লেখক দীপক রায়
(১)
উপরে ওঠার লোহার সিঁড়িটা বেয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে দৌড়ে উঠছিল বিকাশ। কিন্তু পা দুটো তার যেন ক্রমশ অবশ হয়ে আসছে মনে হচ্ছে। দৌড়ানোর শক্তি ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। হোঁচট খেতে খেতে দারুন আতঙ্কে বার বার পড়ে যেতে গিয়েও কোনরকমে সামলে নিয়ে আবার দৌড়চ্ছে সে। চেতনা হারাবার উপক্রম হয়েছে। কিন্তু এখন এখানে কিছুতেই চেতনা হারালে চলবে না সে জানে। আর যাই হোক এখানে থেমে পড়লে তার সাক্ষাৎ মৃত্যু। পিছনে মৃত্যু যেন মূর্তিমান হয়ে ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে অপেক্ষা করছে। বিকাশ আচমকা ভীষণ ভয় পেয়েছে। এখান থেকে যত তাড়াতাড়ি পালানো যায় ততই মঙ্গল। দৌড়াতে গিয়ে অনেক উঁচু নিচু জায়গায় সে আঘাত পাচ্ছে পায়ে। এই মুহূর্তে সেদিকে তার হুঁশ নেই। ভীষণ ভয়ে ক্রমশ বাহ্যিক চেতনা হারিয়ে আসছে তার। সিঁড়ি দিয়ে ধড়মড় করে উপরে উঠতে লাগলো। পা দুটো ক্রমশ অবশ হয়ে আসছে, শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে যাচ্ছে, শরীরের লোমগুলো দাঁড়িয়ে পড়েছে। কোন রকমে যদি দুটো ফ্লোর এভাবে উঠে আসতে পারে, তাহলেই বেঁচে যায়। উপরে বোসন ডিউটিতে আছে এখন। দেখা হলে এ যাত্রা বেঁচে যাবে। সিঁড়ির ধাপে পা হড়কে যাচ্ছে বার বার। কোন রকমে উপরে এসেই বোসনকে দেখতে পেল বিকাশ। ওকে চিৎকার করে ডাকতে গিয়েও গলার স্বর বেরলনা। বোবার মতন গোঙাতে লাগল। মুখোমুখি হবার পরেই জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল ।
আরেকজন ওয়াচ কিপার এবি দৌড়ে এল বিকাশের এই অবস্থা দেখে। দুজনে মিলে ধরাধরি করে ডেকের উপর একটা পরিস্কার জায়গায় শুইয়ে দিল তাকে। বোসানকে বেশ উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে, অন্য এবিটাও হাঁ করে তাকিয়ে আছে। এত রাতে ডিউটি অফিসারের এমন অকস্মাৎ কিছু দেখে ভয় পেয়ে অজ্ঞান হয়ে যাওয়াতে ঘাবড়ে গেছে দুজনেই। কিছুই বুঝতে পারছে না। বোসান চোখে মুখে জলের ছেটা দিতে লাগল। এবি মাথায় হাওয়া দিতে লাগল সমানে। অসহ্য গুমোট গরম পড়েছে আজ পোর্ট ব্লেয়ারে। বন্দরের আবহাওয়া যেন আগুন ঝরাচ্ছে চারিদিকে। নিঝুম রাতের নিস্তব্ধতা চারিদিকে। জাহাজের বাইরেও যেন জমাট অন্ধকার শিকারীর মতন ঘাপটি মেরে বসে আছে। কাছের পাহাড়টায় রাতচরা পাখিরা হঠাৎ হঠাৎ চমকে চমকে উঠছে রাতের স্তব্ধতাকে ভেঙ্গে। বোসান ওয়ালিউল্লাহ আর এবি করিম বিকাশকে ধরাধরি করে এনে ওর কেবিনে শুইয়ে দিল।
(২)
রাত বারোটা-চারটের ডিউটিতে এসেই বিকাশ বাঙ্ক-ক্লাসে ফায়ার পেট্রোল রাউন্ড নিতে গেছিল আজ। ক্যাম্পবেল বে পোর্ট- টাতে যাত্রীরা সবাই নামতে নামতে রাত হয়ে গেছিল অনেক। কেবিন আর বাঙ্ক ক্লাস আজ একদম খালি। জাহাজ আবার পোর্ট ব্লেয়ারের দিকে রাতেই রওনা হয়ে গেছিল। সাফাই কর্মীরা সাফ-সাফাইয়ের কাজ করে ফেলেছে এর মধ্যে। হাতে বেশি সময় নেই। মাঝরাতের মধ্যেই রাউণ্ডটা সেরে ফেলতে হবে। কারন আগামীকাল জাহাজ ভেড়বার পরে সকাল থেকেই আবার যাত্রী বোঝাই শুরু হবে পরের ভয়েজের জন্য।
মাত্র এক সপ্তাহ হয়েছে বিকাশ এই জাহাজে এসেছে। বোসান আর একটা এবি রাতের ডিউটিতে ডে’কে আর গ্যাংওয়েতে টহল দিচ্ছিল। বিকাশের সাথে ওদের দেখা হয়নি তখনও। ফায়ার রাউণ্ড সেরে এসে না হয় বোসানের সাথে একবার এসে দেখা করবে, এসব ভাবতে ভাবতে সিঁড়ি বেয়ে দুটো ডে’ক পেরিয়ে একেবারে নিচে নেমে এল জলের লেভেলের নিচে থাকা জাহাজের পেটের কাছে। বাঙ্ক-ক্লাসের ডর্মিটরির ঘর গুলো যেখানে শুরু হচ্ছে তার সামনের বড় দরজাটা ঠেলে ঢুকল একা। যদিও বোসান বলে দিয়েছিল এই ঘরে রাউণ্ড নিতে যাবার সময় অবশ্যই কারোকে সঙ্গে নিয়ে যেতে। কিন্তু এত রাতে ওরা ওদের কাজ ফেলে বিকাশের সাথে আসুক এটা সে চায়নি। মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যাপার । তাই ও ডাকেনি কারোকে । যাত্রীরা সকলে নেমে যাবার পর এই হল ঘরটাকে একটা শূন্য নিশ্চুপ পুরীর মতন মনে হয়। এত রাতে যেন চারিদিক খাঁ খাঁ করছে। ভিতরের নীলচে আলোর আবছায়া ভাব সাদা ধবধবে বেড গুলোতে পড়ে একটা শ্মশানের নিস্তব্ধতা তৈরি হয়েছে। ঘরে ঢুকেই এদিক ওদিক দেখতে দেখতে চলল বিকাশ। বিশাল হলঘরটা জুড়ে সাজানো সারি সারি বাঙ্ক। বাঙ্ক গুলোর মধ্যে দিয়ে চলার রাস্তা। হাতের টর্চটা জ্বালিয়ে বিকাশ প্রতিটা দেয়াল, মেঝে আর বিছানার চারিধার দেখতে দেখতে চলেছে আবছায়া মিটমিটে আলোর মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে।
কিছু আগেই যে যাত্রীদের ভিড় আর হই-হট্টগোলে মুখরিত ছিল এই ঘরটা , আজ যেন এক নিঝুম পুরী। নির্জন, নিস্তব্ধ নিশীথের যত রহস্য আছে , এই রাতে যেন সব ভিড় করে বসে আছে এই বাঙ্ক-ক্লাসে। চলতে চলতে হলটার প্রায় মাঝামাঝি এসে পড়েছে বিকাশ। হঠাৎ ওর মনে হল বাঁ দিকের শেষে পোর্ট- হোলের কাছাকাছির একটা বিছানার কাছ থেকে কচর কচর করে একটা আওয়াজ আসছে। কেউ কিছু চিবোলে যে রকমের আওয়াজ হয়, ঠিক সেরকম। সেদিকে চোখ ফেরাতেই বিকাশের সমস্ত শরীর হিম হয়ে গেল। কি ভয়ানক দৃশ্য। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে, আলু-থালু চুলের এক আদিবাসী মহিলা, বুকের কাছে একটা বাচ্চাকে আঁকড়ে ধরে বসে আছে আর তার বুকে মুখ ডুবিয়ে রক্ত খাচ্ছে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না সে। হতভম্ব হয়ে গিয়ে ভালভাবে দেখার জন্য সেদিকে আরেকটু এগিয়ে যায় টর্চ জ্বালিয়ে। মনে ভাবে, কি কোন যাত্রী ভুলক্রমে বাঙ্কে থেকে গেছে এখনও? টর্চের আলো ফেলতেই সেই এলোচুল মহিলা তার বীভৎস রক্ত মাখা দাঁত-মুখ নিয়ে ফিরে তাকাল, চোখ দিয়ে তার আগুন ঝরছে যেন । ঝুঁকে পড়া শরীরে কোলের মধ্যে মৃত দুধের শিশু নিথর হয়ে রয়েছে, রক্তাক্ত বুক আর মাথা নিয়ে। এই দৃশ্য দেখে সারা শরীর অবশ হয়ে এল বিকাশের। চলবার শক্তি আচমকাই উধাও হয়ে গেছে তার। ওখানে দাঁড়িয়ে এই হাড় হিম করা দৃশ্য দেখে মনে হল ওর পা দুটো কেউ আষ্টেপৃষ্ঠে মাটির সাথে বেঁধে রেখেছে । একটুও শক্তি নেই চলবার। বিস্ফারিত চোখে দেখতে পাচ্ছে দুধের শিশুটাকে বুকে নিয়ে সেই পিশাচী ওর দিকেই ক্রমশ এগিয়ে আসছে। বিভীষিকাময় রক্তলোলুপ তার চাহনি । পিঠ বেয়ে একটা হিমশীতল স্রোত বয়ে যাচ্ছে বিকাশের। অথচ শরীর ঘামছে দরদর করে। এমন নিশীথ রাতে এমন একটা ভয়ানক দৃশ্য তাকে দেখতে হবে তা স্বপ্নেও ভাবেনি সে। বোসনের কথা না শুনে যে কি ভুল করেছে সে এখন বুঝতে পারছে। হঠাৎ করেই বিকাশ সম্বিত ফিরে পেল। সাক্ষাৎ মৃত্যু থেকে বাঁচতে হলে এক্ষুনি তাকে এই ঘর ছেড়ে পালাতে হবে, তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠল তৎক্ষণাৎ। সব শক্তি একত্রিত করে দৌড়াতে গেল। কিন্তু দড়াম করে লোহার মেঝের উপর পড়ে গেল। দেখল সেই মহিলা অনেকটাই এগিয়ে এসেছে। চোখ দিয়ে তার যেন মারাত্মক প্রতিহিংসার আগুন ঝরছে। বিকাশ পায়ের চোট নিয়েই আবার দৌড়ে ঘরটার দরজার কাছে এসে পড়ল । দরজা পেরিয়ে সিঁড়ির দিকে দৌড়াতে লাগল সে। পিছনের ছায়া মূর্তি মনে হল ক্রমশ এগিয়ে আসছে ওকে ধরতে।
(৩)
জ্ঞানটা ফিরে আসার পর বিকাশ দেখতে পেল মাথার কাছে ওয়ালিউল্লাহ আর করিম চিন্তিত মুখ নিয়ে বসে আছে। মুখে চোখে ভয়ার্ত ভাব। পায়ে অসম্ভব যন্ত্রণা হচ্ছে বিকাশের। বোসন ওর দিকে ঝুঁকে পড়ে বয়লার স্যুটের পায়ের দিকটা গুঁটিয়ে নিয়ে দেখল অনেক আঘাতের চিহ্ন। জায়গায় জায়গায় কালশিরে পড়ে গেছে সিঁড়ি দিয়ে উপরে ওঠার সময়। দেখে করিমকে বলল – ‘’ ফ্রিজ রুম থেকে বরফ নিয়ে আয়, দুটো পায়েই বহু জায়গায় চোট লেগেছে, ওর পায়ের চোট গুলোতে লাগাতে হবে।। ” করিম তৎক্ষণাৎ ছুটল বরফ আনতে। এদিকে বিকাশ স্বপ্নের ঘোড়ে প্রলাপ বকতে শুরু করেছে। মাঝে মাঝে বিস্ফারিত চোখ করে ব বোসানের দিকে তাকিয়ে বলে উঠছে – “ ওই রাক্ষসি মেয়েটা ধরতে আসছে আমায়, আমাকে শেষ করে ফেলবে , বাচ্চাটাকে মেরে ফেলল, ওকে তোমরা বাঁচাও ওর হাত থেকে। ’’ বোসান বিকাশকে ধরে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে। ওর গা একেবারে পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। বিকাশের মাথায় জল পট্টি দিয়ে হাওয়া করতে থাকে সে। একটু ভাল লাগায় চোখ মেলে বোসন কে বলে – ‘’তুমি অনেকবার বারন করেছিলে ওয়ালি ভাই, বাঙ্ক ক্লাসের হল ঘড়টায় যেন আমি একা না যাই রাতের বেলা। কিন্তু ভাবলাম এত রাতে কাকে আর ডাকব, এই ছোট্ট একটা কয়েক মিনিটের রাউনণ্ড নেওয়ার জন্য গ্যাওয়ে ডিউটি থেকে তোমাদের কারোকে ডেকে আনতে মন চাইছিল না। “
বোসন জল পট্টি দিতে দিতে বিকাশের কথা শুনে বেশ রাগত স্বরে বলল – “ তোমার কিছু হয়ে গেলে আমাদের অবস্থা সঙ্গিন করে ছেড়ে দিত কোম্পানি , ইতিমধ্যে ওই ঘর একবার সীল করা হয়েছিল।” কথাটা শুনে কৌতূহলী চোখে বিকাশ বোসনের দিকে তাকায়। করিম ততক্ষনে বরফ এনে ওর পায়ের আঘাত লাগা জায়গা গুলোতে বুলিয়ে দিচ্ছে। বোসান কথা ঘোরাবার জন্য বিকাশকে বলল – “ যাই বল, তুমি এত রাতে আমাদের কারোকে না নিয়ে একা ওই বাঙ্ক ক্লাসের ঘরে যাবে এটা আমরা ভাবতেই পারিনি। যেখানে আমরা নিজেরাই একা যাইনা ,তুমি তো সবে নতুন জয়েন করেছ কাজে। আমি তোমাকে বারন করেছিলাম যেতে , তুমি আমার কথাটা না শুনে ওখানে গিয়ে খুব ভুল করেছ সাহেব। খুব জোর বেঁচে গেছ , এজন্য আল্লাকে লাখ লাখ সুকৃয়া। যাইহোক , তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে নাও। এখন ঘুমিয়ে নাও বেশ কিছুক্ষন। আমি এখানেই তোমার কাছে বসে আছি। ভোর হলেই কাপ্তান সাহেবকে বলতে হবে তোমার ঘটনাটা। ”
বিকাশের যন্ত্রণাটা কমেছে মনে হচ্ছে কিছুটা । এইমাত্র করিম ওকে জ্বর আর ব্যথার ওষুধ খাইয়েছে। জ্বরটাও কমে আসায় অসম্ভব ক্লান্ত লাগছে এখন। কিছুক্ষনের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল সে। বোসান ওয়ালিউল্লা সারারাত বিকাশের মাথার কাছে বসে রইল ভোর হওয়ার অপেক্ষায়। বাইরে চাঁদের আলো তখন ফিকে হয়ে এসেছে। হঠাৎ করে ডানা ঝটপটিয়ে একটা মেগাপড পাখি মনে হল বন্দরের পাশের সমুদ্রের ধারের ওর একটা ঢিবির বাসা থেকে ধারের পাম গাছের মাথায় গিয়ে বসল।
(৪)
পরদিন ভোর হতেই দূরের স্যাডল পিকের মাথার উপর থেকে সূর্য উঠতে দেখা গেল। সূর্য ওঠার সাথে সাথে পৃথিবীটাকে আবার পরিচিত বলেই মনে হতে থাকে বিকাশের। মনে হল রাতের সমস্ত অভিজ্ঞতাই যেন স্বপ্ন। ভোরের আলো ফোটার পর থেকে বিকাশ একটু সুস্থ বোধ করছে । কিন্তু গত রাতের বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতা ওকে এখনও তাড়িয়ে বেরাচ্ছে। যতবারই কালকের রাতটার কথা মনে পড়ছে , সেই ভয়ানক দৃশ্যটা আর সেই ভয়াবহ মুখটার কথা মনে পড়ে গিয়ে বড্ড দুর্বল লাগছে শরীরটা । পায়ের ব্যাথাটা চাগিয়ে উঠছে আবার। বোসান সারারাত না ঘুমিয়ে ওকে পাহারা দিয়েছে। রাতের বেলা বিকাশ কি দেখেছিল সেটা যতবারই ওকে বলতে গেছে, বোসান ততবারই থামিয়ে দিয়ে বলেছে, “আমি জানি সব, বললাম তো পরে সব শুনব , আগে সুস্থ হয়ে নাও। তোমাকে যে একা একা রাতে ফায়ার ওয়াচে বাঙ্ক ক্লাসের হলে যেতে মানা করেছিলাম, তার কারনই হল সেটা। আমি সব ঘটনা জানি বলেই তোমাকে বারন করেছিলাম সাহেব।”
এই সেকেন্ড অফিসার বিকাশ যাদবের বাড়ি আগ্রায়। এই জাহাজে মাত্র সাত দিন হল কাজে যোগ দিয়েছে। জাহাজের নাম “ক্যাম্পবেল বে” । শিপিং কর্পোরেশনের যে চার-পাঁচটা যাত্রী জাহাজ আন্দামান নিকোবরের ছোট ছোট দ্বীপগুলোতে যাতায়াত করে, তার মধ্যে দক্ষিন আন্দামান বা পোর্ট ব্লেয়ার এদের প্রধান বন্দর। এই পোর্ট ব্লেয়ারেই অনেক যাত্রী হয় প্রতিদিন। তারপর আন্দামানের দক্ষিনের আর্কিপেলাগোর পাঁচ-পাঁচটা বন্দর প্রদক্ষিন করে আসে এই জাহাজ। প্রতিটা বন্দরে চলতে থাকে যাত্রীদের ওঠানামা। বিকাশের কাছে আন্দামান-নিকোবর অঞ্চলে জাহাজে যোগদান এই প্রথম। অসীম সমুদ্রের মাঝে বড় বড় মালবাহী জাহাজ নিয়ে অনন্তকাল কাল ধরে দীর্ঘ সমুদ্র যাত্রাই ছিল এতদিনের পেশা। আন্দামান-নিকোবরের ছোট ছোট দ্বীপে ঘুরেঘুরে উত্তাল ঢেউ এর মাঝে জাহাজ চালানর নেশায় সে এখানে এসেছে। ব্রিটিশদের তৈরি বন্দিনিবাস, ব্যারেন আইল্যান্ড ও নর-কোন্ডার নির্বাপিত আগ্নেয়গিরি, দৈত্যাকার সবুজ কচ্ছপ, হিংস্র জারোয়া, সেন্টিনেলিজ,ওঙ্গি আদিবাসীদের নিয়ে অনেক রোমাঞ্চকর কাহিনী সে পড়েছে নানান বইয়ে। তাই এই “সবুজ-নরক” দেখার অদম্য আকর্ষণ উপেক্ষা করতে না পেরে যাত্রীবাহী ‘ক্যাম্পবেল বে’ জাহাজে চাকরি নিয়ে চলে এসেছে। রস আইল্যান্ড, নীল আইল্যান্ড, হ্যাভলক, স্ট্রেটস আইল্যান্ড ,করবিন কোভস , কার নিকোবর এগুলোর দুর্নিবার আকর্ষণ অনুভব করত মনে মনে। এই জাহাজের উপরের দিকের ডেক গুলোতে বেশ কিছু কেবিন আছে , যেগুলোর ভাড়া বেশি। সাধারনত স্বচ্ছল লোকেরাই এগুলো ভাড়া করে। নিচের এই বাঙ্কে কম খরচায় স্থানীয় চাষি, জেলের দল আর কিছু আদিবাসি ওঙ্গি, অথবা সেন্টিনেলিজরা যাতায়াত করে। মাঝে মধ্যে কিছু অসুস্থ সভ্য-জারোয়াকে সরকারি দেহরক্ষী বা ওদের তত্তাবধায়ক দল সমেত দেখা যায় যারা চিকিৎসার জন্য যাতায়াত করে এই বাঙ্ক ক্লাসে। এছাড়া নীল আইল্যান্ড থেকে নিয়ে আসা শাক-সব্জি নিয়ে ওঠে অনেক স্থানীয় চাষি খেত-মজুর। এরা মূলত বাংলাদেশের লোক। ছোট ছোট দ্বীপগুলোতে শাক-সবজি বেচে আবার ফিরে আসে। ভাল জাতের সুপুরি আর কোকো নিয়েও এরা বিক্রি করে বিভিন্ন দ্বীপে। এছাড়া হাট বে’তে ব্যবসা করতে আসে অনেক স্বচ্ছল ব্যাবসায়ীও। কেবিনগুলোতে তাদের সংখ্যাও কম নয়। এসব জাহাজ করে হাট বে’তে টিম্বার ব্যবসায়ীদের ঘন ঘন যাতায়াত লেগেই থাকে।
এভাবেই প্রতিবার চক্রাকার ভাবে এক একটা ভয়েজ করে এই জাহাজটা, যেটার শুরু হয় দক্ষিন আন্দামান বা পোর্ট ব্লেয়ার থেকে। তারপর একে একে হাট বে, চাউরা , টেরেসা , কাচাল, কামোর্তা দ্বীপের পোর্ট গুলোতে গিয়ে ভেড়ে। এই আর্কিপেলাগো ধরে চলতে চলতে এই রুটের শেষ বন্দর হল ইন্দিরা পয়েন্ট আর ক্যাম্পবেল বে। এই ইন্দিরা পয়েন্টের যাত্রীদের মধ্যে সর্দারজিদের সংখ্যাই বেশি। ইন্দিরা পয়েন্ট পাঞ্জাবি অধ্যুষিত একটা ছোট জায়গা, যেখানে ইন্দিরা গান্ধী একসময়ে এখানে নানান সুযোগ সুবিধা করে দিয়েছিলেন এই পাঞ্জাবিদের থাকার জন্য। শেষ বন্দর ক্যাম্পবেল বে’তে নেমে যায় অবশিষ্ট প্রায় সব যাত্রী। জাহাজটার এই সম্পূর্ণ এক পাক প্রদক্ষিনের শেষ বন্দর হল “ ক্যম্পবেল বে”। এই বন্দরের নামের থেকেই এই জাহাজের নামকরন করা হয়েছে। ক্যাম্পবেল বে’তে সব যাত্রীকে নামিয়ে দিয়ে জাহাজ আবার ফিরতি মুখো পোর্ট ব্লেয়ার যাত্রা করে। ফেরার সময় যাত্রীদের এই খালি কেবিনগুলো আর ডর্মিটরি হলটা পরিস্কার করা হয়, কারন আবার পোর্ট ব্লেয়ার পৌঁছানমাত্র যাত্রীদের হুটোপুটি শুরু হবে বাঙ্ক-ক্লাসের বিছানা দখলের জন্য। বিকাশের কাছে এই দৃশ্য এই প্রথম হলেও ক্যাপ্টেন ও অন্যন্য ক্রুদের কাছে এটাই একটা নিত্য ঘটনা। ফেরার পথেই সাফ-সুত্র কেবিনগুলোতে ফায়ার ওয়াচ রাখা হয় রোজকার নিয়ম মাফিক। সেই ফায়ার ওয়াচের টহল দেবার জন্যই বিকাশ ঢুকেছিল বাঙ্ক-ক্লাসের হল ঘরটায়। সে ভাবতেই পারেনি এমন অবিশ্বাস্য আর ভয়ানক ঘটনা তার জন্য অপেক্ষা করে বসে আছে ডর্মিটরির ওই হল ঘরে।
(৫)
পরের দিন সকাল আটটায় প্রাতরাশের সময়টায় খবরটা ক্যাপ্টেনের কানে গেল। বোসন ক্যাপ্টেনকে বলেছে গত রাতের ঘটনাটা সম্পূর্ণ ঘটনাটা। খবরটা শোনামাত্র ক্যাপ্টেন গম্ভীর মুখে বোসানকে বকাঝকা করতে শুরু করে। কিন্তু বিকাশ যে বোসানের কথার খেলাপ করেই ওঘরে গেছিল সেটা শোনার পর সোজা বিকাশের কেবিনের দিকে গেল। চিন্তিত মুখে বিকাশের কেবিনে ঢুকে শায়িত বিকাশের কাছে এসে বলল – “ ব্যাপার কি হে , কাল কারোকে সঙ্গে না নিয়ে একাই বাঙ্ক-ক্লাসে ঢুকে পড়েছিলে নাকি, বোসানকে তো বলাই ছিল। শুনলাম ওর কথা না শুনে তুমে একাই গেছিলে সেখানে ? কি হয়েছে দেখি। ‘’ বিকাশ শোওয়া অবস্থা থেকে ধড়মড় করে উঠতে যাচ্ছিল। ওকে বাধা দিয়ে ক্যাপ্টেন ওর পায়ের কালশিটে পড়া দাগগুলো ভাল করে দেখতে দেখতে বলল – “ বরাত জোড়ে বেঁচে গেছ। অল্পের উপর দিয়েই গেছে। আসলে আমারই ভুল, আমারই ভুল। তোমাকে আগে থেকেই ভালোভাবে সতর্ক করে দেওয়া উচিত ছিল আমারই। আসলে দিন সাতেক আগে তোমার এই জাহাজে জয়েন করার পর থেকে একদম ফুরসতই পেলাম না , যা কাজের চাপ ছিল। হাউ এভার , যা হবার হয়েছে। একটু সুস্থ হবার পর বোসন সব তোমাকে বলবে। বাঙ্ক ক্লাসের ওই হল ঘরটার একটা অভিশপ্ত ইতিহাস আছে। অ্যাকচুয়ালি দ্যাট হল ইস হন্টেড। রিমেম্বার ইট। “
বিকাশ চমকে উঠল কথাটা শুনে। ক্যাপ্টেনকে কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই বোসন ব্যান্ডেজ আর মলম নিয়ে ঘরে ঢুকল। সঙ্গে কিছু জ্বরের ওষুধ আর পেইন কিলার। ক্যাপ্টেন বোসনের দিকে ইঙ্গিত করে বিকাশকে বলল – “ হি উইল এক্সপ্লেইন এভ্রিথিং। আমার একটু জরুরি কাজ আছে, টেক রেস্ট। সি ইউ লেটার “। তারপর বোসনের দিকে তাকিয়ে বেশ রাগতভাবে ধমকের সুরে বলল – “ সেকেন্ড সাবকে তোমরা এই ফায়ার পেট্রোল রাউন্ডে একা না যাবার কথাটা পরিস্কার করে বুঝিয়ে বলোনি, এটা মারাত্মক ভুল কাজ করেছ, ওর কিছু হয়ে গেলে আমাদের সবাইকেই বিপদে পড়তে হত, সে খেয়াল আছে? সবাইকে বাড়ি ফিরতে হত ব্যাগ পত্তর নিয়ে। ’’ এ কথা বলার পরই ক্যাপ্টেন বেরিয়ে গেল। বোসান ফ্যাকাসে মুখ করে এগিয়ে এল বিকাশের পায়ে ড্রেসিং করে দেবার জন্য। এই ক্যাপ্টেন ডিসুজা গোয়ার বাসিন্দা। এই “ক্যাম্পবেল বে” জাহাজে এই নিয়ে তার পাঁচবার হল। দুজন ক্যাপ্টেন ঘুরে -ফিরে এই জাহাজেই আসেন প্রতিবার , একজন আরেক জনকে রিলিফ করেন চার মাস অন্তর অন্তর। অন্য জন ক্যাপ্টেন সতীশ, মুম্বাই এর বাসিন্দা। কোম্পানিও এই দুজন বিশ্বস্ত ক্যাপ্টেনের তত্ত্বাবধানে জাহাজের সমস্ত দায়-দায়িত্ব সঁপে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়। দ্বীপান্তরের পোর্ট গুলোতে বিভিন্ন রকমের যাত্রী বহন করে এক পোর্ট থেকে অন্য পোর্টে যাত্রী ওঠা নামা করার নানান হ্যাঙ্গাম সয়ে ঠিকঠাক জাহাজের কাজ সমাধা করতে এরা দুজনেই বেশ পারঙ্গম। এরা দুজনেই আগে “এম ভি ডিগলিপুর” জাহাজে কাজ করেছেন। প্রচুর অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ক্যাপ্টেন দুজনেই। দশ ডিগ্রী চ্যানেলে উত্তাল সমুদ্রের মধ্যে দিয়ে এত যাত্রী নিয়ে এসব জাহাজের নিয়ন্ত্রন রক্ষা করে নেভিগেশন করা সহজ ব্যাপার নয়। এই দুজন ক্যাপ্টেনই এ ব্যাপারে সিদ্ধহস্ত। ডুগং ক্রিক , রস আইল্যান্ড , হাট বে, কার নিকোবরের পাশ দিয়ে বেসামাল সমুদ্রের মাঝখানে এই জাহাজকে সামাল দেওয়ার ব্যাপারটা তাদের নখদর্পণে। দীর্ঘ দিনের নেভিগেশনের প্রচুর অভিজ্ঞতাই তাদের এই কর্মদক্ষতার প্রধান হাতিয়ার। ক্যাপ্টেন ডিসুজা ছুটি কাটিয়ে আবার গত মাসেই জয়েন করেছেন এই জাহাজে। এই বোসান ওয়ালিউল্লাহও এ নিয়ে তৃতীয়বার এসেছে এই জাহাজে। তার অভিজ্ঞতাও কম নয়। বিভিন্ন রকমের যাত্রীদের জাহাজে ওঠানামা আর এই জাহাজে করে এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে যাতায়াত দেখে দেখে সমস্ত যাত্রীদের মনস্তত্ত্ব যেন তার মুখস্ত।
(৬)
বিকাশ সেই বাঙ্ক-ক্লাসের পুরনো কাহিনী শোনার জন্য স্বাভাবিকভাবেই কয়েকদিন ধরে খুব উদ্গ্রিব হয়ে ছিল। বোসনকে একলা পেয়ে এবার সে বলল – “ ওয়ালী ভাই, ওই বাঙ্ক ক্লাসে কি হয়েছিল আগে, ক্যাপ্টেন যে বলছিল এর পিছনে কি পুরনো কাহিনী আছে আমায় বল এবার।” বিকাশ ইতিমধ্যেই অন্যদের থেকে শুনেছে ঘটনাটা যখন ঘটেছিল তখন এই বোসনই এই জাহাজে ছিল। বিকাশের পায়ে ড্রেসিং করতে করতে বোসন এবার শুরু করে তার কাহিনী –“তিন বছর আগের ঘটনা এটা, যখন জাহাজটাকে নতুন অবস্থায় গুজরাটের শিপ-ইয়ার্ড থেকে নিয়ে আসা হয় । আমি ছিলাম সেই টেক ওভারের সময়, এই ক্যাপ্টেন ডিসুজাও ছিলেন। সী – ট্রায়াল হবার পর এই জাহাজকে আমরা আন্দামানে নিয়ে আসি। পোর্ট ব্লেয়ার থেকে যাত্রী বহন করার জন্য কোম্পানি থেকে ঘোষণা করা হল। এই লাইনে আরও কিছু জাহাজ যাতায়াত করত। যেমন এম ভি তারমুগলি, এম ভি নিকোবর, এম ভি আন্দামান, এম ভি হর্ষবর্ধন। সুন্দর ঝাঁ ঝকঝকে নতুন জাহাজ দেখে বিশেষত স্থানীয় নিত্য যাত্রীদের মধ্যে এই জাহাজে চড়ার জন্য একেবারে হিড়িক পড়ে গেল। রাতারাতি কেবিন আর বাঙ্ক-ক্লাসের সব টিকিট বিক্রি হয়ে গেল। টুরিস্ট ছাড়া বেশিরভাগ নিত্য যাত্রীরাই এখানে ব্যাপারী আর ব্যবসায়ী। নানান শাকসবজি, সুপারী, নারকল, রেড অয়েল পাম, পান, কোকো ইত্যাদি নিয়ে স্থানীয় তামিল, শ্রীলঙ্কান আর বাংলাদেশের ব্যবসায়ী , ক্ষেত মজুররা সফরের জন্য এবারও টিকিট বুক করে ফেলেছে। তাদের এই সব বিক্রির সামগ্রী ক্রেন দিয়ে সামনের কার্গো হ্যাচে তোলা শুরু হবে । এছাড়া মহাজন গোছের মজুতদাররা আর সব পয়সা-ওলা লোকেরাও আছে যারা ডিলাক্স ক্লাস বা ফার্স্ট ক্লাস কেবিনের টিকিট কেটেছে। বেশ কিছু রুগিও এবারে আবার জুটেছে বাঙ্ক আর কেবিন গুলোতে। চিকিৎসা করাতে এসেছিল পোর্ট ব্লেয়ারে। অনেক ওঙ্গি, সেন্টিনেলিজরাও যাচ্ছে এই জাহাজে। কিছু অসুস্থ বা মুমূর্ষু সভ্য জারোয়াদের এবারও অসুস্থ অবস্থায় বাড়ি নিয়ে যেতে হবে এই জাহাজে করে। কিছু সরকারি স্বেচ্ছাসেবকদের তত্ত্বাবধানে এস্কর্ট করে তাদের নিয়ে যাওয়া হবে। কারন এরা একেবারেই জংলি এবং সম্পূর্ণ উলঙ্গ। এদের আলাদা রাখার ব্যাবস্থা আছে। সরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার ছেলে-মেয়েরা এসব রোগীদের ডাক্তার দেখানো , মুমূর্ষু রোগীদের দেখাশোনা আর ভাষান্তর এ সবসময় সাহায্য করবার জন্য সবসময় সাথে সাথে যায়। এই রোগীদের সংখ্যা প্রতিবারই পাঁচ ছ’জনের বেশি হয়না। কারন এই জাহাজের মধ্যেই মোট ছয় খানা হসপিটাল বেড এর ব্যবস্থা আছে। এই জংলী আদিবাসী রোগীদের অন্যান্য যাত্রীদের সংস্পর্শে আসতে না দিয়ে সম্পূর্ণ আলাদা করে জাহাজের হাসপাতাল ঘরগুলোতে তালা বন্ধ করে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সমস্ত কাজই করে এস্কর্টের ছেলে মেয়েরা। প্রথম দিন যেদিন যাত্রী নিয়ে এই নতুন জাহাজের প্রথম যাত্রা শুরু হল , পোর্ট ব্লেয়ারে জাহাজ ভেড়ার সাথে সাথেই যথারীতি বাঙ্ক ক্লাসের যাত্রীর দল হুর-মুড় করে গ্যাংওয়ে দিয়ে উঠে আসতে থাকে। নতুন জাহাজে প্রথম যাত্রা শুরুর উত্তেজনায় সবাই প্রায় উন্মত্ত। স্থানীয় আদিবাসী গরিব চাষা-ভুষার দল একেবারে বউ-বাচ্চা-পরিবার সমেত উঠে আসছে পাগলের মতন আনন্দ করতে করতে। এই নতুন জাহাজে চড়ে তাদের দ্বীপান্তরে ঘুরে ঘুরে বেচাকেনা হবে, এই আনন্দে। রথ দেখা আর কলা বেচা দুইই হবে একসাথে। তামিল, শ্রীলঙ্কান, ওঙ্গী, সেন্টিনেলিজদের আলাদা করে চেনার উপায় নেই। সকলে মিলেমিশে একাকার। প্রথম ভয়েজের উল্লাসে ফেটে পড়েছে সকলে। পাঁচশো বাঙ্ক ক্লাসের টিকিট নিঃশেষিত। ছয় জন মুমূর্ষু জারোয়াকে নিয়ে নিচের জেটিতে অপেক্ষা করছে সেচ্ছাসেবীরা। বাঙ্ক ক্লাসের সব যাত্রীদের জাহাজে ওঠার ভিড়টা কেটে গেলেই তাদের উপরে নিয়ে আসা হবে। আর সব শেষে আসবে লাক্সারি কেবিন আর ফার্স্ট ক্লাস কেবিনের যাত্রীরা ।
উল্লাসে উচ্ছসিত বিশৃঙ্খল লোকগুলোর মধ্যে অসম্ভব হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। তাই দেখে ক্যাপ্টেন মাইকে ঘোষণা করলেন যাতে সকলে সুশৃঙ্খলভাবে গ্যাংওয়ে দিয়ে উপরে উঠে আসে। আর চিৎকার চ্যাঁচামিচি বা হই-হট্টগোল না করে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। গরিব অশিক্ষিত লোকগুলোকে কিছুতেই ঠেকানো গেলনা। আমরা সব ক্রু-রা মিলে হিমশিম খেয়ে গেলাম ওদের আটকাতে। এদের মধ্যে অনেক মহিলার কোলে দুধের শিশুও ছিল। সে এক বীভৎস পরিস্থিতি। লোকেরা গ্যাংওয়ে দিয়ে উপরে পৌঁছানমাত্র হুড়মুড় করে বাঙ্ক ক্লাসের হল ঘরটাতে ঢুকতে লাগলো। লোকেরা বাক্স প্যাঁটরা, টিনের কৌটো, জামাকাপড়ে বোঝাই ব্যাগ ইত্যাদি নিয়ে ঠেলাঠেলি ধাক্কা-ধাক্কি করে নিজের নিজের জায়গা দখল করতে লাগলো। চরম একটা বিশৃঙ্খলা। আমার এতদিনের চাকরি জীবনে এমন বিশৃঙ্খলা কখনো দেখিনি। এদিকে ক্যাপ্টেন সমানে অ্যানাউন্স করে চলেছেন লোকেদের শান্ত হবার জন্য। হইচই না করে ধিরেসুস্থে সবার আসন গ্রহন করার জন্য । কিন্তু কে শোনে কার কথা। কে জানালার ধারে ভাল সিট নেবে তারই প্রতিযোগিতা চলেছে সমানে। সঙ্গে অসম্ভব চিৎকার চ্যাঁচামিচি আর হই হট্টগোল। এর ফলে ঘটল সেই মারাত্মক দুর্ঘটনা। প্রচণ্ড ধাক্কাধাক্কিতে এক ওঙ্গী মায়ের কোল থেকে ছিটকে পড়ল তার দুধের শিশু। আর পাশের লোহার বাল্ক-হেডে বাচ্চাটার মাথাটা গিয়ে দড়াম করে লাগলো। বাচ্চাটা চিৎকার করারও সুযোগ পায়নি। মাথা ফেটে সঙ্গে সঙ্গে ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরছে। বাচ্চাটা নিমেষের মধ্যে নেতিয়ে পড়ল। এত জোরে মাথাতে লেগেছে যে এত টুকু বাচ্চা তৎক্ষণাৎ শেষ। শরীরটা নিথর হয়ে গেল মুহূর্তের মধ্যে। ভিড় কাটিয়ে আমরা যখন ওদের কাছে পৌঁছালাম ততক্ষনে সব শেষ। জাহাজে দুজন ডাক্তার ছিল। তারা দৌড়ে এল। বাচ্চাটাকে শুইয়ে দিয়ে অনেক চেষ্টা করা হোল বাঁচাবার। কিন্তু বাঁচানো গেলনা। মাথা ফেটে চৌচির। প্রচুর রক্তপাত হয়েছে। হাত পা সব ঠাণ্ডা হয়ে গেছে ওর। নাড়ি টিপে দেখে ডাক্তাররা শিশুটাকে মৃত বলে ঘোষণা করল। রক্তে ভেসে যাওয়া শিশু শরীরটা কোলে নিয়ে সেই ওঙ্গী মা বাবার সে কি মর্মান্তিক কান্না। তাদের বুকফাটা আর্তনাদ তখন স্তব্ধ করে দিয়েছে সেই হল ঘরের সকলকে। এই হৃদয় বিদারক দৃশ্য দেখে আমরা সকলে হতবাক হয়ে গেছিলাম। এদিকে সেই ওঙ্গী রমনিকে যে লোকটা ধাক্কা দিয়েছিল তাকে ঘিরে ধরে মারধর করছে অন্য সব যাত্রীরা মিলে। সকলে এই লোকটাকেই নাকি ধাক্কা দিতে দেখেছে । তামিল জংলী ধরনের লোকটা বিস্ফারিত চোখ করে যাত্রীদের দিকে অঙ্গ-ভঙ্গি করে অশ্রাব্য গালিগালাজ করছে আর হিংস্র চোখে আস্ফালন করে যাচ্ছে। এত হৃদয় বিদারক একটা ঘটনার পরও লোকটার তেজ আর আস্ফালন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে লাগলো। জানা গেল লোকটা নানকৌড়ি অঞ্চলের এক জেলে। সাঙ্ঘাতিক হিংস্র আর পশুর মতন আচরণ। খবর পেয়ে পোর্ট ব্লেয়ার থানার পুলিশ এসে পড়ল। ঘটনার বিবরন লিখে নিল। মৃত বাচ্চাটার বাবা মা দুজনের বয়ান নেওয়া হল। দুজনেই বলল এই লোকটাই তাদের ধাক্কা দিয়েছে। বাচ্চাটার মৃত্যুর জন্য এই লোকটাই দায়ী। অন্যান্য যাত্রীরাও পুলিশের জেরায় বলল তারাও সচক্ষে দেখেছে এই লোকটাকে ধাক্কা দিতে। বাচ্চাটার মৃত্যুর জন্য এই লোকটাই দায়ী। এই লোকটার সাথে ওঙ্গী দম্পতির জায়গা দখল নিয়ে তীব্র বচসা বাঁধে। ঝগড়া এবং কথা কাটাকাটি এক সময় চরম আকার নেয়। ঠিক সেই সময়েই নাকি লোকটা রাগে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে সজোরে ধাক্কা দেয় ওদের। আর সেই ধাক্কায় মহিলা্র কোল থেকে বাচ্চাটা ছিটকে পড়ে বাঙ্কের লাগোয়া দেয়ালে মাথা লেগে ফেটে যায়। সবার বয়ান নেওয়ার পর দশাসই হিংস্র এই জংলী লোকটাকে পুলিস ধরে নিয়ে যায় হাতকড়া পড়িয়ে । সঙ্গে তার স্ত্রীও ছিল। রাগে আস্ফালনকারী স্বামীর দিকে তাকিয়ে সে বিড় বিড় করে চুপ করার কথা বলছিল । কিন্তু এই লোকটার চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝরছে তখন। গ্যাংওয়ে দিয়ে নামার সময় সমানে অশ্রাব্য গালি-গালাজ করতে করতে শাসাতে শাসাতে চলেছে। মনে হচ্ছিল হিংস্র একটা জন্তুকে ধরে-বেঁধে নামানো হচ্ছে জাহাজ থেকে। কোমরে দড়ি বেঁধে মাঝে মাঝেই লাঠিপেটা করতে হচ্ছিল পুলিশকে। মৃত শিশুটার বাবা মা কপাল চাপড়ে সমানে কাঁদতে লাগলো। তাদের বুকফাটা হাহাকার এই হল ঘরের সকলকে স্তব্ধ করে দিয়ে বাতাসে বাতাসে ঘুরে বেড়াতে লাগলো।এর পরেই মৃত শিশুটার ওঙ্গী মায়ের অবস্থা ক্রমশ শোচনীয় হয়ে উঠল। নিজের সন্তানের এমনভাবে মৃত্যু কিছুতেই সে সহ্য করতে পারছে না। বারবার অচৈতন্য হয়ে পড়ছে সে। ডাক্তারের একটা দল এসে এই মহিলাকে স্ট্রেচারে করে হাসপাতালে নিয়ে গেল। সঙ্গে শিশুটির বাবাকেও। এই তাৎক্ষনিক আর অসহনীয় ঘটনায় আমরা সকলে একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেছিলাম। এদিকে জাহাজের মধ্যে এমন খুনের ঘটনা হওয়াতে ডাইরেকটরেট অফ শিপিং সার্ভিসেস এই কেসটা নিয়ে উঠেপড়ে লাগল। শিপিং কর্পোরেশন জাহাজ কোম্পানির উপর চাপ এসে পড়ল। কোর্ট কাছারি চলতে লাগলো । এই কোম্পানির যাত্রী-জাহাজে যাত্রীদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠল । শিপিং কর্পোরেশন “ক্যাম্পবেল বে” জাহাজে যাত্রী ওঠানামা মাস খানেকের জন্য বন্ধ রেখে পোর্ট ব্লেয়ারের এক লে-অফ বার্থে পাঠিয়ে দিল। তার মধ্যেই ডি এস এস এবং শিপিং কর্পোরেশনের মধ্যে কোর্ট কাছারি আর মামলা মোকদ্দমা চলতে লাগলো। আমরা তখন লে-অফ বার্থে বসে দিন গুজরান করে চলেছি। কবে আবার জাহাজ চালু হয়, কবে থেকে আবার যাত্রী ওঠানামা শুরু হয় তার অপেক্ষায়। এদিকে শোনা গেল কিছু দিনের মধ্যেই অপরাধী লোকটার সাজা হয়েছে। কোর্ট এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছে তাকে। এই আন্দামানেরই নিকৃষ্টতম সেন্ট্রাল লক আপে আর জেলখানায় তাকে রাখা হয়েছে। মামলা মোকদ্দমা মিটিয়ে আমাদের এই জাহাজ আবার যাত্রী নিয়ে সেইল করার ছাড়পত্র পেয়ে যায় মাস খানেকের মধ্যেই। এই ভাবেই একটা মর্মন্তুদ ঘটনার ইতিহাস সঙ্গে নিয়েই শুরু হল এই জাহাজের মেইডেন ভয়েজ। এরপর দ্বীপান্তরের পথ পেরুতে পেরুতে এরকমই যাত্রী ওঠা নামা করতে করতে এক সময় সবাই ভুলেই গেল সেই দিনের ঘটনা। কিন্তু এই জাহাজের যে সব অন্যান্য স্থানীয় খালাসি আর ক্রু’রা আছে তাদের মুখে শুনতে লাগলাম নানান কথা। সেই হিংস্র তামিল লোকটা জেলের মধ্যেই নাকি এখনও আক্রোশে ফুঁসছে রোজ। সেই ওঙ্গী দম্পতির উদ্দেশে গালিগালাজ আর শাসানি চলছেই কারাগারের ভিতর থেকেই। এসব উড়ো খবর অনবরতই কানে আসে। এমন ছোট্ট দ্বীপের বন্দীশালা থেকে মুখে মুখে খবর ছড়াতে বেশি সময় লাগেনা। জাহাজ এরই মধ্যে অনেকগুলো ভয়েজ সেরে ফেলেছে। আমাদের বাড়ি ফেরার সময়ও একদিন এসে যায়, এই একই পোর্টে ঘুরে ঘুরে একঘেয়ে ভয়েজ করতে করতে। আমি , ক্যাপ্টেন সাহেব আর পুরনো যারা আছে সকলেই নেমে গেলাম আমাদের রিলিভার যেদিন এল সেদিনই। বাড়িতে তিন-চার মাসের ছুটি কাটিয়ে আমরা আবার ফিরে আসব এই জাহাজেই। ছুটিতে বাড়িতে যাবার পর বাঙ্ক-ক্লাসের ডরমিটরির সেই ভয়াবহ দুর্ঘটনার কথা মন থেকে মুছেই গেছিল প্রায়। ঘটনাটা ঘটার পর এক বছর হয়েও গেছে। বহু পত্র-পত্রিকাতেও খবরটা বেড়িয়েছিল শুনেছি। দেখতে দেখতে আমাদের ছুটি ফুরিয়ে এল। মাস চারেক পর আবার এই জাহাজেই ফিরে এলাম । যারা আমাদের রিলিভ করেছিল তাদেরই আবার ছাড়তে এলাম আমরা। আসার পরেই ওদের মুখে আরেকটা সাঙ্ঘাতিক কথা শুনে শিউরে উঠলাম আমরা সবাই। সেই ঘটনা ঘটার এতদিন পরেও এই শিশু মৃত্যুর জের যে এত ভয়াবহ হতে পারে তা আমরা কল্পনাও করতে পারিনি। ” এটুকু বলার পর ওয়ালিউল্লাহ একটু থেমে ফ্লাস্ক থেকে দুজনের জন্য চা ঢালতে লাগলো । সকাল দশটা বাজে, জাহাজে চায়ের সময় হয়ে গেছে। অন্যটায় নিজে চুমুক দিয়ে বোসান আবার বলতে শুরু করল – “ এক বছর সাজা কাটার আগেই সেই খুনী লোকটা জেলের কিছু দাগী আসামির সঙ্গে যোগসাজশ করে জেল থেকে পালিয়ে যায়। সেই দিনই সে তার জেলে-নৌকো নিয়ে জিরকাটাঙ-এর ওঙ্গী বস্তিতে ঢুকে পড়ে নিঝুম রাতের অন্ধকারে। সমস্ত গ্রাম তখন ঘুমিয়ে পড়েছে। দু একটা চা’য়ের দোকান আর খাবারের দোকান শুধু খোলা । সেই সব দোকানে খোঁজ খবর নিয়ে সে খুঁজে বার করে ওই গরিব ওঙ্গী পরিবারের বাড়ি । সন্তর্পণে দরমার দরজা খুলে ঘরে ঢুকে সুপুরি কাটার হাঁসুয়া দিয়ে তাদের গলা কেটে খুন করে ঘুমন্ত অবস্থায় থাকা দুজনকেই । ” কথাটা শুনেই একেবারে লাফিয়ে উঠে বিকাশ বলে – “সেকি ?? ” “হ্যাঁ , প্রতিশোধের আগুনে জ্বলতে জ্বলতে জানোয়ারটা ওদের গ্রামে পৌঁছে গিয়ে চরম আক্রোশে নৃশংস ভাবে খুন করে ওই বাচ্চাটার মা বাবা দুজনকে, ভাবতে পারছ ?? আর এই জঘন্য কাজ করেও সে থেমে থাকেনি। ” — “ বল কি? আবার কি কাণ্ড ঘটালো লোকটা ।” — “ হ্যাঁ , এই নৃশংস খুন করার পরও লোকটার চণ্ডাল রাগ যেন তখনও ঠাণ্ডা হচ্ছিল না । নানকৌড়ীতে ওর নিজের বাড়ি ফিরে এসে সেই রাতেই তার ঘুমন্ত বউকে সেই একই হাঁসুয়া দিয়ে গলা কেটে খুন করে। তার বউ যে পুলিশকে সাক্ষ্য দিয়েছিল, বলেছিল তার স্বামীই দোষী , এই অপরাধে সে নিজের বউকেও শেষ করে দিল, আর তার পরেই লোকটা নিজে বাড়ির উঠোনের মধ্যে একটা প্যাডক গাছের ডালে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ল। এভাবে নিজেকেও শেষ করে দেয় সে। ”
বিকাশ কাহিনীটা শুনে হতভম্বের মতন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে ওয়ালিউল্লার দিকে। বোসন বলতে থাকে –“একই রাত্রে মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই চার চারজনের মৃত্যু হল। একটা শিশু মৃত্যুকে কেন্দ্র করে প্রতিহিংসার আগুনে চার চারজনের খুন হয়ে গেল। দুটো গ্রামের স্থানীয় লোকেরা এই ঘটনায় একেবারে স্তম্ভিত হয়ে যায়। পুলিশেরও আর কিছু করার থাকেনা।” বিকাশ এই ভয়ানক ঘটনা শুনে একেবারে থ হয়ে যায়। বিহবলতা কাটয়ে ওঠার আগেই বোসান বলতে থাকে – “ এই ঘটনার পর থেকেই আমাদের এই জাহাজের বাঙ্ক-ক্লাসটা একটা অভিশপ্ত হন্টেড জায়গা হয়ে যায়। আমি এবার এসে জয়েন করার আগে থেকেই নাকি এই ঘরে রাতে কেউ ফায়ার পেট্রোল রাউন্ডে যেতে রাজি হচ্ছে না শুনলাম। ক্যাম্পবেল বে থেকে পোর্ট ব্লেয়ার ফেরার পথে রাতে টহল দেবার সময় নাকি তিন জন তিন দিন এই হল ঘরে ওই ওঙ্গী রমনীকে দেখতে পেয়েছঅ, এক পিশাচিনীর রুপে কোলের মধ্যে নিজের শিশুর রক্ত পান করছে। সেই মহিলার বীভৎস চাহনি দেখে দুজন ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছিল। আরেকজনকে অন্য এক রাতে সিঁড়ির মধ্যে মারাত্মক জখম আর অচৈতন্য অবস্থায় পাওয়া যায় । তখনকার ক্যাপ্টেন সতীশ সেই অ্যাসিস্ট্যান্ট বাওম্যানকে হাসপাতালে পাঠিয়ে সুস্থ করে ফিরিয়ে আনে। এরপর থেকে কেউ আর রাতে ওই হলঘরে টহল দিতে যায়না একা একা।
আমি এবার জয়েন করার পরেও এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতেই থাকে। শুধু রাতে নয়, দিনের বেলাতেও খালি-জাহাজে এই ঘটনা ঘটতেই থাকে। ক্রুরা ওই ঘরে ঢোকার জন্য অস্বীকার করতে থাকে। এদিকে ফায়ার পেট্রোল রাউণ্ড না নিলেই নয়। ক্রুরা ক্রমশ বিদ্রোহী হয়ে উঠছে দেখে ক্যাপ্টেন ডিসুজা বাধ্য হয়ে শিপিং কর্পোরেশনকে চিঠি লেখেন। তাছাড়া যাত্রীদের মধ্যেও অনেকেই অভিযোগ জানাতে শুরু করে। আর এস এস আবার শিপিং কর্পোরেশনকে নির্দেশ দেয় অবিলম্বে বাঙ্ক ক্লাসের হল ঘরটা সীল করে দেবার জন্য। না হলে যাত্রীদের নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। যাত্রী বিক্ষোভও হতে পারে। কেবলমাত্র ফার্স্ট ক্লাস আর ডিলাক্স ক্লাসের কেবিন খোলা রাখতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এভাবেই বেশ কিছুদিন চলছিল ।বাঙ্ক- ক্লাস সম্পূর্ণ সীল করে দেওয়া হয়েছিল। কেবলমাত্র কেবিনের কম সংখ্যক যাত্রী নিয়েই যাতায়াত করছিল জাহাজ। তুমি জয়েন করার দিন-পনেরো আগে আবার বাঙ্ক ক্লাস খুলে দেওয়া হল সাধারন আর গরিব স্থানীয় যাত্রীদের সুবিধার জন্য। একেই এই শীতের মরশুমে যাত্রীদের সংখ্যা অত্যন্ত বেশি থাকে। এই রুটে এস সি আই – এর যে কটা জাহাজ আছে তাদের মধ্যে সব যাত্রীর স্থান সঙ্কুলান হয়না। ভিড় সামলাতে তাই কোম্পানি বাধ্য হয়ে এই বাঙ্ক ক্লাস আবার খোলার আবেদন করে পারমিশন পেয়ে গেল। পাঁচশ জনের জন্য তৈরি হল-ঘরটা আবার খুলে দেওয়া হল যাত্রী সাধারনের জন্য। ব্যাস , গত মাস থেকে শুরু হয়ে গেল যথারীতি আবার যাত্রী ওঠা নামা। কিন্তু ঘরটার সেই অভিশাপ এখনো কাটেনি। ওই ঘরের সেই ভৌতিক দৃশ্য আর সেই ভয়ানক-দর্শনা পিশাচিনী আবারও দেখা দিতে লাগলো। ওই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি শুরু হয়ে গেল আবার। খালি বাঙ্ক-ক্লাসে রাত্রে দুজনকে একসাথে পাঠালেও তারা একই দৃশ্য দেখে ভয়ে পালিয়ে আসে। স্থানীয় নিকোবরিজ কিছু খালাসি উপায়ান্তর না দেখে গ্রামের কিছু পুরনো গুনীনকে নিয়ে এসে ঝার-ফুঁক করে ভুত তাড়াবার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু জাহাজী কোম্পানি এসব বুজরুকী বলে উড়িয়ে দিয়েছে। প্রতিবার ভয়েজের শেষে ক্যাম্পবেল বে পোর্টে লোকজন নেমে গিয়ে যখন ঘরটা খালি হয়ে যায় সেই সময় থেকেই শুরু হয় এই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। অথচ যাত্রী- বোঝাই জাহাজে এই পিশাচিনীর অস্তিত্ব কেউ টের পায়নি কখনও, কেউ সে সময় কিছু ছাক্ষুসও করেনি।”এবার বিকাশের দিকে তাকিয়ে বোসন স্মিত হেসে জিজ্ঞাসা করে – “তুমি সেই মহিলাকেই দেখেছিলে , তাই তো? বাচ্চা কোলে করে বাচ্চার বুক থেকে রক্ত খেতে এগিয়ে আসছে সেই প্রেতীনি ,ঠিক বলিনি? তুমি হলে গিয়ে এই নিয়ে সাত জন, যারা এই একই দৃশ্য দেখে ভয় পেয়েছে। ” বিকাশ হতবাক হয়ে শুনতে থাকে আর সেই ভয়াবহ দৃশ্য আবার তার চোখের সামনে যেন ভেসে ওঠে। বিড়বিড় করে বলে – “ সত্যি, কি বীভৎস সেই দৃশ্য , এখনো মনে পরে গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। খুব জোর বেঁচে গেছি সেদিন। ”
সেই থেকে বিকাশ সাইন-অফ করে বাড়ি যাওয়া অবধি সেই হলঘর মুখো হয়নি আর কখনও। যতদিন সে ওই জাহাজে ছিল ততদিন অন্যন্য সব কেবিনে ফায়ার পেট্রোল রাউণ্ড সেরে ব্রিজে ফিরে এসেছে। কিন্তু জাহাজের পেটের মধ্যে নিচের সিঁড়ি বেয়ে বিভীষিকাময় বাঙ্ক – ক্লাসে আর যাবার সাহস পায়নি। এভাবেই বিকাশের চার মাসের কনট্র্যাক্ট শেষ হয়ে গেল একদিন। বাড়ি ফিরে যাবার দিন জাহাজের সকলকে বিদায় জানিয়ে বিকাশ ব্যাগ-পত্তর নিয়ে নিচে নেমে এল। নিচে এজেন্টের গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল জেটিতে। ওকে নিয়ে এয়ারপোর্টে ছেড়ে দিয়ে আসার জন্য। তখন সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। ধূসর কালো রঙের স্যাডল পীকের ওপাশ থেকে বিশাল চাঁদ উঠেছে। ফুটফুটে চাঁদনি রাত। জেটির পাশের বাদাম আর সিমোয়া গাছটা অদ্ভুত রকমের ভুতুরে অবয়ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জেটি থেকে সেই গোল গোল পোর্ট-হোলের মধ্যে দিয়ে হল ঘরটার ধোঁয়াটে নীলচে আলো বাইরে ঠিকরে এসে পড়ছে। দূর থেকে কানে ভেসে আসছে ওঙ্গীদের ভগবান বোয়ান-দেবতার পুজোর মন্ত্র আর ঢিমে তালের বাদ্যযন্ত্রের একটানা ঘুমপাড়ানি আওয়াজ। বহু দূরের করবিন কোবসের লাইট-হাউসের ঘূর্ণায়মান আলোর রশ্মি ক্ষণিকের জন্য এসেই মুহূর্তে জায়গাগুলোকে আবার অন্ধকারে নিমজ্জিত করে বার বার অদৃশ্য হচ্ছে। গাড়িতে ওঠার মুহূর্তে বিকাশ পিছন ফিরে একবার সেই পোর্ট হোলের ভিতরের নিভু নিভু আলোর দিকে দেখতে গিয়েই শিউরে উঠল। মনে হল এলোকেশী একটা ভয়ানক মুখের কালো ছায়া সরে গেল সেখান থেকে মুহূর্তে। তখনি হঠাৎ করে একটা মেগাপড পাখি মনে হল হৃদস্পন্দন থামিয়ে দিয়ে ডানা ঝটপটিয়ে সেই নিস্তব্ধ সন্ধ্যায় অন্য কোথাও উড়ে গিয়ে বসল রাতে ঘুমোবার জন্য। করবিন কোবসের লাইট হাউসের আলোটা আরেকবার ঘুরে এসে মিলিয়ে যাবার আগেই বিকাশকে নিয়ে গাড়িটা বিদায় নিল সেখান থেকে।
স মা প্ত