লেখক : পিনাকী রঞ্জন পাল
রাত গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে, আর নীলাভ রায় তার ল্যাপটপের স্ক্রিনে চোখ গেঁথে বসে আছে। পর পর মেইল আসছে, মিটিংয়ের নোটিফিকেশন, সোশ্যাল মিডিয়ার ঝলমলে আপডেট—সবকিছুতে ডুবে গেছে সে। নীলাভ একটা বড় কর্পোরেট অফিসে চাকরি করে, যেখানে তাকে প্রতিদিন অসংখ্য অনলাইন কাজ করতে হয়। দিনের পর দিন সে এই অনলাইন দুনিয়ায় বুঁদ হয়ে আছে, যেন একটা কাল্পনিক জগতের মধ্যে সে হারিয়ে গেছে।
নীলাভের স্ত্রী তৃণা, অনেকদিন ধরেই লক্ষ্য করছে যে নীলাভ এখন আর আগের মতো নেই। ওদের মধ্যের কথোপকথনগুলোও যেন আর আগের মতো প্রাণবন্ত নয়। যখনই কিছু বলতে যায়, নীলাভ হয় মুঠোফোনের দিকে তাকিয়ে থাকে বা ল্যাপটপে মগ্ন থাকে। বাস্তব জীবনের যোগাযোগ যেন তার কাছে গৌণ হয়ে উঠেছে। তৃণা একদিন সাহস করে নীলাভকে বলে উঠল, “তুমি কি জানো, তুমি কেমন দূরে সরে গেছো? আমরা একই ঘরে থেকেও যেন আর কাছাকাছি নেই।”
নীলাভ তখনো মনোযোগ দিল না। “আরে, এই কাজগুলো খুব জরুরি। আজকেই শেষ করতে হবে,” বলে আবার ল্যাপটপের স্ক্রিনে ডুবে গেল। তৃণার মুখের অভিব্যক্তি তখন একটা গভীর হতাশার প্রতিফলন। সে জানে, নীলাভকে এভাবে পেতে হলে তাকে আরো অনেকদিন অপেক্ষা করতে হবে।
তৃণা ভাবল, ‘মানুষ এখন কেমন যেন বদলে যাচ্ছে! সবকিছু যেন অনলাইনে চলছে, কিন্তু সম্পর্কগুলোতে যে তেমন করে আর ভালোবাসার ছোঁয়া নেই, তা বোঝার মতো সময়ও কারো নেই।’
এদিকে নীলাভের অফিসের কাজে ব্যস্ত সময় কাটছিল। প্রতিদিনের চাপে তৃণার সঙ্গে কথাবার্তা আরো কমে গেল। এমনকি তাদের সন্তান, ছোট্ট তুহিনও বাবার কাছে একদম কাছাকাছি আসতে পারত না। তুহিন একদিন মায়ের কাছে এসে বলল, “মা, বাবা কেন আমার সাথে খেলতে আসে না?”
তৃণা তখন ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে শুধু বলল, “বাবা খুব কাজের মধ্যে আছে। একটু অপেক্ষা করো, বাবা আবার আমাদের সঙ্গে সময় কাটাবে।”
কিন্তু তৃণাও জানত, এই অপেক্ষার শেষ কোথায়, কেউ বলতে পারে না। সম্পর্কের মধ্যে একটা অদ্ভুত দূরত্ব তৈরি হচ্ছিল, যা তৃণার মনে ক্রমশ দাগ কাটছিল। তবুও, জীবনের তাড়নায় সে চুপ করে সব সহ্য করে যাচ্ছিল।
এভাবেই চলতে চলতে একদিন হঠাৎই সবকিছু বদলে গেল। নীলাভ হঠাৎ একদিন খবর পেল, তার কলেজের ঘনিষ্ঠ বন্ধু অভিজিৎ মারা গেছে। কয়েক বছর ধরে তারা যোগাযোগ রাখেনি। অনলাইনের দুনিয়ায় বুঁদ হয়ে, বাস্তবিক সম্পর্কগুলোও ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে গিয়েছিল। অভিজিৎকে শেষবার কবে দেখেছিল, তা নীলাভ ঠিক মনে করতে পারল না।
অভিজিতের মৃত্যুর খবরটা তাকে খুব নাড়া দিল। সে প্রথমবারের মতো বুঝল, এই অনলাইন জীবনে হারিয়ে যেতে গিয়ে সে কতটা মূল্যবান মুহূর্ত হারিয়ে ফেলেছে। একসময় যে বন্ধুর সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করত, তার মৃত্যুর খবরও সে এতদিনে জানল।
অভিজিতের শ্রাদ্ধে যাওয়ার সময় নীলাভের মনে পড়ছিল পুরনো দিনের কথা। কলেজে পড়ার সময় কীভাবে তারা একসঙ্গে কাটিয়েছে। সেই আড্ডা, সেই হাসি—সবকিছু যেন স্মৃতির পাতায় বন্দি হয়ে আছে। কিন্তু এখন? সময় বদলেছে, সম্পর্কগুলোও যেন বন্ধুত্বের মধুর রেশ ছেড়ে একেকটা ইমেলের ঠুনকো আড্ডায় পরিণত হয়েছে।
নীলাভ যখন অভিজিতের বাড়িতে পৌঁছল, তখন সেখানে অভিজিতের বাবা-মা কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। নীলাভ তাদের সামনে কিছু বলতেও পারছিল না। তার ভেতরে একটা অপরাধবোধ জেগে উঠল। কতগুলো বছর সে নষ্ট করেছে শুধু অনলাইনের ফাঁদে পড়ে! আসল মানুষগুলোকে সে ভুলেই গেছে।
সেদিন বাড়ি ফেরার পথে নীলাভ ভাবছিল, “আমরা তো এত প্রযুক্তি নিয়ে গর্ব করি, কিন্তু এই প্রযুক্তির আড়ালে লুকিয়ে ফেলে দিচ্ছি আমাদের মানবিক সম্পর্কগুলো। যতই আমরা অনলাইনে যাই, আমাদের মানবতা ততই যেন হারিয়ে যাচ্ছে।”
অভিজিতের মৃত্যু তাকে এক কঠিন শিক্ষা দিয়ে গেল। সে বুঝল, অনলাইনের এই দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী। আসল সম্পর্কগুলোকে ভালোবাসা আর যত্ন দিয়ে রক্ষা করতে হয়। সে সিদ্ধান্ত নিল, এবার থেকে সে নিজের জীবনের ভারসাম্য রাখবে। অফিসের কাজ করবে ঠিকই, কিন্তু বাস্তব জীবনের সম্পর্কগুলোর মূল্য বুঝে সেগুলোর যত্ন নেবে।
নীলাভ এবার ঘরে ফিরে তৃণার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। অনেকদিন পর সে তৃণার দিকে সপ্রেমে তাকাল। তার চোখে একটা নতুন আলোর ছটা ফুটে উঠল। তৃণা অবাক হয়ে নীলাভকে দেখল। নীলাভ বলল, “তৃণা, আমি অনেক কিছু ভুল করেছি। আমি বুঝতে পেরেছি, শুধু অনলাইন দুনিয়ার মধ্যে জীবন কাটিয়ে দিলে আমরা নিজেদের কাছের মানুষদের হারিয়ে ফেলি। এবার থেকে আমি আর এমনটা হতে দেব না।”
তৃণার চোখে জল এসে গেল। সে অনেকদিন ধরেই এই কথাগুলো শোনার জন্য অপেক্ষা করছিল। নীলাভকে জড়িয়ে ধরে বলল, “তুমি ফিরে এসেছো, এটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় কথা।”
পরের দিন থেকে নীলাভ তার সময় ভাগ করে নিতে শুরু করল। অফিসের কাজ করার পাশাপাশি সে প্রতিদিন তৃণার সঙ্গে সময় কাটাতে শুরু করল। তুহিনের সঙ্গে খেলা করতে লাগল। এমনকি পুরনো বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আবার যোগাযোগ করতে লাগল। একসময় যেই বন্ধুত্ব হারিয়ে যাচ্ছিল, তা আবার ফিরে এলো। এখন নীলাভ জানে, শুধু প্রযুক্তিই জীবনের সবকিছু নয়—মানবিক সম্পর্কগুলোই জীবনের আসল সম্পদ।
এই পরিবর্তন শুধু নীলাভের জীবনে নয়, চারপাশের পরিবেশেও প্রভাব ফেলল। তার বন্ধুরা, সহকর্মীরাও অনলাইনের বাইরে গিয়ে আবার একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে শুরু করল। যেন একটা নতুন আলো ছড়িয়ে পড়ল তাদের জীবনে।
মানুষ যতই অনলাইনমুখী হোক না কেন, মানবতা অফলাইনেই আছে। মানুষকে ভুলে গেলে প্রযুক্তি কোনোদিনও আমাদের সেই ভালোবাসা, বন্ধুত্ব আর সম্পর্কের অনুভূতিগুলো ফিরিয়ে দিতে পারবে না। নীলাভের জীবন তাকে সেই শিক্ষাই দিয়ে গেল—প্রযুক্তির দুনিয়া চিরকাল থাকবে না, কিন্তু আমাদের মানবিকতা, ভালোবাসা, আর বন্ধুত্বের সম্পর্কগুলো চিরকাল থাকবে, যদি আমরা সেগুলোর যত্ন নিতে জানি।
শেষ
© পিনাকী রঞ্জন পাল