লেখক পঙ্কজ সেন
১৮৭১ সালে ওপার বাংলার ঢাকা থেকে পালিয়ে জলপাইগুড়িতে চলে আসেন জালান মিয়া ও প্যারি বিবি নামক এক মুসলিম দম্পতি। এই দম্পতি ঢাকাতে থাকাকালীন সময়ে ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। সেখানকার শুভানুধ্যায়ীদের পরামর্শে তারা জলপাইগুড়িতে চলে আসেন। তৎকালীন সময়ে আমাদের এই বাংলায় মেয়েদের শিক্ষালাভ করা অনেক কষ্টসাধ্য বিষয় ছিল। জলপাইগুড়ি শহরে সে সময় কোন বালিকা বিদ্যালয় ছিল না। সুদূর ঢাকা থেকে আগত এই দম্পতি জলপাইগুড়ির মেয়েদের শিক্ষিত করার একটা উদ্যোগ গ্রহণ করেন, যা সেই আমলে একটা বিপ্লব ছিল। শহরের প্রাণ করলা নদীর পাশে প্রয়াত কবি মোহিত ঘোষের বাবা শরৎ ঘোষ তাদের বিদ্যালয়ের জন্য কিছু জমি দেন। ১৮৭১ সালে তৎকালীন ইংরেজ কমিশনার বেকেট সাহেবের সহযোগিতায় এবং জালান মিয়া এবং তার স্ত্রীর উদ্যোগে স্থাপিত হয় একটি লোয়ার প্রাইমারি বিদ্যালয়।

১৯১০ সালে বিদ্যালয়টি আপার প্রাইমারি হয়। ১৯১১-১২ সালে সমাজ সংস্কারক কেশবচন্দ্র সেনের মেয়ে তথা কোচবিহারের রানী সুনীতি দেবীর করা আর্থিক সাহায্যে বিদ্যালয়ের জন্য একটি একতলা পাকা বাড়ি নির্মিত হয়। জলপাইগুড়ির রানী অশ্রুমতি দেবী বিদ্যালয়টির প্রসারের জন্য এই সময় আরো কিছু জমি দান করেন। ১৯২৩ সালে বিদ্যালয়টির নাম হয় “মিডল ইংলিশ বিদ্যালয়”। ১৯২৫ সালে কলকাতা থেকে আসেন সুনীতি বালা চন্দ এবং তার স্বামী দেবেন্দ্র চন্দ। ওই বছরেই তিনি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা পদে নিযুক্ত হন। ১৯২৭ সালে বিদ্যালয়টি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে হাইস্কুলের মর্যাদা পায়।

জলপাইগুড়িতে নারী শিক্ষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন সুনিতি বালা চন্দ। এই জন্য তিনি ১৯৬২ সালে রাষ্ট্রপতি পুরস্কারে সম্মানিত হন। বিদ্যালয়ের ইংরাজির শিক্ষিকা তারা ব্যানার্জি রাজ্যস্তরের পুরস্কার পান। ১৯৫৭ সালে বিদ্যালয়টিতে একাদশ শ্রেণি চালু হয়। তখন বিজ্ঞান, কলা এবং গৃহ বিজ্ঞান পড়ানো হতো। ৫০ এর দশকে তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল কৈলাসনাথ কাটজু , ক্ষিতিমোহন সেন এবং বিজ্ঞানী মেঘনাথ সাহার মতো ব্যক্তিত্বরা এই বিদ্যালয়ে পদার্পণ করেছিলেন। এই বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠিত ছাত্রীদের মধ্যে অন্যতম হলো আমেরিকার ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক সংঘমিত্রা সেনগুপ্ত, গায়িকা দেবযানী বসু, শিলিগুড়ি গার্লস হাই স্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষিকা শেফালী সিংহ, শিলিগুড়ি সূর্যসেন কলেজের অধ্যাপিকা এবং লেখিকা রম্যানী গোস্বামী, সমাজসেবী ইন্দিরা সেনগুপ্ত এবং জলপাইগুড়ি পুরসভার বর্তমান চেয়ারপার্সন পাপিয়া পাল প্রমুখ।

উল্লেখ্য, স্বর্গীয়া বীণা দাশগুপ্ত (বর্তমান মেরিনা নার্সিংহোমের ঠিক আগের বাড়িটি তাদের ছিল) সদর গার্লসের প্রথম মাধ্যমিক ব্যাচের ছাত্রী এবং জলপাইগুড়িতে মহিলাদের মধ্যে সর্বপ্রথম বি.এ পাস। পরবর্তীতে বীনাদেবী শিক্ষিকা হয়ে এই বিদ্যালয়েই যোগদান করেন। স্বর্গীয় সাবিত্রী বসু এই বিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলেন (মাধ্যমিক ১৯৫৮ ব্যাচ)। তিনি স্বনামধন্য প্রধান শিক্ষিকা সুনীতি বালা দেবীর অত্যন্ত প্রিয় ছাত্রী ছিলেন সংগীতের কারণে। ১৯৬৮ সালে তিস্তার বিধ্বংসী বন্যায় বিদ্যালয়টির অপূরণীয় ক্ষতি হয়। এর জেরে ১৯৭১ সালের পরিবর্তে বিদ্যালয়ের ১০০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠান পালিত হয় ১৯৭৪ সালে।

১৯৯৫ সালে বিদ্যালয়ের ১২৫ বছর এবং ২০২০ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি ১৫০ বছর পূর্তি উৎসব খুবই সাড়ম্বরের সহিত পালিত হয়। বিদ্যালয়টি প্রথমে জনমানষে “সদর বালিকা বিদ্যালয়” হিসেবে পরিচিত থাকলেও ৯০-এর দশকে তার নাম পরিবর্তন করে “সুনীতি বালা সদর গার্লস হাই স্কুল”নামে পরিচিত পায়।বিদ্যালয়টি করলা নদীর তীরে অবস্থিত জন্য আজও শহরের অনেক প্রবীণ বিদ্যালয়টিকে “করলা গার্লস” নামেই অভিহিত করেন। এই বিদ্যালয়ের পাশেই করলা নদীর উপর অবস্থিত ছিল ইংরেজ আমলের তৈরি ঐতিহ্যবাহী দোলনা পুল, যা ১৯৬১ সালের ছট পূজার দিন শেষ বিকেলে অতিরিক্ত জনসমাগমের চাপে পুলের একপাশের রশি ছিড়ে নদীতে পড়লে বেশ কিছু নর-নারীসহ, শিশুর সলীল সমাধি হয়।
ছবি সৌজন্যে ফেসবুক