গল্প : ভাঙা হাসি, নিঃশব্দ যুদ্ধ

পিনাকী রঞ্জন পাল

অধ্যায় ১: আগুনের নিচে ঠান্ডা ছায়া

প্রিয়াংশুর কপালটা বোধহয় জন্ম থেকেই মন্দ। এই কথাটা ও মুখে কখনও বলেনি, বলতেও চায়নি। কিন্তু ওর জীবনের প্রতিটা স্তর, প্রতিটা সিদ্ধান্ত যেন সেই কথাটারই প্রমাণপত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছোটবেলায় ওর মুখে সব সময় হাসি লেগে থাকত—চোখে থাকত একরাশ রোদ, বুক ভরা স্বপ্ন, আর প্রাণে একটা অদ্ভুত উচ্ছ্বাস। পাড়ার বুড়োরা বলত, “এই ছেলেটা একদিন অনেক বড় হবে।” এমনকি স্কুলের শিক্ষকরাও ওকে আলাদা করে ভালবাসতেন, কারণ পড়াশোনায় যেমন ভাল, তেমনি খেলাধুলোতেও এককথায় দুর্দান্ত। তবু সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল ওর সহজ, প্রাণবন্ত স্বভাব—মানুষকে আপন করে নেওয়ার এক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল ওর।

এই ছেলেটার একটা স্বপ্ন ছিল। খুব সাধারণ স্বপ্ন, আবার খুব জটিলও—একটা ভালোবাসার সংসার। যেখানে ওর স্ত্রী হবে একজন এমন নারী, যিনি শুধু ওর স্ত্রী হয়ে নয়, বন্ধুও হবেন। যিনি ওর চোখের ভাষা বুঝবেন, চুপচাপ পাশে দাঁড়িয়ে ওর ক্লান্তি ভাগ করে নেবেন। সহজ অথচ গভীর এক ভালোবাসার জগৎ গড়ে তুলবে তারা—এই ছিল প্রিয়াংশুর জীবনচিত্রের কেন্দ্রীয় স্বপ্ন।

কিন্তু জীবন তো সব সময় স্বপ্নপূরণের জন্য বসে থাকে না। জীবনের একটা নিজস্ব ছক থাকে, আর সেই ছকের বাইরে পড়ে থাকা স্বপ্নগুলোকে সে মুছে ফেলে অবলীলায়। প্রিয়াংশুর জীবনেও তেমনটাই হলো।

প্রিয়াংশু ছিল বাবা-মার ছোট ছেলে। দাদা দুজন, তাদের পরিবার আলাদা। প্রিয়াংশু তখনো সংসারের মূল কেন্দ্রে এসে দাঁড়ায়নি—এখনো পড়াশোনা, চাকরি খোঁজা আর একধরনের জীবনের প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছিল। এই সময়ে হঠাৎ করে ওর বাবার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। ক্যানসার ধরা পড়ে। প্রথমে সবাই ভেবেছিল এটা স্রেফ বার্ধক্যজনিত দুর্বলতা, কিন্তু ডাক্তার জানিয়ে দেন—সময় আর বেশি নেই। ছয় মাস, খুব বেশি হলে আট।

এই সময়েই শুরু হয় সংসারের আসল খেলা।

দাদা-বৌদিরা বসে পরিকল্পনা করলেন। বস্তুত, ওরা পরিকল্পনা করছিল অনেকদিন ধরেই—এই সুযোগটার জন্য অপেক্ষা করছিল যেন। যে ভাইটা এখনো নিজের পায়ে দাঁড়ায়নি, সেই ভাইকে যত দ্রুত বিয়ে দিয়ে দায়িত্ব শেষ করা যায়, ততই মঙ্গল। বাবার সামনে ‘শেষ ইচ্ছা’ হিসেবে বিষয়টা তুলে ধরা হলো—“বাবা, ছোট ছেলের বিয়ে দেখে যেতে পারলে শান্তি পাবেন।”

বাবা তখন অর্ধচেতন, ঘন ঘন অক্সিজেন সাপোর্ট নিতে হয়, চোখ খুললেও সেগুলো ঝাপসা, আর ঠোঁটে শুধু অস্পষ্ট কিছু শব্দ। তিনি আদৌ কথাটা বুঝলেন কিনা, সম্মত হলেন কিনা—সেটা কেউ জানল না, জানতেও চাইল না। কিন্তু ‘শেষ ইচ্ছা’র ঢালটি যথেষ্ট ছিল।

প্রিয়াংশুর মুখে সেদিন শব্দ আসেনি। চোখের ভিতর বিস্ময়ের এক ধোঁয়া ঘোরাফেরা করছিল। সে বুঝে গেল—এটা বাবা’র ইচ্ছা নয়, দাদা-বৌদিদের নিঃশব্দ সম্পত্তি ভাগের ভূমিকা। ওদের তাড়া ছিল, কারণ বিয়ে না হলে প্রিয়াংশুর ভবিষ্যতের ওপর তাদের অধিকার থাকবে না। বিয়ে মানে ভাগের স্বীকৃতি, স্থায়ী হওয়া, অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করা। এই ব্যস্ততা শুধু প্রিয়াংশুর বিয়ে নয়, বরং নিজেদের স্বার্থ সুরক্ষার।

কিন্তু তবু প্রিয়াংশু চুপ করে রইল। কারণ ওর বুকের গভীরে একটা কথা গেঁথে ছিল—বাবা’র চোখে যদি সত্যিই একটু প্রশান্তি আসে, তবে নিজের ইচ্ছা ত্যাগ করতেই পারে সে। ভালোবাসার সেই স্বপ্ন, সেই মনের মানুষ খোঁজার ইচ্ছেটা ও গিলে নিল—এক নিঃশব্দ আত্মবিসর্জন।

তড়িঘড়ি করে বিয়ে ঠিক হলো। পাত্রী দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের মেয়ে—পড়াশোনায় সাদামাটা, খুব একটা মিশুক নয়, জীবনের প্রতি উদাসীন। কিন্তু তখন আর কিছু ভাবার সুযোগ ছিল না। দাদা-বৌদিরা বলল, “সময় নেই। যত তাড়াতাড়ি হয়, বিয়েটা দিয়ে ফেল।” যেন মৃত্যু আর বিয়ে পাশাপাশি চলতে পারে একসাথে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে।

বিয়ের পরদিনই প্রিয়াংশু তার নতুন বউকে নিয়ে নার্সিং হোমে গেল বাবাকে দেখাতে। হাতে ফুল, বুকের ভিতর চাপা কষ্ট—এই তো নতুন এক জীবন শুরু করল, কিন্তু সেই মুহূর্তে পাশে নেই কোনো আনন্দ, কোনো উত্তেজনা। শুধু চুপচাপ এক দায়িত্ববোধ।

বাবা চুপ করে ছিলেন। প্রিয় মুখগুলোকেও চিনতে পারলেন না তিনি। চোখ ঘোলাটে, শরীর নিস্তেজ, ঠোঁট নড়ল না। যেন জীবনের সব কথার উত্তর দিয়ে ফেলেছেন আগেই।

তিন দিন পর বাবা চলে গেলেন। নিঃশব্দে। কোনো কথা না বলে।

এরপর? এরপর যেন দ্রুত পাল্টে গেল সব কিছু। দাদা-বৌদিরা বাড়ির হিসেব-নিকেশ করতে বসে গেল। প্রত্যেকের নামের পাশে জমির একরেক জমি, নগদের খতিয়ান, পুরনো আসবাবপত্র, এমনকি গাছগাছালির হিসেবও তৈরি হয়ে গেল। যেন সংসার নয়, এটা একটা কোম্পানি যার শেয়ার ভাগ হচ্ছে।

সবশেষে প্রিয়াংশুর হাতে রইল একটুকরো ছোট ঘর, বারান্দা, মা আর নতুন বউ। সেই থেকেই শুরু এক অন্য জীবন—যেখানে স্বপ্ন নেই, আছে শুধুই দায়িত্ব।

অধ্যায় ২: মুখোশের আড়ালে মানুষ

প্রথম কয়েকটা দিন শান্তভাবেই কাটল। নববধূ নিজের মতো গুছিয়ে নিল সংসার। কিন্তু কিছুদিন পর থেকেই প্রিয়াংশুর চোখে পড়তে লাগল কিছু অস্বাভাবিকতা। প্রথমে ভেবেছিল—সম্ভবত মানিয়ে নিতে অসুবিধা হচ্ছে, নতুন পরিবেশে এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু বিষয়টা দিনে দিনে অদ্ভুত হতে শুরু করল।

হঠাৎ হঠাৎ রেগে ওঠা—একেবারে ক্ষুদ্র কারণে, কখনও কখনও কারণ ছাড়াই। আবার ঘণ্টার পর ঘণ্টা চুপ করে বসে থাকা—চোখে একধরনের শূন্য দৃষ্টি, যেন কোথাও নেই সে। কখনও আবার মধ্যরাতে উঠে এসে অজানা কোনও চরিত্র নিয়ে কথা বলা, কিংবা নিঃসন্দেহ ভঙ্গিতে এমনসব গল্প বলা যা বাস্তবে ঘটেইনি—সব মিলিয়ে প্রিয়াংশু ধীরে ধীরে অনুভব করতে লাগল, কিছু একটা ঠিক নেই।

প্রথমে ভয় পেল। তারপর সাহস করে মায়ের সাথে কথা বলল। মা শোনার পর কেবল বলেছিলেন, “ভয় পাস না, তোরা একা নয়।” সেই কথাটা যেন প্রিয়াংশুর ভিতরে নতুন এক শক্তি জোগাল। স্ত্রীকে নিয়ে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে গেল।

কয়েকবারের সেশনের পর চিকিৎসক জানালেন, রোগটি বাইপোলার ডিজঅর্ডার—একধরনের মানসিক অসামঞ্জস্য, যেখানে রোগীর মনের আবহাওয়া হঠাৎ করে রোদ থেকে ঝড়ে পরিণত হয়। কখনও অতিরিক্ত উত্তেজনা, কখনও তীব্র হতাশা—এ যেন মনোসংসারের দোলাচল।

প্রিয়াংশু চুপ করে শুনল সব কথা। মুখে না থাকলেও চোখে লেখা ছিল একটাই প্রশ্ন—“তাহলে আমাকে কেউ জানাননি কেন?”

চিকিৎসক বললেন, “অনেক সময় পরিবার লুকিয়ে রাখে, বিয়ের সময় এসব বলা হয় না। সমাজ এখনও মানসিক রোগ মানে ‘পাগলামি’ ভেবে চুপ করে থাকে।”

প্রিয়াংশুর মনের ভিতর হঠাৎ একটা কষ্টের ঢেউ উঠল—এই মেয়েটাও তো নিজে চায়নি এমন জীবন। তাকেও ঠকানো হয়েছে, সমাজের মুখে ঢেকুর তুলে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়েছে একজন অচেনা ছেলের সাথে। সে হয়তো ভালোবাসতে পারত, একটা স্বাভাবিক সংসার গড়তে পারত—কিন্তু তার আগে কেউ তার কথা শুনলই না।

মা সেদিন ছেলের পাশে শক্ত পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। বললেন, “চিন্তা করিস না। সময় মতো ও ভালো হয়ে যাবে। আমাদেরই শক্ত থাকতে হবে।”

চিকিৎসা চলতে লাগল। ওষুধ, থেরাপি, নিয়ম মেনে চলা—সব মিলিয়ে এক নতুন লড়াই শুরু হলো। এরই মাঝে, একদিন মা বললেন, “দেখ, যদি কখনো সন্তান নেবার কথা ভাবিস, ভেবেচিন্তেই নিস। তবে একটাও আশ্চর্য কথা শুনেছি—অনেক সময় মায়ের ভূমিকা অনেক কিছু বদলে দেয়।”

প্রিয়াংশু অনেক ভেবে সেই পথটাই নিল। সন্তানের চিন্তাটা যেন একটা নতুন আলো হয়ে ঢুকে এল তার মনোপুরীতে। ভাবল, হয়তো নতুন প্রাণ আসলে, স্ত্রীর মনও স্থির হবে। মাতৃত্বের টানে জেগে উঠবে নতুন অনুভব, নতুন চেতনা।

কিন্তু ভাগ্য কি সত্যিই সে আলো দেখাবে?

এখনও সে উত্তর অজানা।

অধ্যায় ৩: নোনতা জল আর ভাঙা হাসি

তিন বছরের প্রতীক্ষার পরে অবশেষে পৃথিবীর আলোয় এলো একটুকরো আলো—একটি ফুটফুটে কন্যাসন্তান। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল, যেন সব ব্যথা, সব গুমরে থাকা কান্না এক মুহূর্তে থেমে গেছে। শিশুটিকে কোলে নিয়ে প্রিয়াংশুর চোখ জলে ভরে উঠল—কিন্তু তা ছিল এক অন্য রকম জল, এক ধরনের বিজয়ের কান্না।
নাম রাখা হলো “নিমেষা”—প্রিয়াংশুর নিজের লেখা একটি কবিতার শব্দ, যার মানে সে দিয়েছিল—”যার চোখে এক নিমেষেই হারিয়ে যাওয়া যায়”। সত্যিই তো, সেই ছোট্ট চোখ দুটোতে তাকালেই মনে হতো, পৃথিবী আবার নতুন করে শুরু করা যায়।

বাচ্চার জন্ম যেন কিছুদিনের জন্য ঘরের বাতাস বদলে দিল। স্ত্রীর মুখেও মাঝে মাঝে হাসি দেখা যেত, যদিও তা ছিল ক্ষণস্থায়ী—একটা মুখোশের মতো।
প্রিয়াংশু ভাবত, “হয়তো এবার বদল আসবে, এবার ও নিজেকে খুঁজে পাবে।” কিন্তু পরিবর্তনের আশায় বুক বাঁধা মানুষই তো সবচেয়ে বেশি ব্যথা পায়।

সময় যত এগোল, স্ত্রীর মানসিক অবস্থাও ততটাই পিছোতে লাগল। ওষুধ, থেরাপি, যত্ন—সব কিছু সত্ত্বেও যেন ভিতরের ভাঙন থামছিল না। কখনও স্ত্রীর চোখে কৃতজ্ঞতা দেখা যেত, কিন্তু মুহূর্তেই তা ঘৃণায় রূপ নিত। কখনও কোলে থাকা নিমেষাকে হঠাৎ ছুঁড়ে ফেলে দিতে চাইত, কখনও নিজেই একঘণ্টা ধরে বিছানার কোণে বসে কাঁদত—কারণ অজানা।

এই কঠিন সময়ে প্রিয়াংশুর একমাত্র ভরসা ছিল তার মা। তিনিই সব সামলে নিতেন—স্ত্রীর খেয়াল রাখা, বাচ্চাকে আগলে রাখা, ছেলে যাতে একটু ঘুমোতে পারে সেই ব্যবস্থা করা। আর প্রিয়াংশুর দিকে তাকিয়ে বলতেন, “তুই শুধু হাল ছাড়িস না, বাবা। তোর জন্যই ও দু’জন আছে। তুই নেই তো, ওরা হারিয়ে যাবে।”

কিন্তু ভাগ্য এমন এক কৌশলী খেলোয়াড়, যে ঠিক তখনই আঘাত করে যখন মানুষ একটু ভরসা করে বসে।

এক সকালে প্রিয়াংশু ঘুম ভাঙতেই দেখল মা উঠে আসেননি। ডাকতে গিয়ে পেল—তিনি নিঃশ্বাস ফেলছেন না। হার্ট অ্যাটাক। সবকিছু যেন নিঃশব্দে ভেঙে পড়ল। মায়ের শরীরটা জড়িয়ে ধরে সে চিৎকার করল, কিন্তু কোনও সাড়া এল না।

মা ছিলেন সেই শেষ ছায়াটুকু, যেটুকু ছায়ায় দাঁড়িয়ে সে ঝড় সামাল দিত। সেই ছায়াটাও চলে গেল। আর জীবনের মাটিতে নেমে এল একেবারে ধুলো।

মায়ের অন্ত্যেষ্টির পর যখন সবাই চলে গেল, তখন সেই বাড়িটা কেমন যেন শূন্য লাগল—শব্দহীন, প্রাণহীন এক খোলা খাঁচা। আত্মীয়রা ধীরে ধীরে দূরত্ব তৈরি করল। এক একজন বলল, “তোর তো এখন অনেক দায়িত্ব, আমরা ফোনে কথা বলব।” বন্ধুরা ব্যস্ত—কেউ অফিসে, কেউ বিদেশে, কেউ সংসারে। কারো আর সময় নেই শুনতে, “আমি ঠিক নেই” এই সহজ বাক্যটাও।

প্রিয়াংশু দিন-রাত একটা সাইকেলের চাকা হয়ে ঘুরে চলল—স্ত্রীর ঔষধ, নিমেষার দুধ, স্কুল ভর্তি, বাজার, রান্না, পরিষ্কার, রাতে স্ত্রীর চিৎকার… এবং নিঃশব্দ কান্না।

সে নিজেই বুঝতে পারত—সে আর হাসে না। মুখে হাসি থাকলেও তা ভাঙা, তাতে শব্দ নেই। চোখে জল আসত না, কিন্তু বুকের ভিতরে যেন এক সমুদ্র জমে উঠত—নোনতা জল। সেই জলে ডুবে থাকত সে প্রতিদিন, প্রতি রাত।

এক রাতে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে বলেছিল, “তুই এখন আর মানুষ না, একটা অভ্যাস মাত্র।”

তবু বাঁচতে হয়। কারণ নিমেষা ঘুম ভাঙলে জিজ্ঞেস করে, “বাবা, আজ আমায় স্কুলে তুমি নিয়ে যাবে তো?”

আর প্রিয়াংশু শুধু মাথা নেড়ে বলে, “হ্যাঁ মা, আমি তো আছিই।”

আসলে, সে তখনও বাঁচে না, বাঁচার ভান করে।

অধ্যায় ৪: আটকে পড়া দিনগুলি

প্রিয়াংশুর দিনটা আর কবে নিজের মতো ছিল, সে নিজেও মনে করতে পারে না। এখন তার প্রতিটা সকাল শুরু হয় একটা ঘড়ির কাঁটার মত—নিয়মিত, তাড়াহুড়োয় ভরা, আর নিঃস্বার্থ দায়িত্বে জড়িয়ে।

ভোরের আলো ফোটার আগেই তার ঘুম ভাঙে। ঘুম ভাঙা মানেই যুদ্ধ শুরু।
নিমেষাকে ঘুম থেকে তুলে আদর করে কোলে বসিয়ে বলে, “তাড়াতাড়ি ওঠো মা, তোমার স্কুল আছে আজ।”
মেয়েটার ছোট্ট মুখে তখন অর্ধেক ঘুম, অর্ধেক হাসি। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে প্রিয়াংশু এক মুহূর্ত ভুলে যায় সবকিছু—স্ত্রীর অসুস্থতা, অফিসের চাপ, একাকীত্ব।

তারপর শুরু হয় ব্যস্ততা—নিমেষার ইউনিফর্ম পরানো, চুল বাঁধা, খাবার খাওয়ানো, হোমওয়ার্ক চেক করে দেওয়া, ব্যাগ গুছিয়ে স্কুলে পৌঁছে দেওয়া। একদিকে মেয়ের দায়িত্ব, আরেকদিকে স্ত্রীর।
ওর স্ত্রী তখন বিছানায়। কোনওদিন চুপ করে ছাদে তাকিয়ে থাকে, কোনওদিন হঠাৎ রেগে চিৎকার করে—“তুমি আমায় বোঝো না! তোমরা সবাই আমায় ফেলে চলে যাবে।”
প্রিয়াংশু চুপ করে। কারণ ও বোঝে, তার স্ত্রী এসব বলছে রোগের চাপে—not from the heart.

বিছানার পাশে ওষুধের পাতা, জল, বিস্কুট বা নরম খিচুড়ি রেখে দিয়ে সে বের হয় অফিসে। কিন্তু অফিস মানেই কাজ না, বরং দুশ্চিন্তার আরেক নাম।

সারাদিনে অন্তত পাঁচবার ফোন হাতে নিয়ে ভাবে—“মা স্কুলে পৌঁছেছে তো?”, “স্ত্রী ঠিক আছে তো?”, “চুলা বন্ধ করেছে তো?”, “কেউ দরজাটা খুলে দিল তো ওকে?”
মন পড়ে থাকে বাড়িতে, শরীর অফিসে। মনের এই ছিঁড়ে-যাওয়া অবস্থায় সে কাজ করে—কারণ দরকার টাকা। কারণ নিমেষার স্কুল ফি দিতে হয়, স্ত্রীর চিকিৎসা চালাতে হয়, সংসার টানতে হয়।

এত কিছুর মাঝেও নিয়ম ভেঙে যায় অনেক দিন।
কখনও হঠাৎ ফোন আসে প্রতিবেশীর—
“প্রিয়াংশু, তোমার স্ত্রী আমাদের বাড়ির বারান্দায় এসে বসে আছে। কাঁদছে। কিছু বলছে না।”
কখনও আবার—
“তোমার রান্নাঘর থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। চুলা জ্বালিয়ে রেখে চলে গেছে।”
এইসব ফোন পেয়ে অফিস থেকে দৌড়ে বাড়ি আসে সে। কেউ অভিযোগ করে না, কিন্তু করুণার চাহনি ওর গায়ে ধাক্কা মারে।

প্রতিদিন এইভাবে নিজেকে ভাগ করতে করতে, ছিঁড়ে ফেলতে ফেলতে প্রিয়াংশু বুঝে গেছে—এটা কোনও জীবন নয়, এটা একটা চাকরি যেখানে কোনও ছুটি নেই, কোনও প্রশংসা নেই, নেই অবসর।

এমন নয় যে সে হাঁপিয়ে ওঠে না। সে চায়—কেউ একবার তার চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করুক, “তুমি কেমন আছো?”
কিন্তু কেউ করে না।

সন্ধ্যেবেলায় যখন নিমেষাকে কোলে নিয়ে বসে থাকে, তখন সে বুঝতে পারে, দিনের একমাত্র আলো এই শিশুটাই। কিন্তু সেই আলোও মাঝে মাঝে চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দেয়—কারণ সে জানে, নিমেষার ভবিষ্যৎ কীভাবে রক্ষা করবে, সেটা সে নিজেও জানে না।

একটা রাত, ও একা বসে লিখে রাখল ডায়েরিতে—

“আমার দিনগুলো আটকে আছে একটা লুপে—যেখানে কেউ মুক্তি দেয় না, আর আমি নিজেও পালাতে জানি না। বাঁচছি না, শুধু চলছি। প্রতিদিনই নিজেকে হারাচ্ছি একটু একটু করে…”

অধ্যায় ৫: আলোর রেখা

সব আলো নিভে গেলে, মানুষের জীবন একরকম অন্ধকার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু সেই অন্ধকারেও যদি একটা ছোট্ট আলো জ্বলে ওঠে, সেটাই হয় আশার রেখা। প্রিয়াংশুর জীবনে সেই আলো—নিমেষা।

ছোট্ট, নিস্পাপ মুখ। চোখদুটোতে যেন সদ্য উঠা সকালের রোদ। ওর মুখের দিকে তাকালেই প্রিয়াংশুর মনে হয়—“জীবনটা হয়তো পুরোটা হারিয়ে যায়নি। এখনও কিছু রয়ে গেছে।”

নিমেষা, প্রায় অলৌকিক বুদ্ধিতে বড় হচ্ছে। হয়তো তার ছোট জীবনে প্রচুর কষ্ট সে নিজেও বুঝে গিয়েছে। বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে সে বুঝে যায়, আজ রান্নায় লবণ কম হয়েছে, বাবার চোখের নিচে কালি কেন? এমনকি কখনও বলে ফেলে—
“তুমি সারাদিন এত চিন্তা করো কেন বাবা? আমি তো তোমার পাশেই আছি।”

এই কথা শুনে প্রিয়াংশুর বুকের ভেতরটা ধক করে ওঠে। নিজের ভিতরের কষ্ট সে যতই লুকাক, মেয়েটা বুঝে যায়।
কখনও প্রিয়াংশুর ঘরে চুপচাপ ঢুকে একটা ছবি ধরে, ছবিতে আঁকা—একটা বড়সড় হাসি মুখের মানুষ, আর পাশে দাঁড়িয়ে একখানি ছোট্ট মেয়ে। নিচে লেখা—
“তুমি হাসো না কেন, বাবা?”

প্রিয়াংশুর চোখে জল আসে। তবু সে হেসে ওঠে। ও জানে, নিমেষার সামনে সে ভাঙতে পারে না। তার একমাত্র দায়িত্ব এখন এই মেয়েটাকে আগলে রাখা, নিজের সব ক্লান্তি গিলে ফেলে মেয়েকে একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেওয়া।

নিমেষার প্রতিটি পদক্ষেপ যেন আলোর ছোঁয়া।
সে শুধু পড়াশোনায় ভালো নয়—সে গান গায়, আঁকে, আবৃত্তি করে। শিক্ষকরা অবাক হয়ে বলেন, “এই বয়সে এত অনুভব কীভাবে আসে ওর মধ্যে?”
কেউ জানে না, ছোট্ট মেয়েটার জীবনেই যেন ছায়া আর আলো পাশাপাশি হেঁটে চলে।

প্রিয়াংশু রাতে চুপচাপ মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে পাশে বসে থাকে। মেয়ের মাথায় হাত রেখে ভাবে—
“এই মেয়েটার জন্যই তো বেঁচে আছি আমি। ও যদি না থাকত…”

ও বুঝে গেছে, জীবনের অন্ধকার যতই গভীর হোক না কেন, একটামাত্র ভালোবাসার চোখ, একটামাত্র ছোট্ট হাসি সেই অন্ধকার কেটে ফেলতে পারে।

তাই ও এখন আর নিজেকে একা ভাবে না।
ও ভাবে, “আমার মেয়েটা যদি আলো হয়ে আমার চারপাশে থাকে, তাহলে আমি অন্ধকারে হারিয়ে যাব না।”

অধ্যায় ৬: ভিতর থেকে ভেঙে পড়া

জীবনের এমন কিছু মুহূর্ত আসে, যখন মানুষ বোঝে—ভালোবাসা থাকলেও একা সামলে রাখা যায় না সব কিছু। প্রিয়াংশুর জীবন সেই দ্বিধা আর দায়িত্বের জটিল মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে।

সেদিনটা অন্যরকম ছিল। অফিস থেকে ফিরেই শুনল, স্ত্রীর আচরণ আজ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। রান্নাঘরে তান্ডব করে বসে আছে। হাতের কাছে যা পেয়েছে, ছুঁড়ে ফেলেছে—প্লেট, গ্লাস, চায়ের কাপ। একটা কাঁচের ফুলদানি এসে সোজা প্রিয়াংশুর কাঁধে লেগে চুরমার। রক্ত ঝরছিল সামান্য, কিন্তু তার চেয়েও যেটা বেশি যন্ত্রণা দিচ্ছিল—তা হলো ভেতরের ক্ষয়, নিজের স্ত্রীকে এই অবস্থায় দেখে অসহায়তা।

সেদিন রাতেই প্রিয়াংশু জানলার ধারে বসে ছিল অনেকক্ষণ। নিমেষা তখন পাশের ঘরে ঘুমোচ্ছিল। বাতাসে মিশে ছিল স্ত্রীর অদ্ভুত গলার আওয়াজ—কখনও গুনগুন, কখনও কেঁদে ওঠা, কখনও নিঃসাড় চুপ করে থাকা। ওর মাথায় তখন শুধু একটা কথাই ঘুরছিল—এই অবস্থা যদি আরও খারাপ হয়? যদি নিমেষা কখনও বিপদে পড়ে? যদি একদিন আমি না থাকি?

বুকের ভেতরটা ভেঙে যাচ্ছিল তবুও…
অবশেষে সিদ্ধান্ত নিল—আর নয়।

ও জানত, এই সিদ্ধান্ত নেওয়া মানে স্ত্রীকে কিছুটা ছেড়ে দেওয়া। কিন্তু নিরাপত্তার দিকটা তার কাছে এখন বড়। একা একা এই মানসিক ভার আর বহন করা সম্ভব না। বহু জায়গায় খোঁজ নিয়ে, পরামর্শ নিয়ে, চোখে জল নিয়ে একদিন ও স্ত্রীকে নিয়ে গেল শহরের এক নামী বেসরকারি মানসিক পরিচর্যা কেন্দ্রে।

ভর্তি করার সময় ওর স্ত্রীর চোখে একরাশ অনিশ্চয়তা, হতাশা, আর ক্ষোভ। তিনি চিৎকার করছিলেন—
“তুই আমাকে ফেলে দিচ্ছিস?”
“আমি তোর বোঝা হয়ে গেছি?”

প্রিয়াংশু সেদিন কিছু বলেনি। শুধু হাত ধরে চুপ করে বসে ছিল, শেষবারের মতো। চোখ দুটো জলেভেজা, কিন্তু মুখে একটাও শব্দ নেই। ওর ভিতরটা যেন ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ছিল… নিঃশব্দে।

চোখের কোনা মুছে সেদিন যখন সে বাড়ি ফিরল, নিমেষা দৌড়ে এসে জিজ্ঞেস করল—
“মা কোথায়?”

প্রিয়াংশু তখন হালকা হাসির অভিনয় করে বলল—
“তোমার মা একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছিল রে। তাই ওকে সুস্থ হতে এক জায়গায় রেখেছি। তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে।”

নিমেষা বিশ্বাস করে নিল। মাথা নিচু করে বলল—
“তুমি কাঁদছিলে বাবা?”
প্রিয়াংশু চমকে উঠল।
“না তো… ধুলো ঢুকেছিল চোখে।”
নিমেষা কিছু না বলে বাবার পাশে এসে বসে রইল। একটু পরেই বলল—
“আমি মায়ের জন্য একটা ছবি আঁকবো। তুই ওকে দিয়ে আসবি?”

প্রিয়াংশু তখন চোখের জল লুকিয়ে মেয়ের মাথায় হাত রাখল। বলল না কিছুই। শুধু মনে মনে বলল—
“ভালোবাসা মানে কখনও কখনও ছেড়ে দেওয়াও।”

সে রাতে, জানালার পাশে বসে, প্রিয়াংশু অনুভব করল—তার ভেতরের একটা বড় অংশ যেন চিরতরে ভেঙে পড়েছে। কিন্তু মেয়ের ছোট্ট হাত তার হাতের উপর পড়তেই সে আবার একটু সোজা হয়ে বসল।

এই ভাঙা ভিতরের মধ্যেও যদি দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, সে দাঁড়াবে—কারণ সে একজন বাবা।

অধ্যায় ৭: নতুন ভোরের দিকে

সময় সত্যিই বদলে দেয় অনেক কিছু—কিন্তু সব কিছুকে নয়। কিছু ক্ষত থেকে যায়, কিছু অভ্যাস গড়ে ওঠে। প্রিয়াংশুর জীবন আজ যেন এক নিঃশব্দ যুদ্ধের নাম, যেখানে প্রতিদিন সকাল হয় শুধু মেয়ের মুখ দেখে, আর সন্ধ্যাটা কাটে একাকিত্বের সাথে বোঝাপড়া করে।

তবে এক নতুন রুটিনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে সে। অফিস থেকে ফিরে আর আগের মতো ক্লান্ত দেহে সোফায় গিয়ে পড়ে না। এখন সে ফিরেই এক গ্লাস জল খেয়ে বসে পড়ে নিমেষার পাশে। ছোট্ট মেয়েটা তখন তার স্কুলের দিনের গল্প বলে, আঁকা ছবি দেখায়, অথবা অদ্ভুত কিছু প্রশ্ন করে—“মানুষ কাঁদে কেন বাবা?” বা “আকাশের ওপাশে কি সত্যিই কেউ থাকে?”

প্রিয়াংশু সব প্রশ্নের উত্তর জানে না, কিন্তু সে চেষ্টার ত্রুটি রাখে না। কখনও গল্প বানিয়ে বলে, কখনও বই থেকে পড়ে শোনায়, কখনও গলা চেপে ধরা কষ্ট লুকিয়ে ছোট্ট একটা গান গায়—নিমেষার প্রিয় রাগিণীতে। মেয়ের হাসিই এখন ওর জন্য সবচেয়ে বড় সান্ত্বনা।

সপ্তাহে একদিন সে যায় স্ত্রীর কাছে। নির্ধারিত সময়, নির্ধারিত চেম্বার, নির্ধারিত নিয়মের মধ্যে স্ত্রীর সামনে বসে। কোনওদিন চোখ তুলে তাকায় না সে, কোনওদিন হঠাৎ বলে ওঠে—“তুই কে?” আবার কোনওদিন চুপচাপ জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে, যেন কিছু একটা মনে করার চেষ্টা করছে।

প্রিয়াংশু আজকাল আর কষ্ট পায় না। এখন আর স্ত্রীর সেই অচেনা চোখ দেখে অস্বস্তি হয় না। বরং সে ভাবে—এই মানুষটার মধ্যেও তো এক সময় একরাশ স্বপ্ন ছিল, ভালোবাসা ছিল, হাসি ছিল। এখন শুধু সেগুলো মুছে গেছে মনের কোনও অচেনা গোলকধাঁধায়।

প্রিয়াংশু এখন কাউকে দোষ দেয় না, কাউকে অভিযোগ করে না। এই জগতের প্রতি, জীবনের প্রতি তার অভিযোগ ফুরিয়ে গেছে অনেক আগেই। সে বুঝেছে, জীবন মানেই সব কিছু পাওয়া নয়, বরং যা হারায়, তার মধ্যেও কিছু একটা রেখে যাওয়া।

ও এখন জানে, তার সব পাওয়া আর চাওয়ার কেন্দ্রে শুধু একটি নাম—নিমেষা।
মেয়েটার চোখে আজকাল প্রিয়াংশু নিজের হারানো আনন্দ খুঁজে পায়। ওর নির্ভরতা, ওর মায়া, ওর জিজ্ঞাসা যেন একটা নরম আলোয় ঢেকে রাখে প্রিয়াংশুর ক্লান্ত হৃদয়টাকে।

মাঝেমধ্যে প্রিয়াংশু ভাবতে বসে—একদিন নিমেষা বড় হবে। তখন এই সমস্ত গল্প জানবে, অনুভব করবে বাবার নিঃশব্দ লড়াই। হয়তো একদিন বলবে—

“তোমার মতো বাবা পাওয়া ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভাগ্য।”

প্রিয়াংশু তখন মাথা নিচু করে শুধু বলবে—

“আলো যদি জ্বলে থাকে, তাহলে আর কিছু প্রয়োজন হয় না।”

সেই আলোই ওর নতুন ভোরের পথ দেখায়, প্রতিদিন।

শেষ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *