লেখক পঙ্কজ সেন
১৯২০ সালের ২ই ডিসেম্বর জলপাইগুড়ি বৈকুন্ঠপুর রাজপরিবারের সদস্য জগদিন্দ্রদেব রায়কতের প্রচেষ্টায় রাজবাড়ীর ক্যানিপি হলে রাজমাতা অমৃতেশ্বরী দেবীর নামে “অমৃতেশ্বরী এম.ই.স্কুল” নামের একটি বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন, যার প্রথম প্রধান শিক্ষক ছিলেন রাজপরিবারের সদস্য ক্ষীরোদেন্দ্রদেব রায়কত। এর ছয় মাস পরে বিদ্যালয়টির নতুন প্রধান শিক্ষক পদে নিযুক্ত হন শহরের ডাঙ্গাপাড়া নিবাসী তরণী মোহন চক্রবর্তী। এই সময় জলপাইগুড়ি রাজবাড়ির আর্থিক অবস্থা অনুকূল না থাকায় রাজা প্রসন্নদেব রায়কত আর বিদ্যালয়টির ব্যয়ভার বহন করতে রাজি হলেন না। এমতাবস্থায় প্রধান শিক্ষক তরণীবাবু হাজির হলেন তৎকালীন জলপাইগুড়ি শহরের বেগুনটারি এলাকায় বসবাসরত খ্যাতিমান, ধনাঢ্য, দানবীর মুসলমান মুন্সী মহম্মদ সোনাউল্লার কাছে। উল্লেখ্য মহম্মদ সোনাউল্লার পূর্বপুরুষেরা জলপাইগুড়ি শহর সংলগ্ন পাহাড়পুরে বসবাস করতেন। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি ধান ও পাটের ব্যবসার সুবিধার জন্য বেগুনটারির সন্নিকটে বাড়ি করেন।
মুন্সি মহম্মদ সোনাউল্লা নিজে পুঁথিগত শিক্ষায় শিক্ষিত না হলেও তরণী বাবুর এই অভিনব উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা এবং দেশীয় ছাত্রদের মঙ্গলের কথা ভেবে প্রস্তাবটি গ্রহণ করেন। নবগঠিত বিদ্যালয়টির সুপরিচালনা ও প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি ৫ হাজার টাকা এবং ৭ বিঘা জমি ও সেইসঙ্গে মুসাফিরখানায় (সোনাউল্লা সাহেব মুসাফিরদের থাকা ও খাওয়ার জন্য এই মুসাফিরখানা গড়ে তুলেছিলেন) থাকা তার অব্যবহৃত দালানটি ব্যবহারের অনুমতি দিলেন। ১৯২১ সালের ১লা জুলাই, জুম্মাবারে (শুক্রবার) গনেশ চন্দ্র সান্যালের উপস্থিতিতে যে বিদ্যালয়টির পথচলা শুরু হয়, তার নাম রাখা হল “সোনাউল্লা (মিডল ইংলিশ) ইনস্টিটিউশন”। তিনি আমৃত্যু এই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও সভাপতি ছিলেন। দানবীর সোনাউল্লা শুধু নব প্রতিষ্ঠিত সোনাউল্লা ইনস্টিটিউশনের জন্য ভূমি ও অর্থ প্রদান করেছিলেন তা কিন্তু নয় তিনি পরবর্তীতে বহুবার বিভিন্ন সময়ে এই প্রতিষ্ঠানকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য অর্থ সহযোগিতা করে গিয়েছিলেন। শোনা যায়, ঈদের সময় সোনাউল্লা সাহেব এই বিদ্যালয়ের সেরা ছাত্রদের মাধ্যমে ঈদের দান প্রদান করতেন। তার দান নিতে রংপুর, দিনাজপুর, পাবনা, পূর্ণিয়া থেকে গরিব লোক আসত। তিনি কাউকেও বঞ্চিত করতেন না। ১৯২৯ সালে বিদ্যালয়টিতে মেট্রিকুলেশন চালু হয়। ১৯৩৪ সালের এপ্রিল মাসে (তারিখ জানা যায়নি) আচমকা মহম্মদ সোনাউল্লার মৃত্যু হলে বিদ্যালয়টির পরবর্তী পরিচালক সমিতির সভাপতি মনোনীত হন নবাব মোশারফ হোসেন, খান বাহাদুর। তবে এই বিদ্যালয় গঠনে বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় প্রধান শিক্ষক এবং প্রকৃতপক্ষে কর্ণধার তরুনী বাবুর অবদান অনস্বীকার্য।

জনমানষে একটা প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণা গড়ে উঠেছিল যে, দানবীর দেশপ্রেমিক মহম্মদ সোনাউল্লা সাহেব নিরক্ষর ছিলেন। সোনাউল্লা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের হীরক জয়ন্তী অনুষ্ঠানের প্রাক্কালে এই বিষয়ে একটা বিতর্ক দেখা দেয়। যা শেষ পর্যন্ত বিদ্যালয়ের স্টাফ কর্মী দলের সভা পর্যন্ত গড়ায়। তৎকালীন প্রধান শিক্ষক বীরেন্দ্রনাথ মিত্র এবং বিদ্যালয়ের সহ-শিক্ষক উমেশ শর্মা এই সমস্যার আশু সমাধানের জন্য সোনাউল্লা সাহেবের পুত্র মজনু’র কাছ থেকে একটা পুরনো দলিল সংগ্রহ করে সোনাউল্লা সাহেবের স্বাক্ষর সংগ্রহ করেন। এই স্বাক্ষর পরবর্তীতে বিদ্যালয়ের হীরক জয়ন্তী স্মারক পত্রিকায় ছাপা হয়। সোনাউল্লা সাহেব উচ্চশিক্ষিত না হলেও তার বিদ্যানুরাগ অত্যন্ত প্রবল ছিল।
যাই হোক, এই বিদ্যালয় থেকেই অতীতে পথচলা শুরু হয়েছে জলপাইগুড়ি সেন্ট্রাল উচ্চমাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় এবং জলপাইগুড়ি আনন্দ চন্দ্র কলেজ অফ কমার্সের। এই দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেরই প্রথম ক্লাস শুরু হয় এই বিদ্যালয় ভবন থেকেই। আশির দশকে এই বিদ্যালয় থেকেই শুভারম্ভ হয় জলপাইগুড়ি আইন কলেজের। সোনাউল্লা বিদ্যালয়ের পাঠাগার নির্মাণে দুই লক্ষ টাকা প্রদান করেন প্রয়াত কৃষ্ণ কুমার কল্যাণী তার পিতা সীতারাম কল্যাণীর স্মৃতিতে। বিদ্যালয়ের শিক্ষা প্রসারে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলেন প্রকৃত শিক্ষাপ্রেমী শিক্ষক নারায়ণ চন্দ্র দাস ও কৃষ্ণেন্দু বাবু। শিক্ষার প্রসারের লক্ষ্যে স্বর্গীয় নারায়ণ বাবু দান করে গিয়েছেন বিদ্যালয়ের জমি। শতবর্ষ স্পর্শ করা এই বিদ্যালয় ভবনকে হেরিটেজ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। এই বিদ্যালয়ের বহু কৃতি ছাত্রের মধ্যে পরিচিত হল প্রাক্তন সাংসদ দেবপ্রসাদ রায় এবং চিকিৎসক আনোয়ার আলী মল্লিক। ১৯৯৭ সালের ১৫ই এপ্রিল বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র তথা প্রাক্তন সাংসদ দেবপ্রসাদ প্রসাদ রায়ের উদ্যোগে “আইকার্ড” নামক একটি সর্বভারতীয় সংস্থা মুন্সী মহম্মদ সোনাউল্লার একটি আবক্ষ মূর্তি বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে স্থাপন করে। যার আবরণ উন্মোচন করেন সিকিমের রাজ্যপাল চৌধুরী রণবীর সিং। বিদ্যালয়ের মানোন্নয়নে এবং খেলাধুলায় পূর্ব অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক বানেশ্বর শীলের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। সাদা জামা, নেভি ব্লু প্যান্ট আর জামার পকেটে লাগানো জ্বলন্ত প্রদীপ যুক্ত লোগো হলো এই বিদ্যালয় তথা তার ছাত্রদের পরিচয় ও অহংকার। অনেক ইতিহাসের সাক্ষী এই বিদ্যালয়।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার : উমেশ শর্মা, ছবি লেখক