পিনাকী রঞ্জন পাল
আজ থেকে প্রায় একশো বছরের বেশি সময়ের আগের কথা। তখন ঢাকা জেলার শেওড়াতলী নামে এক অখ্যাত গ্রামে জগন্নাথ সাহার একটি ছোট্ট মুদির দোকান ছিল। জগন্নাথবাবুর আর্থিক অবস্থা মোটেই ভাল ছিল না। তাই বাজার থেকে অল্প-স্বল্প চাল, ডাল, নুন, লঙ্কা, তেল ইত্যাদি কিনে এনে দোকানে বিক্রি করতেন। এভাবে অনেক অভাব-অনটনের মধ্যে জগন্নাথবাবু এবং তার স্ত্রী ভুবনেশ্বরী দেবীর সংসার চলত।
এই অভাবের সংসারেই ১৮৯৩ সালের ৬ অক্টোবর জন্ম নিল একটি শিশুর। অভাবের মধ্যেই শিশুপুত্রটি একসময় প্রাকৃতিক নিয়মে বালকে পরিণত হয়। যখন তার বয়স মাত্র পাঁচ বছর তখন তার পিতা তাকে দোকানে নিয়ে যেতেন। বালকটি বাবাকে দোকানের কাজে সাহায্য করত। আর দোকানে খরিদ্দার না থাকলে বাবা ছেলেকে বাংলা পড়াতেন এই ভেবে যে, লেখাপড়া কিছুটা জানা থাকলে বড় হয়ে ছেলে দোকানটি ভালভাবে চালাতে পারবে। কিন্তু পড়াতে গিয়ে ছেলের অসাধারণ স্মরণশক্তি লক্ষ্য করে বাবা বিস্মিত হলেন। যা একবার তাকে শিখিয়ে দিতেন তা আর দ্বিতীয়বার বলতে হত না।
জগন্নাথবাবু বাধ্য হয়েই ছেলেকে ভর্তি করে দিলেন গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করার পর কাছে পিঠে কোন হাই স্কুল না থাকায় নতুন সমস্যা দেখা দেয়। শেষে ছেলের আগ্রহে পিতা বাড়ি থেকে সাত মাইল দুরের হাই স্কুলেই ভর্তি করে দেন। এই দীর্ঘ পথ যাওয়া-আসা করতে বালকটির ভীষণ কষ্ট হলেও সে সব কিছু মুখ বুজে সহ্য করত। বালকের এত কষ্ট দেখে অনন্তকুমার দাস নামে জনৈক সহৃদয় ব্যক্তি তাকে বিনা খরচে তার বাড়িতে থাকতে দেন। ১৯০৫ সালে সেই মুদি দোকানের ছেলেটি মধ্য ইংরেজি পরীক্ষায় ঢাকা জেলার মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে বৃত্তি লাভ করে। এর পর উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য ছেলেটি ভর্তি হল কলেজিয়েট স্কুলে।
সেই সময় শাসক ইংরেজদের বিরুদ্ধে ভারতের সর্বত্র বিক্ষোভ চলছে।
বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে বিপ্লব এবং বিদ্রোহ দেখা দিয়েছে সারা দেশে। এমন সময় নেতারা ছাত্রদের আহ্বান করলেন আন্দোলনে শামিল হতে। এই আগুনঝরা পরিবেশে একদিন কলেজিয়েট স্কুল পরিদর্শনে এলেন পূর্ববঙ্গের নবনিযুক্ত ছোট লাট স্যার বমফিল্ড ফুলার। লাটসাহেব স্কুলে প্রবেশ করা মাত্রই দেশপ্রেমী ছাত্ররা দলে দলে স্কুল ছেড়ে চলে যায়। ক্রুদ্ধ লাটসাহেব তৎক্ষণাৎ নেতৃস্থানীয় ছাত্রদের স্কুল থেকে বহিষ্কারের নির্দেশ দেন। এদের মধ্যে জগন্নাথবাবুর ছেলেও ছিল।
ছেলেটি অন্য কোথাও ভর্তি হবার অনেক চেষ্টা করেও নিরাশ হয়। কারণ, কোন স্কুল কর্তৃপক্ষই ইংরেজদের বিদ্বেষভাজন হতে রাজি হল না। এই দুঃসময়ে কিশোরীলাল জুবিলি হাই স্কুলের স্বাধীনচেতা প্রধান শিক্ষক ছেলেটিকে তাঁর স্কুলে বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ করে দেন। ১৯০৯ সালে মুদি দোকানের কিশোরটি এন্ট্রান্স পরীক্ষায় অসাধারণ কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। এর পর ঢাকা কলেজ থেকে আই এস সি এবং কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বি এস সি পাস করেন। পরিশেষে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফলিত বিজ্ঞানে এম এস সি পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন।
সেই সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন বাংলার বাঘ স্যার আশুতোষ মুখ্যেপাধ্যায়। এই ছাত্রটির কৃতিত্বে মুগ্ধ হয়ে আশুতোষ তাঁকে ১৯১৮ সালে নবগঠিত বিজ্ঞান কলেজে গণিতের লেকচারার নিযুক্ত করেন। সে বছরই তাঁর গবেষণায় সন্তুষ্ট হয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডি এস সি ডিগ্রি প্রদান করে।
এতক্ষণ ধরে তোমরা নিশ্চয়ই ভাবছ লোকটি কে? তিনি হলেন বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী ডঃ মেঘনাদ সাহা। তিনি শুধু বৈজ্ঞানিকই ছিলেন না, ছিলেন আজীবন স্বাধীনতা সংগ্রামী। ১৯১৪ সালে বন্যাত্রাণের স্বেচ্ছাসেবক এবং ১৯২৩ সালে বেঙ্গল রিলিফ কমিটিতে তিনি ছিলেন তাঁর অন্যতম শিক্ষক আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সহযোগী। ভারত বিভাগের পর দলে দলে আসা উদ্বাস্ত সর্বহারাদের পাশে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি লোকসভায় সদস্যরূপেও নির্বাচিত হয়েছিলেন।
১৯৫৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ডঃ সাহা দিল্লিতে রাষ্ট্রপতি ভবনে পরিকল্পনা কমিশনের সভায় যোগ দিতে যাবার সময় মাথা ঘুরে রাস্তায় পড়ে যান। হাসপাতালে নিয়ে গেলে তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। ডঃ সাহার মৃত্যুর সংবাদে সারা দেশে শোকের ছায়া নেবে আসে। বিশেষ বিমানে তাঁর দেহটিকে কলকাতায় আনা হয়। হাজার হাজার মানুষ অশ্রুপূর্ণ নয়নে ডঃ সাহাকে বিদায় জানালেন।