচ বছর বয়সে তার ওজন ছিল ৬৪.৮ কিলোগ্রাম। স্কটল্যান্ডের শিশু জেন্স ওয়াপর-এর জন্ম হয়েছিল ১৮১৯ সালে। ১৩ মাসে তার ওজন ছিল ৫০.৮ কিলোগ্রাম। ১৯২১ সালে তার মৃত্যু হয়।
ভারতের ৯ বছরের বালক গজানন শিবশংকর কচারডে নতুন বিশ্বরেকর্ড করেছে। ৯ বছরে তার ওজন ছিল ৮৭ কিলোগ্রাম। তবে জন্মের সময় তার ওজন ছিল স্বাভাবিক। গজানন প্রতিদিন অন্যান্য সাধারণ বালকদের মতো ভোজন করলেও তার ওজন অস্বাভাবিক গতিতে বেড়ে চলছে।
Photo source- Pixabay.