লেখক : পঙ্কজ সেন
জলপাইগুড়ি শহরের হাকিমপাড়া ও বাবু পাড়ার মধ্যে সংযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে করলা নদীর উপর ইংরেজ আমলে নির্মিত হয়েছিল প্রায় ৫৫ মিটার লম্বা এবং ৫-৬ ফুট চওড়া বিশিষ্ট এক “দোলনা পুল”। সেতুর নিচের পাটাতনটি ছিল সম্পূর্ণ শাল কাঠের। পুলের দুই পাশের মাথায় দুটি লোহার প্রায় ৫ ফুট উঁচু নিচে লোহার গোলাই চাকাযুক্ত ঘোরানো গেট ছিল। পুলটি লোহার বড় বড় মোটা শিকলসহ আঙটা দিয়ে, উভয় পাশে থাকা দুটি করে বৃহৎ আকারের প্রধান খুঁটির সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। পুলের নিচের লোহার মোটা শিকলগুলিকে মাঝেমধ্যেই সোনালী রঙ দিয়ে রং করা হতো। নদীর মধ্যখানে পুলটিকে সাপোর্ট দেওয়ার মতো কোন রকম খুঁটি বা পিলার ছিল না। এর ফলে, পুলের ওপর মানুষজন চলাফেরা করলেই সেটি দুলে উঠত, তাই তার নাম লোকমুখে প্রচলিত ছিল “দোলনা পুল”।
জলপাইগুড়ি শহরের দুটি প্রাচীনতম খ্যাতনামা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যথা, সদর গার্লস বালিকা বিদ্যালয় (তখন এই নামেই বিদ্যালয় পরিচিত ছিল) এবং জিলাস্কুল করলা নদীর দুই পাশে অবস্থিত ছিল। তার ওপর ছিল দিনবাজার ও সদর হাসপাতাল। এর ফলে এই পুলের উপর শহরের মানুষজনের এফ দীর্ঘ আনাগোনা সবসময় লেগেই থাকত। সেই সময় শহরে যোগাযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে দোলনা পুলের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।

ইংরেজ আমলের নির্মিত এই দোলনা পুল অকস্মাৎ এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয় ১৯৬১ সালে ছট পূজার দিন। সেই সময়ে শহরের মানুষজন সিংহভাগ ছট পুজোর ঘাট করতো তিস্তা নদী এলাকায়। করলায় জলের অতি গভীরতার জন্য খুব কম সংখ্যক মানুষ ঘাট করতো। ছট পুজার দিন বিকাল বেলা প্রথম পর্বের পুজো শেষে পুণ্যথীরা তিস্তা নদী থেকে পূজোর সকল উপকরণ সহ দোলনা পুল পার করে বাবু পাড়ার দিকে আসার সময়, অত্যাধিক ভিড়ের চাপে পুলের হাকিম পাড়ার দিকের একপাশের লোহার মোটা রশি খুলে গিয়ে(জং খেয়ে গিয়েছিল) একদিকে কাত হয়ে পড়ে। এর ফলে পুলের উপর থাকা প্রায় সকল মানুষজন করলা নদীতে পতিত হয়। অনেকে সাঁতার কেটে উপরে উঠতে পারলেও, প্রায় ১৫ জনের উপর নারী ও শিশুর সলিল সমাধি হয়। অত্যন্ত দ্রুত এই খবর সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ে। প্রচুর লোক পুলের দুই পাশে জমায়েত হয়। খবর দেওয়া হয় তৎকালীন কদমতলা মোড়ে (বর্তমান শিলিগুড়ি বাস স্ট্যান্ডের পাশে) অবস্থিত দমকল বিভাগকে। তারা অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয় এবং বড় বড় কাঁটা, রশির সঙ্গে বেঁধে নদীর জলে ফেলে তল্লাশি চালিয়ে অনেকগুলো মৃতদেহ উদ্ধার করে। সেই সময় কোতয়ালি থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে যথেষ্ট সহযোগিতা করেছিল। প্রায় সারারাত এই প্রচেষ্টা চলে। নদীর জলে ভাসতে থাকে ছট পূজার সকল উপকরণ সহ বাঁশের তৈরি টুকরিগুলি। মুহূর্তেই আনন্দঘন পরিবেশ পরিণত হয় বিষাদে। তবে মৃতদের মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যাই ছিল বেশি। সে সময় করলায় জলের গভীরতার জন্য মৃত্যুর সংখ্যাটা বৃদ্ধি পায়।

দোলনা পুলের এই করুণ পরিণতির পর পরবর্তীতে আর প্রশাসনের পক্ষ থেকে এই পুলকে নতুন করে সংস্কার করার প্রয়াস করা হয়নি। তার পরিবর্তে তৈরি করা হয় কংক্রিটের পুল। কিন্তু সেই পুল ১৯৬৮ সালে তিস্তার মহা বন্যায় খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরবর্তীতে আবার নতুন করে পুল নির্মিত হয়। নিচে লোহার পিলারগুলি ক্ষয় পেয়ে যাবার জন্য পরবর্তীতে এক-দুইবার সংস্কার করা হয়েছিল। কিন্তু ২০১৯ সালে সেই পুল জনগণের নিরাপত্তার কথা ভেবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভেঙে দেওয়া হয়।

বর্তমানে বিবরণীর সঙ্গে ওপরে যে নবনির্মিত সেতুর ছবি দেওয়া হয়েছে, তা ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে জনগণের ব্যবহারের উদ্দেশ্যে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে।