গল্পের নাম : সাজের আড়ালে

লেখক : পিনাকী রঞ্জন পাল

নিবেদিতার বিয়ে বলে বাড়িতে উৎসবের আমেজ। বাঙালির ঘরে বিয়ের আয়োজন মানেই মহা ধুমধাম, আনন্দ, আর সবার সাজগোজ। বাড়িতে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব সবাই হাজির। নিবেদিতার বিয়ে বাড়ি যেন সাজের প্রতিযোগিতার মঞ্চ হয়ে উঠেছে। পাড়ার লোকজন থেকে শুরু করে দূরদূরান্ত থেকে আসা আত্মীয়রা সবাই এই বিয়ে নিয়ে উত্তেজিত।

বাড়ির সবচেয়ে ছোট মেয়ে, নয় বছরের ঝিল্লি, সে সকাল থেকেই তৎপর। কারা কীভাবে সেজেছে তা দেখতে সে সারাদিন একঘর থেকে আরেক ঘর ঘুরে বেড়াচ্ছে। এদিকে তার মায়ের নির্দেশ—যে ঘরে যাবে, সেখানে কিছু না ছুঁয়ে শুধু দেখবে। ঝিল্লি আদুরে মেয়ে, সকলেই তার ছোট ছোট প্রশ্ন আর হাসিখুশি মুখের জন্য ভালোবাসে। তাই আজ তাকে কেউই বকছে না, বরং সবাই স্নেহের চোখে দেখছে।

সেজেগুজে সবার ঘরে ঘুরতে ঘুরতে ঝিল্লি হঠাৎ ঢুকল ছোটো কাকিমনির ঘরে। ছোটো কাকিমনি মানে রীতা, যার বয়স পঁচিশের বেশি হবে না। রীতা খুব সুন্দরী এবং সব সময়ই অন্যদের চোখে পড়ে। কিন্তু আজ তার ঘরে ঢুকতেই ঝিল্লির কেমন যেন একটু অবাক লাগল। ছোটো কাকিমনি অন্যদের মতো রঙিন শাড়ি বা সেজেগুজে বসে নেই। বরং তার পরনে সাদা রঙের শাড়ি আর খুবই সাদামাটা পোশাক। চোখে কোনো কাজল নেই, কপালে টিপ নেই। এমনকি রীতার মুখেও কোনো রঙ নেই আজ। ঝিল্লির মন খারাপ হয়ে গেল।

ঝিল্লি কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল, তারপর আচমকাই জিজ্ঞাসা করল, “ছোটো কাকিমনি, তুমি কেন সাজছ না? সবার মতো তো তোমারও সাজা উচিত!”

রীতা একটু বিষণ্ণ হাসি দিয়ে বলল, “আমি তো সাজতে পারবো না রে সোনা, তোর কাকু যে আর নেই।”

ঝিল্লি সরল মনের মেয়ে, সে বোঝে না এত কিছু। তাই আবার প্রশ্ন করল, “কাকু নেই, তাই তুমি সাজবে না?”

“হ্যাঁ, মা। ও নেই, তাই আর এই সাজগোজ আমার জন্য না,” রীতা আস্তে করে উত্তর দিল।

ঝিল্লি কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেল। তার ছোটো মাথায় অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল। কিন্তু সে কিছু না বলে আবার অন্য ঘরে চলে গেল।

এরপর ঝিল্লি গেল মেজোকাকুর ঘরে। মেজোকাকু, অর্থাৎ অরুণ কাকু, বেশ রঙিন শেরওয়ানি পরে বিয়ের সাজে তৈরি হচ্ছেন। গলায় মুক্তোর তিনছড়া হারটা ঝুলছে, হাতে মোটা চার-পাঁচটা আংটি। তিনি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চুল ঠিক করতে ব্যস্ত।

ঝিল্লি মুগ্ধ চোখে মেজোকাকুর সাজগোজ দেখতে লাগল। কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে তার দৃষ্টি হঠাৎ ঘরের দেওয়ালের দিকে গেল। সেখানে মেজো কাকিমনি অর্থাৎ রিনির ফটো ঝোলানো, ফটোতে মালা ঝুলছে। সামনে ধুপকাঠি জ্বলছে। রিনির মৃত্যু হয়েছিল দুবছর আগে, এক দুর্ঘটনায়। তখন থেকেই মেজো কাকিমনির এই ফটোটা এখানে রাখা। ছোট্ট ঝিল্লি কিছুদিন পরেই ঘটনাটা ভুলে গেছে, কিন্তু আজ সেই ফটো দেখে তার মনে সব আবার ভেসে উঠল।

সে আর চুপ করে থাকতে পারল না। সরাসরি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল, “মেজোকাকু, তুমি কেন এতো সাজছ? মেজো কাকিমনি তো আর নেই!”

অরুণ কাকু যেন মুহূর্তের জন্য থমকে গেলেন। ঝিল্লির সরল কথাটা তার হৃদয়ের গভীরে গিয়ে আঘাত করল। কিছুক্ষণের জন্য তার মুখের হাসি ফিকে হয়ে গেল, কিন্তু তিনি নিজেকে সামলে নিলেন। মৃদু হেসে বললেন, “তোর কাকিমনি নেই, কিন্তু আমি তো আছি। জীবন তো থেমে থাকে না, ঝিল্লি। আমাকেও তো চলতে হবে। এটাই নিয়ম।”

ঝিল্লি বোবা হয়ে গেল। ছোটো কাকিমনি কাকু না থাকায় সাদা শাড়ি পরে আছেন, সাজগোজ করতে পারেন না। কিন্তু মেজোকাকু মেজো কাকিমনি না থাকলেও সাজছেন, উৎসবের অংশ হচ্ছেন। সমাজের এই বৈষম্য, এই দুই ছবির ভিন্নতা তার ছোট্ট মনের গভীরে এক অদ্ভুত প্রশ্নের জন্ম দিল।

বিয়ের বাড়িতে আনন্দমুখর পরিবেশ, সবার হাসি-মজা চলছে। ঝিল্লি কিন্তু গুম হয়ে গেল। তার ছোট্ট মনটা এই বিষয়টা কিছুতেই মেলাতে পারছে না। কেন কাকিমনি কাকুর অভাবে আর সাজতে পারেন না, অথচ মেজোকাকু কাকিমনির অভাবে রঙিন শেরওয়ানি পরে ঘুরে বেড়ান? মেয়েরা বিধবা হলে কেন সাদা শাড়ি, নিঃসঙ্গতা আর গ্লানি নিয়ে বাঁচে, আর ছেলেরা স্ত্রীর মৃত্যুর পরও কেন রঙিন জীবনের আনন্দ উপভোগ করে?

এই প্রশ্ন ঝিল্লির কচি মনে গভীর দাগ কেটে গেল। হয়তো তখনই সে প্রথমবার সমাজের এই বৈষম্যের সঙ্গে পরিচিত হলো। সে বুঝল, সমাজটা শুধু সাজের পার্থক্য দিয়ে পুরুষ আর নারীর জীবনের ভিন্নতা নির্ধারণ করে।

শেষ

© পিনাকী রঞ্জন পাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *