জলপাইগুড়ি, ৬ জুলাই : শিক্ষা যে শুধু পাঠ্যপুস্তক নির্ভর নয়, তা আবারও প্রমাণ করল জলপাইগুড়ি শহর সংলগ্ন একটি বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রীকে সহপাঠীর দ্বারা যৌন হেনস্থার অভিযোগ উঠেছে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে শহরজুড়ে তীব্র চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। অভিযোগের তীর শুধু অভিযুক্ত ছাত্রের দিকেই নয়, বরং স্কুল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধেও উঠেছে গুরুতর অভিযোগ। ছাত্রীর পরিবারের দাবি, স্কুল কর্তৃপক্ষ বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছে এবং তাদের ওপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করেছে।

ঘটনার সূত্রপাত গত মাসের ২৩ তারিখে। অভিযোগকারিণী ছাত্রী জানিয়েছে, প্রথম পিরিয়ডে তার পেছনের বেঞ্চে বসা এক সহপাঠী তাকে অশালীন কথা বলছিল। প্রথমে সে বিষয়টি উপেক্ষা করলেও, এক পর্যায়ে ওই ছাত্র তার গায়ে হাত দেয়। ছাত্রী প্রতিবাদ করতে গেলে অভিযুক্ত তার হাত মুচড়ে দেয় এবং হুমকি দেয় যে, শিক্ষককে জানালে স্কুল ছুটির পর তাকে দেখে নেবে।
ঘটনার পর ছাত্রীটি ক্লাস শিক্ষককে বিষয়টি জানায়। অভিযোগ, শিক্ষক প্রমাণ চেয়েছিলেন এবং যখন ছাত্রী তার দুই বান্ধবীকে সাক্ষী হিসেবে উপস্থাপন করে, তখন শিক্ষক তাদের সাক্ষ্যকে যথেষ্ট বলে মনে করেননি। উল্টো, তিনি বিষয়টি নিজেদের মধ্যে মিটিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেন। এরপর ছাত্রী স্কুলের অধ্যক্ষের কাছে যায়, কিন্তু অভিযোগ যে অধ্যক্ষও একইভাবে বিষয়টি মিটিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দেন।
ছাত্রীর মা পরদিন স্কুলে গিয়ে অধ্যক্ষের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে, প্রথমে তিনি দেখা করতে চাননি। পরে দেখা করলেও, অধ্যক্ষ পরিবারকে বিষয়টি নিজেদের মধ্যে মিটিয়ে নেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করেন বলে অভিযোগ।
পরিবারের অভিযোগ, তারা চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটি (CWC) এবং জেলা পুলিশের দ্বারস্থ হওয়ার পর থেকে স্কুল কর্তৃপক্ষ তাদের ওপর আরও বেশি মানসিক চাপ সৃষ্টি করতে শুরু করে। মেয়েটিকে স্কুলে পাঠালে অভিযুক্ত ছাত্র এবং তার বন্ধুরা তাকে নানাভাবে উত্ত্যক্ত করতে থাকে। এমনকি, একদিন পঞ্চম পিরিয়ডে এক শিক্ষক ক্লাস চলাকালীন কথা বলার অভিযোগে নির্যাতিতাকে তার নিজের জায়গা থেকে উঠিয়ে অভিযুক্ত সহপাঠী ছাত্রের পাশে বসতে বাধ্য করেন। এই ঘটনা পুরো ক্লাসের সামনে ঘটে এবং নির্যাতিতা আরও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এই শিক্ষকের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে, কেন তিনি সমস্ত ঘটনা জানার পরেও নির্যাতিতাকে অভিযুক্তের পাশে বসতে বাধ্য করলেন।
অসহায় পরিবার অবশেষে চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটি এবং জেলা পুলিশের দ্বারস্থ হয়। জেলা পুলিশ সুপারের দপ্তর এবং জলপাইগুড়ি মহিলা থানাতেও অভিযোগ জানানো হয়েছে।
জলপাইগুড়ি জেলা পুলিশ সুপার খান্ডবাহালে উমেশ গণপত জানিয়েছেন, ছাত্রীর পরিবারের অভিযোগের ভিত্তিতে একটি মামলা রুজু করা হয়েছে এবং প্রয়োজনীয় তদন্ত শুরু হয়েছে।
চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটির পক্ষ থেকেও গোটা ঘটনাটির পৃথক তদন্ত শুরু হয়েছে বলে কমিটির চেয়ারম্যান মান্না মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন।
ছাত্রীর পরিবার স্পষ্ট জানিয়েছে যে, তারা শুধু নিজেদের মেয়ের জন্য নয়, বরং অন্যান্য ছাত্রীদের নিরাপত্তার কথা ভেবেই এই পদক্ষেপ নিয়েছে। তাদের দাবি, “স্কুলের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোনও মেয়ের সঙ্গে এমন ঘটনা যেন আর না ঘটে, তার জন্য প্রশাসনের কড়া পদক্ষেপ চাই। একই সঙ্গে আমাদের মেয়ের যাতে সুবিচার হয়, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। একটা স্কুল, যেখানে শিশুরা নিরাপদ থাকার কথা, সেখানে যদি এই ধরনের ঘটনা ঘটে এবং স্কুল কর্তৃপক্ষ তা চাপা দেওয়ার চেষ্টা করে, তাহলে ভবিষ্যৎ কোথায়?”
জেলা জুভেনাইল জাস্টিস বোর্ডের সহকারী সরকারি আইনজীবী সান্তা চট্টোপাধ্যায় বলেন, “এই অভিযোগ খুবই গম্ভীর। বাচ্চাদের আমরা সাধারণত কাউন্সিলিং করে সমস্যা মেটানোর চেষ্টা করি, যেসব ক্ষেত্রে তা হয় না তখন আইনি পদক্ষেপ নিতে হয়। এই ঘটনার তদন্তে যদি প্রমাণিত হয় যে কেউ কেউ বিষয়টাকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, তবে তাদের বিরুদ্ধেও আইনি পদক্ষেপ নেওয়া যায়। স্কুল কর্তৃপক্ষ যদি ঘটনাটি লঘু করে দেখায়, তবে তা শিশু অধিকার লঙ্ঘনের মধ্যে পড়ে। জুভেনাইল বোর্ড যদি প্রয়োজন মনে করে, স্কুলের ভূমিকা নিয়েও আইনি পদক্ষেপ নিতে পারে।”
কসবা আইন কলেজের ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই জলপাইগুড়ির এই ঘটনা আবারও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের নিরাপত্তা এবং কর্তৃপক্ষের দায়িত্বশীল ভূমিকা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলে দিল।