পিনাকী রঞ্জন পাল
সময়কাল ১৮৭৫ সাল। স্থান আমেরিকার সানফ্রান্সিসকো শহর। সানফ্রান্সিসকোর লাগোয়া উঁচু উঁচু পাহাড়, ঘন অরণ্য ঘেরা ভয়ংকর এক এলাকা। এই পাহাড় ঘেরা ঘন অরণ্যের মধ্যে দিয়েই চলে গেছে একটি সংকীর্ণ এবড়ো-খেবড়ো রাস্তা। সানফ্রান্সিসকোর সঙ্গে ক্যালিফোর্নিয়াকে সংযুক্ত করেছে এই রাস্তা। সানফ্রান্সিসকো থেকে প্রতি সপ্তাহে এই রাস্তা দিয়েই ঘোড়াগাড়ি করে সরকারি অর্থ ক্যালিফোর্নিয়ায় পৌঁছানো হয়।

প্রতি সপ্তাহের মতো সেদিনও সরকারি অর্থ নিয়ে ঘোড়াগাড়ি সেই রাস্তা দিয়েই যাচ্ছিল। অল্প অল্প অন্ধকার দিনের আলোকে গ্রাস করছিল। ঘন অরণ্যের মধ্যে গাড়ি পৌঁছাতেই হঠাৎ এক বন্দুকধারী জঙ্গলের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসে। ব্যক্তিটি কালো রংয়ের পোশাকে নিজেকে ঢেকে রেখেছিল। চোখ দুটি ছাড়া পুরো মুখও ছিল কালো কাপড়ে ঢাকা। সে বজ্রগম্ভীর কণ্ঠে ঘোড়াগাড়ির উদ্দেশ্যে বলে, সরকারি অর্থ বাইরে ছুঁড়ে দাও। খবরদার, কোনোরকম চালাকি করবে না। আমার সঙ্গীরা কিন্তু চারিদিক থেকে গাড়ির দিকে বন্দুক তাক করে আছে। ঘোড়াগাড়ির চালক ও যাত্রীরা চারপাশে তাকাতেই চোখে পড়ল যে তাদের দিকে ১০/১২টা বন্দুকের নল তাক করা রয়েছে। গাড়ির প্রত্যেকে ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। চালক চুপচাপ নোট ভর্তি সরকারি ব্যাগ বন্দুকধারীর দিকে ছুড়ে দিল।
ব্যাগ তুলে বন্দুকধারী গাড়ির ভিতরে ভালো করে দেখতে থাকে। গাড়িতে বসে থাকা যাত্রীরা সবাই ভয় পেয়ে প্রত্যেকে তাদের টাকার ব্যাগ তার দিকে ছুড়ে দেয়।
কিন্তু এ কি! সেই বন্দুকধারী ঘোড়াগাড়ির যাত্রীদের ছুড়ে দেওয়া টাকার ব্যাগ উঠিয়ে নিয়ে তাদের কাছে এসে বলে আমরা এসব চাই না। আপনারা নিজেদের ব্যাগ ফেরত নিন। তারপর সে সরকারি ব্যাগ থেকে কিছু অর্থ বার করে বাদবাকি অর্থ সহ ব্যাগটি সে গাড়ির চালককে ফেরত দিয়ে সেখান থেকে তাদের চলে যেতে বলল।
আরো পড়ুন : ভৌতিক গল্প : তামসা কুণ্ডের অভিশাপ
এই হল রবার্ট ডগলাস, এক ভয়ংকর ডাকাত। যার আতঙ্কে সেই সময় বড়ো বড়ো সরকারি কর্মচারীরা ভয়ে কাঁপত। রবার্টকে কেউ কখনও দেখেনি। কিন্তু তার বজ্রগম্ভীর কণ্ঠস্বর সকলেই শুনেছে।
অবশ্য রবার্টের একটা বিশেষত্ব ছিল যে আজ পর্যন্ত কোনো মানুষ খুন করেনি। আর আজ পর্যন্ত সে শুধুমাত্র সরকারি অর্থই লুঠ করেছে। সে কখনও কোনো যাত্রীর অর্থ লুঠ করেনি। বরং যাত্রীদের প্রতি তার ব্যবহার ছিল অতি বিনম্র। তার এই বিশেষত্বই তাকে সেই সময় সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয় করে তুলেছিল।

সেখানকার পুলিশ তাকে ধরার জন্য জোর তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু আশপাশের এলাকার লোকরা প্রার্থনা করত যে রবার্ট যেন কানোদিনও ধরা না পড়ে। কারণ সে লুঠ করা অর্থে হাত খুলে তাদেরকে নিয়মিত সাহায্য করত, তাদের বিপদেআপদে পাশে দাঁড়াত।
অন্যদিকে, রবার্ট বা তার দলের এই জনপ্রিয়তা সেখানকার সরকারের বুকে কাঁটার মতো বিঁধছিল। তাকে বা রবার্টের দলকে ধরার জন্য পুলিশের উপর চাপ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছিল। শেষে সরকার রবার্টের দলকে ধরার দায়িত্ব অর্পণ করে জিম হিউম নামক এক কর্তব্যনিষ্ঠ, দায়িত্ববান, জেদি পুলিশ অফিসারকে। দায়িত্ব পেয়েই জিম তার কাজ আরম্ভ করে দিল।
আরো পড়ুন : রহস্যময় ভয়ের গল্প : তুলিন পাহাড়ের তেইশ নম্বর খোঁপা
দিন, সপ্তাহ আর মাস কেটে যায়, জিম হিউম ডাকাত রবাট বা তার দলের কোনোরকম খোঁজ বার করতে পারে না। কিন্তু নাছোড়বান্দা জিম এত সহজে হার মানতে নারাজ। সে রবার্টকে ধরার উপায় খুঁজতে থাকে। হঠাৎ একদিন তার মাথায় একটা বুদ্ধি উদয় হয়।
পরের সপ্তাহে যে ঘোড়ারগাড়ি সরকারি অর্থ নিয়ে ওই রাস্তা দিয়ে যাবে, অতে জিম ছদ্মবেশে যাত্রী হিসাবে যাবে ঠিক করল। আশা অনুযায়ী, যেই গাড়ি সন্ধের দিকে সেই সংকীর্ণ, এবড়োখেবড়ো পথে প্রবেশ করল, হঠাৎই এক বন্দুকধারী জঙ্গলের মধ্য থেকে বেরিয়ে এল। জিমের বুঝতে আর বাকি থাকল না এই সেই রবার্ট। যাকে ধরার গুরুদায়িত্ব সরকার তার উপর ন্যস্ত করেছে। জিম চারিদিক চোখ বুলিয়ে দেখল যে তাদের গাড়িটি চারপাশ থেকেই রবার্টের দল দ্বারা ঘেরাও হয়েছে। রাস্তার দুপাশের জঙ্গলের মধ্য থেকে অনেকগুলো বন্দুকের নল তাদের দিকে তাক করা রয়েছে। ঘোড়াগাড়ির চালক জিমের মুখের দিকে তাকায়। জিম এই সময় কোনো ঝামেলায় পড়া উচিত নয় মনে করে সরকারি অর্থ রবার্টের দিকে ছুড়ে দিয়ে গাড়িকে এগিয়ে নিয়ে যেতে বলে। গাড়ির চালক সরকারি অর্থ রবার্টের দিকে ছুড়ে দিলে রবার্ট তাদেরকে এগিয়ে নিয়ে যাবার সংকেত দেয়।
ঘোড়াগাড়ি এগিয়ে চলে। কিছুদূর যাবার পরে জিম ঘোড়াগাড়ির চালকের কানে কানে কিছু বলে আর তারপর কালো কম্বল মুড়ি দিয়ে চলন্ত গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে পড়ে।
আরো পড়ুন : থ্রিলার গল্প : কুয়াশার প্রেতাত্মা ও এক গোয়েন্দা প্রত্যাবর্তন
ঘোড়াগাড়ি তার নিজস্ব গতিতে। চলতে থাকে।
জিম লুকিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছোয়। তার ইচ্ছা ছিল লুকিয়ে রবার্ট আর তার দলের লোকদের পিছু নিয়ে তাদের আড্ডা’ দেখে আসে। কিন্তু এ কি? জিম হিউম তার নিজের চোখকে পর্যন্ত | বিশ্বাস করতে পারছিল না। ডাকাত | রবার্ট তার দলের এক এক সদস্যকে। জঙ্গলের মধ্য থেকে টেনে নিজের কাঁধে তুলছিল।
জিম দেখল অন্ধকারে যেগুলোকে দেখতে বন্দুকের নল বলে মনে হচ্ছিল | সেগুলো আসলে বন্দুক নয়, লাঠি দিয়ে তৈরি নকল বন্দুক। আর সেসব কোনো মানুষ তাদের গাড়ির দিকে তাক করে ছিল না, রবার্ট স্বয়ং জঙ্গলের মধ্যে সেগুলো এমন সুন্দরভাবে আটকে। রেখেছিল যে আবছা অন্ধকারে | সেগুলোকে রবার্টের বন্দুকধারী সাথী | বলে মনে হয়েছিল। জিম চুপচাপ সেসব দেখছিল আর স্বস্তির শ্বাস ফেলল, কারণ সে বুঝতে পেরেছে যে শত্রু চালাক; তবে ভয়ংকর নয়। সে চুপচাপ শহরে ফিরে এসে পরবর্তী কার্যপদ্ধতি | ঠিক করতে বসল।
পরের সপ্তাহে সরকারি অর্থ নিয়ে যাওয়া গাড়িকে সেই নির্জন স্থানে থামিয়ে ডাকাত রবার্ট অর্থ চাইতেই গাড়ি থেকে অর্থ ছুড়ে দেওয়ার পরিবর্তে ঘোড়ারগাড়ির চালক স্বয়ং গাড়ি থেকে। তার সামনে লাফিয়ে নেমে পড়ল। একি! রবার্ট হতবাক হয়ে গেল। ঘাবড়ে গিয়ে রবার্ট চিৎকার করে আরে বোকা, এটা কি করছিস… আমার সঙ্গীরা তোকে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেবে।
-‘তোমার সঙ্গীরা আমার নয়, বরং আজ আমার সঙ্গীরা তোমার অবস্থা খারাপ করে দেবে, বলে জিম গাড়ির দিকে তাকিয়ে ইশারা করে।
জিমের সহকর্মী পুলিশ যারা আজ যাত্রীর ছদ্মবেশে ছিল লাফ দিয়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে জঙ্গলে লাগিয়ে রাখা বন্দুকগুলো এক এক করে ওঠাতে থাকে আর এদিকে জিম রবার্টকে বন্দি করে ফেলে।
ডাকাত রবার্টকে শহরের জেলে নিয়ে আসা হয়। তার অপরাধ ছিল কঠোর, কিন্তু যেহেতু সে লুঠ করা অধিকাংশ অর্থই নিজের এলাকার জনগণের উন্নতির জন্য খরচ করেছিল, তাই পরবর্তীতে রবার্টকে সেই এলাকার সংরক্ষক হিসাবে নিয়োগ করা হয়।
শেষ
ছবি এআই