লেখক : পিনাকী রঞ্জন পাল
প্রথম পর্ব : শহরের রহস্যময় নিখোঁজ
মেঘলা দিন। বাতাসে যেন শীতল হাওয়ার পাশাপাশি এক ধরনের অজানা উত্তেজনা ঘুরছে। ইধিকা সেদিন স্কুল থেকে ফিরছিল, তার মন সদ্য শেষ হওয়া অঙ্কের পরীক্ষার কড়া বিশ্লেষণে ডুবে ছিল। হঠাৎই বাজারের মোড়ে পৌঁছতেই দেখল, শহরের প্রায় সব মানুষ ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। সাধারণত যে বাজারে বিকেল বেলা এক ধরনের কোলাহল থাকে, সেখানে এখন একটি অদ্ভুত নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে।
ইধিকা দ্রুত গতিতে এগিয়ে গেল এবং পায়েল ও অনুরাগকে দেখতে পেল ভিড়ের মধ্যে। ইধিকার মনে সন্দেহ জাগল। কাছে গিয়ে জানতে চাইল, “কী হয়েছে? সবাই এত উত্তেজিত কেন?”
পায়েল বলল, “মনোজ কাকুর মেয়ে সোহিনী হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে গেছে। শেষবার তাকে বাজারের কাছে দেখা গিয়েছিল, তারপর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।”
ইধিকার মাথায় তখনই চিন্তার ঢেউ খেলে গেল। সে বোঝে, এ কোনো সাধারণ ঘটনা নয়। একটা রহস্য লুকিয়ে আছে এর পেছনে। ইধিকা বলল, “চলো, মনোজ কাকুর বাড়ি যাই। ওনার সাথে কথা বলে দেখি আমরা কিছু সাহায্য করতে পারি কি না।”
পায়েল এবং অনুরাগ, ইধিকার সিদ্ধান্তে সম্মতি জানিয়ে তার সাথে রওনা দিল। মনোজ ব্যানার্জীর বাড়ি পৌঁছে দেখল, বাড়ির চারপাশে মানুষজন গিজগিজ করছে। বাড়ির দরজার বাইরে মনোজ কাকু বসে আছেন মাথা নিচু করে। তিনি একপ্রকার অসহায় হয়ে পড়েছেন।
ইধিকা বিনয়ের সাথে বলল, “মনোজ কাকু, আমি ইধিকা। আপনি জানেন, আমি এবং আমার বন্ধুরা ছোটখাটো রহস্য সমাধান করতে ভালোবাসি। সোহিনীর নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় আপনাকে কোনো সাহায্য করতে পারি?”
আরো পড়ুন : গোয়েন্দা গল্প : প্রথম রহস্যের সমাধান
মনোজবাবু এক মুহূর্তের জন্য চুপ করে থাকলেন, তারপর ইধিকার দিকে তাকালেন। তার চোখে কিছুটা আশা দেখা দিল। “ইধিকা, আমি জানি তুমি খুবই বুদ্ধিমতী মেয়ে। যদি সত্যিই কিছু করতে পারো, আমি তোমাদের কৃতজ্ঞ থাকব। সোহিনী… আমার একমাত্র মেয়ে। কীভাবে নিখোঁজ হয়ে গেল কিছুই বুঝতে পারছি না।”
ইধিকা মনোজ কাকুকে শান্ত করল এবং সোহিনীর ঘরটি দেখতে চাইল। মনোজ কাকু তাদের নিয়ে গেল সোহিনীর ঘরে। সেখানে পৌঁছে ইধিকা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব কিছু পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। এক মুহূর্তের জন্য তার চোখ একটা টেবিলের উপর রাখা কাগজের দিকে আটকে গেল। সে কাগজটা তুলে দেখল, সেখানে একটি চিরকুট রয়েছে। চিরকুটে বড় অক্ষরে লেখা: “করলার স্রোতে সব রহস্যের সমাধান হবে।”
দ্বিতীয় পর্ব: করলার তীরে সন্ধান
ইধিকা চিরকুটটি দেখার পর আরও বেশ কয়েকবার তা পড়ল, কিন্তু কিছুই পরিষ্কার বুঝতে পারল না। সোহিনী কি করলার তীরে গিয়েছিল? করলার স্রোত বলতে কি নদীকে বোঝানো হয়েছে? না, এর অন্য কোনো অর্থ রয়েছে? সে মনোজ কাকুকে চিরকুটটি দেখাল।
মনোজবাবু চিরকুটটি হাতে নিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। “আমি জানি না, সোহিনী কেন এমন কিছু লিখবে। তবে করলা নদী অনেক রহস্যের সাক্ষী। অনেক আগে শুনেছি, করলার তীরে একসময় গুপ্তধনের খোঁজ চলত। হয়তো সোহিনী এই ধরনের কিছু জানত। কিন্তু সেটা জানল কীভাবে?”
ইধিকা তার বন্ধুদের নিয়ে ঠিক করল, তারা করলার তীরে গিয়ে খোঁজ নেবে। সন্ধ্যে নেমে আসার আগেই তারা নদীর তীরে পৌঁছাল। করলার স্রোত শান্ত, কিন্তু সেদিন যেন এর মধ্যে এক অদ্ভুত অশান্তির আভাস ছিল। তিনজন বন্ধু নদীর তীর ধরে খুঁজতে থাকল কোনো সূত্রের আশায়। অনেকক্ষণ অনুসন্ধানের পরও কিছুই পেল না। নদীর পাশে অনেক আগাছা জমে আছে, কোথাও একটা পুরনো নৌকা পড়ে আছে—এ সবই যেন সাধারণ দৃশ্য।
তাদের মন কিছুটা হতাশ হয়ে পড়েছিল, কিন্তু হঠাৎই পায়েলের নজরে এল একটি গাছের নিচে কাগজের টুকরো পড়ে আছে। কাগজটি তুলে নিয়ে তারা দেখল, সেটিতে কিছু সাংকেতিক চিহ্ন আঁকা রয়েছে। চিহ্নগুলো ছিল খুবই অদ্ভুত, একে বোঝা কঠিন। ইধিকা কাগজটিকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে বুঝল, এটি একটি মানচিত্র। তবে এর মানে কী?
ইধিকা কাগজটি ভালোভাবে দেখতে দেখতে বলল, “আমার মনে হচ্ছে এটি কোনো পুরনো মানচিত্র, যেটির মাধ্যমে কোনো জায়গা চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু এ মানচিত্র সোহিনীর কাছে এল কীভাবে?”
তৃতীয় পর্ব: রহস্যের মূল সূত্র
ইধিকা, পায়েল, এবং অনুরাগ ঠিক করল যে তারা সোহিনীর বন্ধুদের সাথে কথা বলবে। তারা সোহিনীর স্কুলের কয়েকজন সহপাঠীর কাছে গেল। তাদের মধ্যে একটি মেয়ে জানাল, “সোহিনী প্রায়ই কোনো এক অজ্ঞাত পরিচয়ের মানুষের সাথে দেখা করত। কে সে লোক, তা আমরা জানি না। তবে মনে হচ্ছিল, সে লোকটা সোহিনীর ওপর প্রভাব বিস্তার করতে চাইত।”
এই তথ্য শুনে ইধিকার কৌতূহল বেড়ে গেল। “কীভাবে লোকটিকে দেখতে?” মেয়েটি বলল, “একদিন দূর থেকে দেখেছিলাম, লোকটির মাথায় টুপি ছিল আর মুখটা একটা স্কার্ফ দিয়ে ঢাকা।”
ইধিকা ভাবল, এই রহস্যময় লোকটি কি সোহিনীর নিখোঁজ হওয়ার পেছনে কোনোভাবে জড়িত? সে স্থির করল, তারা শহরের আরো কয়েকজনের কাছে গিয়ে এই লোকটির সম্পর্কে খোঁজ নেবে।
কয়েকজন বয়স্ক মানুষকে জিজ্ঞেস করতেই একজন বললেন, “একদিন করলার পাড়ে আমি সোহিনীকে একজন অচেনা লোকের সাথে দেখেছিলাম। তারা খুব গোপনে কথা বলছিল।”
এই তথ্য শোনার পর ইধিকা বুঝল, তাদের করলার পাড়ে আরেকবার গিয়ে ভালোভাবে অনুসন্ধান করা উচিত। তাদের মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাল যে, এই লোকটি এবং করলার পাড়ের মধ্যে কোনো সম্পর্ক রয়েছে।
চতুর্থ পর্ব: নৌকায় লুকিয়ে থাকা সত্য
একদিন সন্ধ্যায় ইধিকা, পায়েল, এবং অনুরাগ আবার করলার পাড়ে গেল। নদীর স্রোত সেদিন একটু বেশি জোরে বইছিল, যেন কোনো রহস্য তাদের কাছে উদ্ঘাটনের অপেক্ষায়। তারা নদীর ধারে একটি পুরনো নৌকা দেখতে পেল, যেটি নদীর পাড়ে বাঁধা ছিল। ইধিকা সেই নৌকায় উঠে খুঁজতে শুরু করল। হঠাৎই সে নৌকার নিচে একটি গোপন কুঠরি দেখতে পেল।
কুঠরিটি খুলতেই তারা দেখল সেখানে একটি পুরনো ডায়েরি রাখা। ডায়েরিটি খুলে ইধিকা চমকে উঠল। সেখানে সোহিনীর নাম লেখা আছে, আর কিছু সাংকেতিক চিহ্ন আঁকা রয়েছে। চিহ্নগুলো সেই মানচিত্রের মতোই। ইধিকা ডায়েরিটি হাতে নিয়ে মনোজ কাকুর কাছে নিয়ে গেল।
মনোজ কাকু ডায়েরিটি দেখেই চিনতে পারলেন, এটি তারই লেখা। কয়েক বছর আগে তিনি একটি গুপ্তধনের খোঁজে ডায়েরিটিতে সাংকেতিক চিহ্ন দিয়ে মানচিত্র তৈরি করেছিলেন। সোহিনী হয়তো সেই ডায়েরিটি পেয়ে গুপ্তধন খুঁজতে গিয়েছিল।
পঞ্চম পর্ব: রহস্য উদ্ঘাটন
ইধিকা, পায়েল, এবং অনুরাগ মনোজ কাকুর সাথে বসে ডায়েরির সাংকেতিক চিহ্নগুলো বিশ্লেষণ করল। চিহ্নগুলো তাদের নিয়ে গেল করলার মাঝখানে একটি ছোট দ্বীপে। তারা সেই দ্বীপে গিয়ে পুরনো গাছের তলায় খুঁজতে শুরু করল। কিছুক্ষণ খোঁজার পর একটি পুরনো বাক্সের সন্ধান পেল।
বাক্স খুলতেই তারা দেখল, ভিতরে অনেক মূল্যবান রত্ন এবং সোনার গহনা রয়েছে। মনোজ কাকু বিষণ্ণ মুখে বললেন, “এগুলো আমার পূর্বপুরুষদের সম্পত্তি ছিল, যা বহু বছর আগে হারিয়ে গিয়েছিল। আমি অনেক চেষ্টা করেও তা খুঁজে পাইনি। সোহিনী হয়তো এই ডায়েরি পড়েই উত্তেজিত হয়ে একা একা এই গুপ্তধনের খোঁজে বেরিয়ে পড়ে। কিন্তু সে এখন কোথায়? এসব রত্নের সাথে সোহিনীর সম্পর্ক কীভাবে তৈরি হলো?”
ইধিকা ভাবতে শুরু করল, সোহিনীর পক্ষে একা একা এত বড় ঝুঁকি নেওয়া সম্ভব নয়। নিশ্চয়ই সেই রহস্যময় ব্যক্তির কোনো হাত আছে এতে। তার মানে সোহিনী যদি এখানে এসে থাকে, তাহলে সেই ব্যক্তি তাকে খুঁজে পাওয়ার আগেই তাকে কোথাও লুকিয়ে ফেলেছে।
ইধিকা মনোজ কাকুর দিকে তাকিয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “আমাদের সোহিনীকে খুঁজে পেতেই হবে। আপনি জানেন, শহরের এমন কোনো জায়গা আছে যেখানে কেউ লুকিয়ে থাকতে পারে?”
মনোজ কাকু চিন্তা করে বললেন, “হ্যাঁ, একটা পুরনো পরিত্যক্ত কারখানা আছে শহরের উপকণ্ঠে। সেটি অনেক বছর ধরে বন্ধ। কেউ সেদিকে যায় না।”
এই নতুন সূত্র হাতে পেয়ে ইধিকা, পায়েল, এবং অনুরাগ ঠিক করল, তারা সেই কারখানায় গিয়ে অনুসন্ধান করবে। রাতের আঁধারে তারা গাড়ি নিয়ে সেই কারখানার দিকে রওনা দিল।
ষষ্ঠ পর্ব: শেষ পর্যায়ের অভিযান
কারখানায় পৌঁছে তারা চারপাশ পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করল। কারখানাটি বাইরে থেকে দেখতে যেমন ভয়ানক, ভিতরে ঢুকেও তার চেয়ে কম কিছু নয়। ভাঙাচোরা ইট, মাকড়সার জাল আর নানা রকম ধ্বংসাবশেষে ভরা কারখানার প্রতিটি কোণায় যেন এক অজানা আতঙ্ক লুকিয়ে আছে।
ইধিকা একটা টর্চ জ্বালিয়ে সামনে এগিয়ে গেল। হঠাৎই তারা দূরে মৃদু আওয়াজ শুনতে পেল। ধীরে ধীরে তারা সেই আওয়াজের দিকে এগোতে থাকল। একটা পুরনো ঘরের দরজার ফাঁক দিয়ে তারা দেখল, ঘরের কোণায় সোহিনী বসে আছে। তার হাত-পা বাঁধা এবং মুখে কাপড় গোঁজা।
ইধিকা দেরি না করে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে সোহিনীকে মুক্ত করল। সোহিনী কাঁদতে কাঁদতে বলল, “ওই লোকটা আমাকে ধরে এখানে আটকে রেখেছিল। সে জানত যে আমি গুপ্তধনের খোঁজ জানি। সে আমাকে দিয়ে গুপ্তধন খুঁজিয়ে নিয়ে তারপর আমাকে শেষ করে দিতে চেয়েছিল।”
ইধিকা জিজ্ঞাসা করল, “লোকটা কোথায় এখন?”
সোহিনী কাঁপতে কাঁপতে বলল, “তুমি আসার ঠিক আগেই সে বাইরে গেছে। কিন্তু সে ফিরে আসবে। আমাদের দ্রুত এখান থেকে পালাতে হবে।”
এই কথায় ইধিকা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিল। তারা সোহিনীকে নিয়ে দ্রুত কারখানা থেকে বেরিয়ে এল। কিন্তু বাইরে বের হতেই তারা সেই রহস্যময় ব্যক্তির মুখোমুখি হলো। লোকটি দেখতে লম্বা এবং শক্তপোক্ত। তার মুখে সেই পরিচিত স্কার্ফ আর হাতে একটি লাঠি।
লোকটি গর্জন করে উঠল, “তোরা পালাতে পারবি না! সোহিনী আমার হাতের মুঠোয় ছিল। তোরা সবকিছু নষ্ট করে দিলি।”
ইধিকা, পায়েল, এবং অনুরাগ দ্রুত চারপাশে তাকিয়ে পালানোর উপায় খুঁজতে লাগল। কিন্তু লোকটি তাদের ঘিরে ফেলে। হঠাৎই ইধিকার মাথায় একটা বুদ্ধি এল। সে পায়েলের কানে কানে কিছু বলল। পায়েল সঙ্গে সঙ্গে তার ব্যাগ থেকে পেপার স্প্রে বের করে লোকটির চোখের সামনে ছিটিয়ে দিল।
লোকটি মুহূর্তেই অন্ধ হয়ে গেল এবং মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। ইধিকা, পায়েল, অনুরাগ, এবং সোহিনী দৌড়ে সেখান থেকে পালিয়ে শহরের দিকে রওনা দিল। শহরে পৌঁছে তারা পুলিশের কাছে সব ঘটনা খুলে বলল। পুলিশ এসে সেই লোকটিকে গ্রেফতার করল।
সপ্তম পর্ব: রহস্য সমাধান
পরবর্তীতে জানা গেল, সেই লোকটি ছিল শহরের পুরনো এক চোরাচালানকারী দলের সদস্য, যে বহুদিন ধরে গুপ্তধনের খোঁজে ছিল। মনোজ কাকুর ডায়েরির কথা সে জানতে পেরে সোহিনীর সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলে এবং তাকে ব্যবহার করে গুপ্তধন খুঁজতে চায়।
মনোজ কাকু সোহিনীকে পেয়ে চোখের জলে ভেসে গেলেন। ইধিকা এবং তার বন্ধুদের ধন্যবাদ জানাতে তিনি বললেন, “তোমরা না থাকলে আমার মেয়ে হয়তো আজ আমার কাছে ফিরে আসত না। তোমরা সত্যিই অসাধারণ।”
ইধিকা হাসল। সে বলল, “আমরা তো শুধু আমাদের দায়িত্বটাই করেছি, কাকু। রহস্যের সমাধান করাই আমাদের শখ। তবে এবার একটা জিনিস শিখেছি—রহস্য যতই কঠিন হোক, সত্যকে কোনোদিন চাপা রাখা যায় না। করলার স্রোত সেই রহস্যকেই আজ উন্মোচন করল।”
ইধিকার দ্বিতীয় রহস্যের সমাপ্তি।
© পিনাকী রঞ্জন পাল