সর্পগন্ধা নদীর সেতু (ভুটানি লোককথা)

পিনাকী রঞ্জন পাল

কয়েক শ’ বছর পূর্বে ভুটানে এক ভাস্কর ছিলেন। তাঁর নাম ছিল আদিত্য। তাঁর তৈরি প্রতিমাগুলি জীবন্ত বলে মনে হত, যেন এখনই কথা বলে উঠবে। আদিত্য ভীষণ আত্মাভিমানী ছিলেন। তাই তাঁর সম্পূর্ণ জীবন কষ্টের মধ্যে কেটেছিল। তাঁর কাছে কোন ধনসম্পদ ছিল না। মৃত্যুশয্যায় তিনি তাঁর স্ত্রীকে বলেন, ভাল সন্তানের চেয়ে বড় সম্পদ আর কিছুই নেই। এইজন্য আমাদের দুই সন্তানকে তুমি অনেক পড়াবে…। এ কথা বলেই আদিত্যের মৃত্যু হয়।

শিল্পী স্বামীর মৃত্যুর পরে স্ত্রী দুই সন্তানকে আশ্রমে পাঠিয়ে ভাল শিক্ষা দেন। এর পর মা’র আশীর্বাদ নিয়ে দুই ভাই-বোন কর্মকেতু আর মঞ্জুমায়া বিদেশ ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ে।

দুই ভাই-বোন তিন মাস পরে প্রভামেরু রাজ্যের সীমানায় গিয়ে উপস্থিত হয়। সেখান থেকে তারা রঙ্গপুরম নগরের উদ্দেশে যাত্রা করে। রঙ্গপুরম নগরের সব বাড়িগুলি উজ্জ্বল পাথর দিয়ে তৈরি ছিল। একটা বিরাট চকচকে পাথর নগরের মাঝখানে একটি টিলার ওপর রাখা ছিল। পাথরটি তারার মত জ্বলজ্বল করত। নগরে অনেক ছোট ছোট ঝিল ছিল, সেগুলি নগরের সৌন্দর্য বহু গুণে বৃদ্ধি করেছিল। নগরে প্রচুর ফুল আর ফলের বাগান ছিল।

নগরকে দুই ভাগে বিভক্ত করে বয়ে গেছে সর্পগন্ধা নদী। এই নদী সুগভীর, ভয়াবহ। আর জল ছিল কালো। নদীর পাড়ে খুব ভিড় জমা হয়েছিল। কয়েকজন যাত্রী শাক-সবজি, শুকনো ফল (কিসমিস, বাদাম ইত্যাদি), কাপড়, মধু ইত্যাদি জিনিস নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। কয়েকজন মহিলা মন্দির যাবার জন্য ব্যাকুলভাবে প্রতীক্ষা করছিল।

নৌকা কিনারে আসতেই সবাই তাতে ওঠার জন্য হুড়োহুড়ি করতে লাগল। কর্মকেতু এক বৃদ্ধ যাত্রীকে জিজ্ঞেস করল, ‘নদী পার হতে তো ভীষণ কষ্ট করতে হয়। আপনাদের রাজা সেতু কেন বানিয়ে দেন না? যাত্রী উত্তর দিল, ‘নদীটি ভীষণ বিস্তৃত আর গভীরতাও অনেক। এইজন্য সেতু বানাবার সব চেষ্টা অসফল হয়ে গেছে।”

কর্মকেতু আর মঞ্জুমায়া সিদ্ধান্ত নিল যে, তারাই সেতু বানাবে। এই সংবাদে সমস্ত রঙ্গপুরমে খুশির জোয়ার বয়ে গেল। শিল্পী আদিত্যের খ্যাতি এখানেও ছিল, তাঁরই ছেলে মেয়ের এই প্রতিজ্ঞা খুব প্রশংসা পেল। এরই মধ্যে লোকেরা কর্মকেতুর গুণের প্রশংসা করছিল, আর মেয়ে বলে মঞ্জুমায়ার কপালে প্রংশসার ছিটেফোঁটাও জুটছিল না। ব্যাপারটা মঞ্জুর একদম ভাল লাগছিল না। শেষে ক্ষুব্ধ মঞ্জু স্বয়ং একটি আলাদা করে সুন্দর আর মজবুত সেতু তৈরি সিদ্ধান্ত নেয়।

ভাই-বোনের মধ্যে শর্ত হল, যে একরাতের ভেতর সেতু তৈরি করে দেবে সেই বিজয়ী হবে। সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত সময় নির্ধারণ করা হয়। এটাও স্থির হয়, যার তৈরি সেতু ভাল হবে না সে পরাজয় মেনে নেবে।

মঞ্জুমায়া নদীর পশ্চিম দিকে সেতু তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়ে শীঘ্রই কাঠ, পাথর ইত্যাদি সংগ্রহ করে সেতু তৈরি করে ফেলে। কিন্তু তখনও অর্ধেক রাত বাকি ছিল। সেতুর সৌন্দর্য দেখে মঞ্জুর মন নেচে ওঠে। ও ভাইয়ের সেতু দেখে আসার কথা চিন্তা করল, কিন্তু একি ! কর্মকেতুর সেতুর তো কোন চিহ্নই সেখানে নেই। কিছু দূরে সাদা মার্বেল পাথর আনতে ও ভাইকে দেখল। মার্বেল পাথরগুলি হীরার মত চকচক করছিল। মঞ্জু ভাবল, এই সেতু তো খুব শক্ত আর সুন্দর হবে। এই চিন্তা করে ও নিজের সেতুর কাছে চলে এল। এর পর ও নিজের সেতুকে বিভিন্ন ধরনের, লতান গাছপালা দিয়ে সাজাতে শুরু করল।

সাজাবার মত কোন জায়গা না থাকায় ও কাজ শেষ ভেবে আবার কর্মকেতুর সেতু দেখতে রওনা হল। নিজের ভাইয়ের তৈরি সেতু দেখে ওর মাথায় বদ বুদ্ধি উপস্থিত হল। ও মোরগের ডাক নকল করে শব্দ করল, সেই শব্দ শুনে নগরের সব মোরগ ভাবল যে, সকাল হয়ে গেছে। তাই তারাও ডেকে উঠল। কর্মকেতু মোরগের ডাক শুনে ঘাবড়ে যায়। ও তাড়াতাড়ি মার্বেল পাথরের খিলান শেষ করে আর কোনমতে তড়িঘড়ি করে সেতুর কাজ সম্পূর্ণ করল।

নগরের লোকেরা সকালে নদীতে দু’খানি সুন্দর সেতু দেখে আনন্দে নেচে ওঠে। কর্মকেতুর সেতু বড় পাথরের তৈরি ছিল। তাই তাকে বড় সেতু আর মঞ্জুমায়ার সেতু ছোট পাথরের তৈরি ছিল বলে ছোট সেতু নামে পরিচিত হয়। কিন্তু জয়-পরাজয়ের কোন মীমাংসা করা যায়নি। রাজ্যময় সেতু দু’টির প্রশংসা হতে লাগল। এই সংবাদ মকূর নামের দৈত্যের কানে পৌঁছাল। সে সেতু দু’টিকে ভেঙে দেওয়ার মনস্থির করল। প্রথমে ও বড় সেতুটি ভাঙবে বলে ঠিক করল এবং বণিকের ছদ্মবেশে নিজের ঘোড়ার পিঠে দু’টি থলিতে চাঁদ আর সূর্যকে ভরল। এর পর একটি বড় গাড়িতে সোনা-রুপোর বড় বড় খণ্ড রেখে বন্ধু অরাকে সঙ্গে করে সেতুর পাশে পৌঁছে গেল।

সেতুর কাছে পৌঁছে মকূর চিৎকার করে বলল, ‘এই দুর্বল সেতু কে বানিয়েছে ?” কর্মকেতু বুক ফুলিয়ে বলল, ‘একটা ঘোড়া আর গাড়ির ভারে এই সেতু ভাঙবে না। এটা খুব মজবুত সেতু।

ঘোড়ায় চড়ে মকূর আর গাড়িতে বসে অরা সেতু পার হতে থাকে। কিছু দূর এগোতেই সেতু কাঁপতে শুরু করে। কর্মকেতুর মনে পড়ে বাবার কথা। ওর বাবা বলেছিল, ‘শিল্পীর হাত এই পৃথিবীর সবচেয়ে মজবুত হাত। সে কখনও পরাজিত হয় না।’ কর্মকেতু শীঘ্রই সেতুকে হাত ঠেকিয়ে ধরে রাখে। দেখতে দেখতে মকূর আর অরা সেতু পার হয়ে যায়। কিন্তু সেতুর কিছুই হয় না। লজ্জায় পরাজিত মকূর বন্ধুকে নিয়ে পালিয়ে যায়।

আজও রঙ্গপুরমের কাছে সর্পগন্ধা নদীর কিনারে বহু পুরনো মার্বেল পাথরের সেতু নিজের কাহিনী জানাতে নিশ্চলভাবে দাঁড়িয়ে আছে। সেতুর ওপরে ঘোড়ার খুরের ছাপ আর নিচে মানুষের দুই হাতের ছাপ আজও অবিকৃত আছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *