ঠগরাজ ভুজ্জার কাহিনী (বুন্দেলখণ্ডের লোককথা)

পিনাকী রঞ্জন পাল

বড় রাস্তার মাঝামাঝি একটা লোহার বালা পড়ে ছিল, সোনার পালিশ থাকায় রৌদ্রে সেটি চকচক করছিল। দূরে পুলের ওপর বসে ঠগরাজ ভুজ্জা শিকারের প্রতীক্ষায় ছিল–শিকার ধরার এটাই ছিল তার কৌশল। কোন গাড়োয়ান বা পথিক এ পথ দিয়ে যাওয়ার সময় বালাটাকে দেখতে পেয়ে চারপাশে তাকিয়ে, যখন সেটাকে নিজের ট্যাকে ওঁজতে যেত তখনই পেছন থেকে সে এসে বলত, ‘কি পেয়েছো বলো?’

তারপর কিছুক্ষণ দোনো-মোনো করার পরে ব্যক্তিটি ট্যাক থেকে বালাটা বার করে দিত। ভুজ্জা সেটাকে হাতে ওজন করে বলতো, কম করেও দশ তোলার তো হবেই। চলো এটাকে কেটে অর্ধেক আমাকে দাও। আমিও তো এটাকে দেখেই এগিয়ে আসছিলাম, কিন্তু তুমি গতি বাড়িয়ে আগে পৌঁছে গেছ।”

বাক্তিটি অর্ধেক দিতে প্রস্তুত হলে ভুজ্জা পরামর্শ দিত, ‘দেখ ভাই এটাকে স্বর্ণকারের কাছে গিয়ে কাটালে হয়ত বা পুলিশের কাছে খবর চলে যাবে। আর আমাদের হাজতবাস করতে হবে। এর দাম কমপক্ষে দশ হাজার টাকা তো হবেই। এক কাজ কর তুমি আমাকে এক হাজার টাকা দিয়ে এই বালা রেখে দাও। নেই….নেই, সঙ্গে নেই তো বাড়ি গিয়ে দেবে চলো, নগদ না থাকলে এক হাজার টাকার গহনা দিলেও চলবে।’

সেদিনও ভুজ্জা যখন শিকারের প্রতীক্ষায় ছিল তখন চার পথিক রাস্তায় পড়ে থাকা বালাটিকে দেখতে পেয়ে খুব হাসতে লাগল। ওদের ব্যবহারে ভুজ্জা বিস্মিত হয়ে কাছে গেলে ওরা বলে, ‘ঠকানর এই কৌশল বহু পুরনো হয়ে গেছে। আমরাও ঠগ, আমরা এই কৌশলের ব্যবহার কবেই ত্যাগ করেছি।

‘কৌশল পুরনো হলেও মানুষের লোভ কখনও পুরনো হয় না। আমি তো একটি গ্রামের, একই বাড়ি থেকে সোনাকে দ্বিগুণ করার ঠকানোতে তিন-তিনবার সফল হয়েছি। যাইহোক এ সব ছাড়ো, আমরা যখন একই লাইনের লোক তখন আমার বাড়ি চলো ভাল-মন্দ যা আছে তাই দিয়ে খাওয়া-দাওয়া করেই যেও।’

তাদের ঘরে বসিয়ে ভুজ্জা নিজেই উনান ধরায়। চার ভাইয়ের এক বোন ছিল। তারা চিন্তা করল, “ও জোয়ান আছে, নিজেদের জাতভাইও হয়, তবে এরই সঙ্গে বোনের বিয়ে দিলে কেমন হয়। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। দেখতে দেখতে বিয়ে হয়ে গেল।

কিছুদিন পরে ভুজ্জা খবর পেল যে, চারভাই তাদের বোনকে নিতে আসছে। ভূজ্জা জঙ্গল থেকে দু’টি খরগোশ ধরে একটিকে ঘরে বেঁধে রেখে, স্ত্রীকে সমস্ত পরিকল্পনা বুঝিয়ে অন্য খরগোশটিকে সঙ্গে করে পুলে গিয়ে বালা সড়কে ফেলে শিকারের প্রতীক্ষায় রইল। চার ভাই এল, আজ কার শিকার করবেন বলে বসে আছেন জামাইবাবু? আমাদের কি?’

আরে না না, আমি তো তোমাদের স্বাগত জানাতেই এসেছিলাম আর ভাবলাম এরই মধ্যে যদি কোন শিকার পেয়ে যাই তবে তোমাদের খাতিরদারি জোরদার করতে পারব।’

সে তাদের তামাক খাওয়ার জন্য আটকে হাতের খরগোশটিকে ছেড়ে দিয়ে বলল, “যা বাড়ি গিয়ে বল যে তোমার ভাইরা এসে গেছে, তাদের জন্য তাড়াতাড়ি খাবার তৈরি করতে।’

ছাড়া পেয়ে খরগোশ লাফাতে লাফাতে জঙ্গলে মিলিয়ে গেল। ভুজ্জা চার ভাইকে সঙ্গে করে বাড়ি পৌঁছাল।

“নাও তোমার ভাইরা এসে গেছে।”

‘আমাকে তো খরগোশ আগেই খবর দিয়েছিল, সবার জন্য খাবারও তৈরি হয়ে গেছে।

চারভাই লক্ষ্য করল যে, একই রকম খরগোশ ঘরে বাঁধা রয়েছে। তারা লোলুপ দৃষ্টিতে খরগোশটিকে দেখতে লাগল।

‘জামাইবাবু, এই ঘরগোশটিকে আমাদের দিয়ে দিন।”

‘দেখো, আমার মত একা মানুষের ওই ছোট্ট জীবটিই তো একমাত্র আশা ভরসা।”

কিন্তু তারা বেঁকে বসল, তারা খরগোশটিকে নেবেই, একশো-দুশো টাকা যা লাগে তারা দিতেও রাজি হয় খরগোশের পরিবর্তে।

‘টাকা-পয়সাটা তো বড় নয় এ ক্ষেত্রে” তাদের দেওয়া দুশো টাকা পকেটে ঢুকিয়ে ভুজ্জা খরগোশটিকে দিয়ে দেয়।

চার ভাই বোনের পরিবর্তে খরগোশটিকে নিয়েই মহানন্দে বাড়ির পথে রওনা দেয়। গ্রামের নদী এলে তারা খরগোশটিকে ছেড়ে দিয়ে বলে, ‘বাড়ি গিয়ে খাবার তৈরি করতে বল। আমরা স্নান করে আসছি।’

বাড়ি ফিরেই চার ভাই ভুজ্জার ধূর্ততা, বুঝতে পেরে তার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।

“ওরে বাবারে, মেরে ফেলল রে, বাঁচাও… বাঁচাও’ ভুজ্জার ঘরের ভেতর থেকে আওয়াজটা আসছিল। চার ভাই দৌড়ে ভেতরে গিয়ে দেখে জামাইবাবু একটা লাঠি দিয়ে তাদের বোনকে পেটাচ্ছে আর মারের চোটে বোন অজ্ঞান হয়ে গেছে।

“কি করছেন আপনি? ওকে কি মেরে ফেলবেন নাকি!”

‘ওর জন্যই আজ আমাকে তোমাদের সামনে লজ্জায় পড়তে হল। আরে আমি ভুলে গেছি, কিন্তু ও কি একবার মনে করিয়ে দিতে পারত না যে, খরগোশটিকে প্রথমে লাঠি দিয়ে এমনভাবে পেটাবে যাতে ও মরে যায়, তারপর বাড়ি পাঠাতে হবে।

‘মরার পরে কিভাবে খরগোশ বাড়ি যাবে? চারজনেই একসঙ্গে অবিশ্বাসের সুরে বলে।

‘এভাবে’, ‘ভুজ্জা হাতের লাঠিটাকে স্ত্রীর নাকের সামনে ধরে বলে, “শোঁক শোঁক-শোঁক।’ স্ত্রী হাসিমুখে বিছানায় উঠে বসে। চার ভাই এবার লাঠির লোভে পড়ে যায়।

‘দেখো লাঠি তোমরা নিয়ে যেতে পার, কিন্তু এর পরে আর কিন্তু অভিযোগ করতে আসবে না। পাঁচশো টাকা পকেটে পুরে লাঠিটিকে তাদের হাতে তুলে দেয়।

বাড়িতে এসে চার ভাই স্থির করল লাঠিটির গুণাগুণ প্রথমে বাড়িতেই পরীক্ষা করে দেখবে। চার ভাই নিজেদের স্ত্রীদের লাঠি দিয়ে মেরে অজ্ঞান করে দিয়ে জামাইবাবুর মত তাদের স্ত্রীদের খুব করে লাঠি শোঁকায়। কিন্তু তাদের আর জ্ঞান ফেরে না। চার ভাই ভুজ্জাকে মারার পণ করে পুনরায় রওনা দেয়।

বাড়িতে ঢুকে তারা দেখে ভুজ্জা উঠানে ছড়িয়ে থাকা টাকা-পয়সা খুঁটে খুঁটে তুলছে আর পাশের কুলের গাছ থেকে টাকা পয়সাগুলি ঝরে পড়ছে। বাস্তবে ভুজ্জাই সেগুলিকে আঠা দিয়ে কুলের পাতার সঙ্গে সেঁটে দিয়েছিল। চার ভাইয়ের লোভী মন পুনরায় সক্রিয় হয়ে ওঠে। চার ভাই তাদের উদ্দেশ্য ভুলে কুল গাছটি তাদেরকে দিয়ে দেওয়ার জন্য জোর করতে লাগল।

‘আরে ভাই এটাই তো আমার, উপার্জনের একমাত্র পথ। এটাকে দিয়ে দিলে তো আমাদের না খেয়ে মরতে হবে।”

‘সবাই তো শ্যালকদের জন্য প্রাণ পর্যন্ত দিয়ে দেয়। আর তুমি একটা গাছ দিতে পারবে না! তা ছাড়া আমাদের আর কি, মাত্র তো দুটো পেট, মজুরি করেই চালিয়ে নেওয়া যাবে। স্ত্রী ভেতর থেকে বললে সে এক হাজার টাকার বিনিময়ে গাছটি দিয়ে বলে, ‘একে শেকড় সহ উপড়ে নাও, আর রোজ জল-সার দেবে। নয়ত শুকিয়ে মরে যাবে আর তোমরাও ছুটে আসবে আমাকে মারার জন্য।”

চার ভাই কুল গাছটিকে নিজেদের বাড়ির উঠানে লাগিয়ে দেয়। রোজ খুব করে জল-সার দেওয়া সত্ত্বেও গাছটি শুকিয়ে গেল। এবার চার ভাই ঠিক করল যে আর কিছুতেই তারা ভুজ্জার ফাঁদে পা দেবে না, বদলা নেবেই।

ভুজ্জার বাড়ি এসে চারজনে কোন কথা না শুনে ভুজ্জাকে একটা কম্বলে মুড়ে বেঁধে নিয়ে চলল। নদীর পাড়ে পৌঁছে তারা ভাবল যে একে খুব গভীর জলে ফেলতে হবে। গভীর জলের খোঁজে তারা ভুজ্জাকে পাড়ে রেখে চলে গেল। সেই সময় ওদিক দিয়ে এক রাখাল যাচ্ছিল। ভুজ্জাকে কম্বলে বাঁধা দেখে সে জিজ্ঞেস করে, ‘কি ব্যাপার হে?’

‘ভাই ওরা আমাকে দ্বিতীয়বার বিয়ে করাতে নিয়ে যাচ্ছে।’

‘হায় রে, ভগবানের একি লীলা। আর আমার এখনও পর্যন্ত একবারও বিয়ে হল না!

‘দেখ যদি তুমি বিয়ে করতে চাও তবে আমাকে খুলে নিজেকে বেঁধে নাও।”

রাখাল ভুজ্জার বাঁধন খুলে দিয়ে তাকে বেঁধে দিতে বলে। কিছুক্ষণ পর চার ভাই ফিরে এসে কম্বলে মোড়া রাখালকে ভুজ্জা ভেবে জলে ছুঁড়ে ফেলে। ফেরার পথে ২৫-৩০টি গরু তাড়িয়ে ভুজ্জাকে ফিরতে দেখে তারা ভূত দেখার মত চমকে ওঠে।

‘আরে তোমরা আমাকে অগভীর জলে ফেলাতে গরু পেয়েছি। যদি গভীর জলে ফেলতে তবে তো হাতি পেয়ে যেতাম’ ভুজ্জা বলে।

এবার চার ভাই ভুজ্জার কাছে প্রার্থনা করতে লাগল সে যেন তাদের গভীর জলে ফেলে দেয়।

‘দেখ ভাই, আর আমি তোমাদের কোন ব্যাপারে নেই। তোমরা নিজেরাই একজন অপরজনকে ছুঁড়ে ফেল। হ্যাঁ, শেষ জনকে আমি অবশ্যই ছুঁড়ে ফেলে দেব।’

ঠগরাজ ভুজ্জা শেষ শ্যালককে নদীতে ছুঁড়ে ফেলে বাড়ি ফিরে আসে।

Photo credit by Nikhil Das (courtesy of Dainik Basumati)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *