বিশ্ব আদিবাসী দিবসের ভাবনা কিছু কথা

অরুণ কুমার : সারা বিশ্বের সঙ্গে আমাদের দেশেও প্রতিবছর ৯ আগস্ট পালন করা হয় বিশ্ব আদিবাসী দিবস হিসেবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অবহেলিত, সুযোগ বঞ্চিত আদিবাসী জাতির সমস্যাগুলোর ওপর দৃষ্টি আকর্ষণ করা এবং তাদের অধিকার রক্ষা ও উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি করার ভাবনা নিয়ে রাষ্ট্রসংঘ ১৯৯৪ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী পালন করে আসছে এ দিবসটি।

আদিবাসী সম্প্রদায় বিশ্বের সমগ্র মানব সম্পদের মধ্যে বিশেষ গুরুত্বের দাবিদার। সেই গুরুত্বকে তুলে ধরার জন্য আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসের ভাবনা। বিশ্ব- সমাজের এই বিশিষ্ট অংশের কথা মনে করার ও মনে করানোর উদ্দেশ্যেই এমন একটি দিনের ভাবনা।

উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ১৯৯৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে বিশ্ব আদিবাসী দিবসটি পালনে ৪৯/২১৪ বিধিমালায় স্বীকৃতি পায় এবং ভারত সহ বিশ্বের ৯০টি দেশে ৩৭০ বিলিয়ন আদিবাসী প্রতিবছর ৯ আগস্ট এ দিবসটি উদযাপন করে থাকে। দিবসটি পালনের মূল লক্ষ্য হলো আদিবাসীদের জীবনধারা, মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার, আদিবাসী জাতির ভাষা ও সংস্কৃতি তথা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতন করে তোলা। এ ছাড়া বিশ্বব্যাপী আদিবাসী জনগণ তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিচয়, ভূমির অধিকার, অঞ্চল বা টেরিটরির অধিকার, প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকার ও নাগরিক মর্যাদার স্বীকৃতির দাবিতে দিবসটি পালন করে থাকে।

রাষ্ট্রসংঘ তাদের দাপ্তরিক কাজে ইন্ডিজিনাস, অর্থাৎ আদিবাসী শব্দটি ব্যবহার করে থাকে।
ভিন্ন জীবনধারা, বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি আর অনন্য শিল্পশৈলীর অফুরান মিশ্রণে ঘেরা এই সব জনগোষ্ঠী। পৃথিবী জুড়ে ৯০টির অধিক দেশে বসবাসরত ৫ সহস্রাধিক আদিবাসী গোষ্ঠী মানুষের সংখ্যা ৩৫-৩৬ কোটি, যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ৫ শতাংশ এবং পৃথিবীর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রায় ১৫ শতাংশ। এসব আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী প্রায় ৭ হাজার ভাষায় কথা বলে এবং তাদের রয়েছে ৫ হাজার স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য।

সারা পৃথিবীতে নানা দেশে আদিম অধিবাসীদের অত্যন্ত সুপষ্ট ঐতিহ্য বিরাজমান। শুধু ভারতেই আছেন ১২ কোটি আদিবাসী। যা ভারতের মোট জনসংখ্যার ৮.৬ শতাংশ। প্রায় ৭০৫টি আদিম জাতি ভারতে বাস করে। এ ছাড়াও আরও বেশ কিছু প্রজাতি আছে ভারতে। আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে অনেক আদিম অধিবাসীর বসবাস।
ভারতের মূল ভূখণ্ডে সাঁওতাল কোল ভিল ইত্যাদি আদিম অধিবাসীর বসবাস। অসম, বাংলা, ত্রিপুরা, বিহার, ওডিশা, ছত্তীশগঢ়েই মূলত সাঁওতালদের  বাস। সাঁওতালদের পরেই এদেশে ভিল উপজাতির আধিক্য। গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, মহারাষ্ট্রে ভিল উপজাতির বসবাস।

পশ্চিমবঙ্গে আদিবাসীদের অবস্থা আজকের এই দিনটির পরিপ্রেক্ষিতে অবশেষে যে কথাটি বলতে হয় তা হল এই আমাদের সংবিধান যে ক্ষমতা যে অধিকার দিয়েছে সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য বিশেষ করে আদিবাসী সমাজের জন্য কিন্তু তাদের এই সুযোগ-সুবিধা তাদের এই অধিকার সুফল কতটা ভোগ করতে পারছে তা নিয়ে এখনো প্রশ্ন থেকে গিয়েছে স্বাধীনতা প্রাপ্তির ৭৫ বছর পরেও। দেখে দেখে অনুষ্ঠান আয়োজিত হচ্ছে সরকারিভাবে বেসরকারিভাবে আয়োজন হচ্ছে জাঁকজমকপূর্ণ করে এই দিনটি পালনের এটা যেমন একটা দিক। বলা যেতে পারে ভালো দিক। অপরদিকে আলাপ আলোচনা তর্ক-বিতর্ক চলতে পারে এখনো কি এই সমাজের আদিবাসীরা কতটা রাষ্ট্রের দ্বারা সুযোগ-সুবিধা পেয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে? এটা সবথেকে বড় প্রশ্ন। আবার এটাও সত্যি যে স্বাধীনতা প্রাপ্তির ৭৫ বছর পরে দেশ একজন আদিবাসী মহিলাকে রাষ্ট্রপতি রূপে পেয়েছে। পাশাপাশি আরও একটি সত্য এই যে আদিবাসী গ্রামগুলিতে গেলে দেখা যাবে অধিকাংশের এখনো আধার কার্ড ভোটার কার্ড রেশন কার্ড এমনকি এস সি এস টি কার্ড নেই। সেই গ্রামগুলিতে পানীয় জলের সমস্যা, স্কুল, স্বাস্থ্য কেন্দ্রের মতো এখনো সমস্যা রয়েছে ,অপ্রতুলতা রয়েছে। জল জঙ্গল জমি সমস্যা আজও রয়েছে।
উত্তরবঙ্গের চা বাগানসহ বনবস্তি এলাকায় যে সমস্ত আদিবাসীরা বসবাস করে তাদের ভাষাগত সমস্যার কারণে দক্ষতামূলক প্রশিক্ষণ না থাকার ফলে জীবন জীবিকার ক্ষেত্রে মস্ত বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি তারা।

পঞ্চায়েত, জেলা পরিষদ, বিধানসভা থেকে সংসদ
অর্থাৎ নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে যারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় রয়েছে তাদের আন্তরিকতার সঙ্গে বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করার বিষয় রয়েছে।

আরও যে কথাটি উল্লেখ করতে হয় তা হল,
বর্তমান সময়ে অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা, শিক্ষার অনগ্রসরতা, বেহাল যোগাযোগব্যবস্থা, অসচেতনতা, পেশাগত বৈচিত্র্যের অভাব, ভূমি হ্রাস, নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আদিবাসীদের পর্যাপ্ত অংশগ্রহণ না থাকা, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকারবিষয়ক জাতিসংঘ ঘোষণাপত্রের বাস্তবায়নের শ্লথগতি ইত্যাদি নানাবিধ কারণে আদিবাসীদের উন্নয়ন আশাব্যঞ্জক নয়। তাই তাদের উন্নয়নের জন্য রাষ্ট্র ও সরকারি-বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বিত আদিবাসীবান্ধব উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করা প্রয়োজন। এহেন অবস্থায় তাদের আর্থসামাজিক উন্নয়নকল্পে দক্ষতা বৃদ্ধিসহ আদিবাসী যুবসমাজের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা, বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করার সুযোগ প্রদান, স্থানীয় সরকারব্যবস্থায় আদিবাসী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতকরণ ইত্যাদি আশু প্রয়োজন।

উত্তরবঙ্গের আদিবাসীরা কেমন আছে? এই কথার উত্তর দিতে গিয়ে আজকের এই দিনটিতে বলতে হয়,আমাদের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর মানুষের বসবাস এই অঞ্চলে। আটটি জেলার বিভিন্ন প্রান্তে রয়েছে বিশেষ করে চা বাগান ও হিমালয় তরাই অঞ্চলে আদিবাসী সহ বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর বসবাস।
এদের একটা বড় অংশ নানান প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে চলেছে। এদের গ্রামাঞ্চলে গেলে দেখা যাবে সেই একই সমস্যা সরকারি সুবিধা অপ্রতুল একথা অস্বীকার করা উপায় নেই। বিষয়টি সরকারের নজরে জেনেই তা নয় বিষয়টা হল যারা সরকারি প্রতিনিধি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি তারা তাদের মত করে বিষয়টিকে দেখেন আবার যারা সরকারি আমরা তারা তৎপর হলেও তাদেরকেও নানান বাধ্যবাধকতার মধ্যে দিয়ে কাজ করতে হয়। সেই সঙ্গে দেখা গেল কিছু বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসছেন। যারা সাংবাদিকতা সূত্রে এই সমস্ত জনগোষ্ঠীর কাছাকাছি যেতে পারেন তারা আসল তথ্য চিত্রটা তুলে ধরার চেষ্টা করেন কিন্তু তাদেরকেও চাপ দেওয়া হয় এই সমস্যা তুলে না ধরার জন্য ‌। অনেক অনেক বহুবিধ প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে তাদেরকে আজও স্বাধীনতার ৭৫ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরে এই অবস্থার মধ্যে দিয়েও যেতে হচ্ছে।

আমরা যদি আজ থেকে প্রায় ৩৫-৪০ বছর পিছনে ফিরে তাকায় তাহলে দেখতে পাবো যে, বিশ্বের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা এবং তাদের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে সংরক্ষণ ও চর্চাকে অব্যাহত রাখতে রাষ্ট্রসংঘ ১৯৮২ সালে প্রথম আদিবাসীদের স্বীকৃতি দেয়। তারপর বিশ্বের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন সমস্যার সমাধান ও তাদের উন্নয়নে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য ‘জাতিসংঘ ও আদিবাসী জাতি এক নতুন অংশীদারত্ব’ শিরোনামে ১৯৯৩ সালকে ‘আন্তর্জাতিক বিশ্ব আদিবাসী জনগোষ্ঠী বর্ষ’ ঘোষণা করে।

আমরা এটাও জানি যে, আদিবাসীদের সার্বিক অবস্থার উন্নতির লক্ষ্যে রাষ্ট্রসংঘ ১৯৯৩ সালে ১৯৯৫-০৪ সাল পর্যন্ত সময়সীমাকে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দশক এবং ২০০৪ সালে ২০০৫-১৪ সাল পর্যন্ত সময়সীমাকে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক আদিবাসী দশক হিসেবে ঘোষণা করে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতোই আমাদের দেশেও সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারিভাবে উন্নয়ন ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর উদ্যোগে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উদযাপিত হয়ে আসছে। প্রকৃত উন্নয়ন যদি আনতেই হয় তাহলে সমাজের এই পিছিয়ে পড়া অংশকে আরো শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে হবে বিভিন্ন সরকারি সুযোগ-সুবিধা এই দুর্বল দুর্বল থেকে দুর্বলতার অংশ যাতে পায় সেদিকে নজর রাখতে হবে যাদের প্রয়োজন আছে তাদেরকে উত্থানের ক্ষেত্রে সরকারকে প্রয়োজনে নীতি পরিবর্তন করে এদের অগ্রগতির পথ প্রসারিত করতে হবে।

কিন্তু বাস্তব প্রেক্ষাপটে যদি আমরা তাকাই তাহলে আমরা কি দেখতে পাবো? বলিষ্ঠ চিন্তা ভাবনার অভাব, দেশ সমাজ, রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতার অভাব একটা দলীয় দাসত্বের শৃঙ্খলের মধ্যে দিয়ে চলেছে সমাজের একটা অংশ, যা মুক্তচিন্তা সার্বিক উন্নয়ন এবং সামগ্রিক অগ্রগতি পথ কোথাও না কোথাও আগলে রেখেছে বলে সামাজিক পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা। তাই দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতা আনার পাশাপাশি পরিবর্তন জরুরী।
৯ অগস্ট দিনটি আদিবাসীদের উৎসর্গ করা হয়েছে। দিনটিতে আদিবাসীদের অধিকার রক্ষার সঙ্কল্প নেওয়া হয়। এই সংকল্পকে আরো সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে সকলকে নিয়োজিত হতে হবে। তাহলেই আদিবাসী দিবস পালনের সার্থকতা লাভ করবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *