ভয়ের গল্প : অভিশপ্ত ব্রিজের মুক্তি

লেখক : পিনাকী রঞ্জন পাল

রাত গভীর। রাস্তা নির্জন, চারপাশে শুধু পেঁচা ডাকার শব্দ। রূপা কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরছিল। কাজের জায়গাটা বাড়ি থেকে বেশ দূরে, অথচ রাস্তাটাও খুব একটা নিরাপদ নয়। প্রায়ই শুনতে পায়, লোকজন রাতে ওই রাস্তা দিয়ে চলতে ভয় পায়। কিন্তু তবুও রূপার সাহসের অভাব নেই। সে বেশ সাহসী মেয়ে। তবু আজকে যেন মনে হলো, বুকের ভেতরটা এক অদ্ভুত শঙ্কায় ভরে উঠছে।

রূপা পৌঁছে গেল সেই সরু ব্রিজটার কাছে। ব্রিজটা খুবই পুরনো। কাঠগুলো ভাঙাচোরা, কেমন যেন একটা সুরসুরে অনুভূতি হয় ব্রিজটার ওপর উঠলেই। আর তার পাশেই বিশাল একটা বটগাছ। গাছটার ডালপালা যেন আকাশ ছুঁয়েছে। গাছের শিকড়গুলো ব্রিজের কাঠের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এসেছে, কেমন যেন এক ভয়াল দৃশ্য।

গল্পটা বেশ পুরনো। বহু বছর আগে, এই বটগাছের নিচে একজন বৃদ্ধকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। তখন থেকে এই গাছটা অভিশপ্ত বলে লোকমুখে প্রচলিত। বৃদ্ধের আত্মা নাকি এই গাছের সঙ্গে মিশে গেছে, রাত হলে সে নাকি তার হত্যার প্রতিশোধ নিতে আসে। রূপা জানে এই গল্প, কিন্তু সে কখনো বিশ্বাস করেনি। তবে আজ যেন নিজের বিশ্বাসের প্রতি সন্দেহ জাগছে। গা শিরশির করছে, মনে হচ্ছে কেউ তাকে অনুসরণ করছে।

সে ব্রিজটা পাড়ি দেওয়ার জন্য পা বাড়ালো। প্রথম কয়েকটা পা রাখতে গিয়েই মনে হলো ব্রিজটা কাঁপছে। হালকা ঠাণ্ডা বাতাস বইছে, আর সেই বাতাসের সঙ্গে কেমন যেন একটা শিরশিরে শব্দ। রূপা আতঙ্কিত হয়ে এগোতে লাগলো। কিন্তু যতই এগোতে লাগলো, ব্রিজটা যেন আর শেষ হচ্ছে না। মনে হচ্ছে, ব্রিজটা হঠাৎ করে আরও লম্বা হয়ে গেছে।

হঠাৎ, পেছনে কারো পায়ের শব্দ পেল রূপা। ধীর লয়ে, ভারী পায়ের আওয়াজ, যেন কেউ রূপার পেছন পেছন আসছে। রূপা ভয়ে পিছনে তাকালো, কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না। তার কপাল থেকে ঘাম ঝরতে লাগলো। আবার পা চালিয়ে এগোতে লাগলো, কিন্তু পায়ের শব্দটা যেন আরও কাছে চলে এলো। এবার সে আর সাহস করে পিছনে তাকালো না। দৌড়াতে শুরু করলো। যতই দৌড়াচ্ছে, মনে হচ্ছে পায়ের নিচের মাটিটাই সরে যাচ্ছে।

ব্রিজের শেষ প্রান্তে পৌঁছানোর আগেই, হঠাৎ সামনে এক বিশাল সাদা ছায়া তার পথ রোধ করে দাঁড়ালো। ছায়াটা ধীরে ধীরে একটা রূপ নিচ্ছে। রূপা দেখতে পেল, এক বৃদ্ধা মহিলা, যার চুলগুলো একদম সাদা, চোখ দুটো যেন জ্বলন্ত লাল রক্তের মতো। মুখে এক অদ্ভুত হাসি, যা দেখলে রক্ত হিম হয়ে আসে।

রূপা দম বন্ধ হয়ে গেল। গলা শুকিয়ে কাঠ। সে কাঁপতে কাঁপতে বললো, “আপনি কে? আপনি এখানে কী করছেন?”

বৃদ্ধা হেসে বললো, “এত রাতে কোথায় যাচ্ছিস, মা? জানিস না, এই রাস্তা অভিশপ্ত?”

রূপা অস্ফুট স্বরে বললো, “আমি বাড়ি ফিরছি। আমাকে যেতে দিন।”

বৃদ্ধা মহিলাটি তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে বললো, “তুই বাড়ি ফিরতে চাস? আজ আর তোর ফেরা হবে না। এই ব্রিজটার ওপর আজও আমার প্রতিশোধের আগুন জ্বলছে।”

এই বলে বৃদ্ধা হঠাৎ করে অদৃশ্য হয়ে গেল। রূপার পায়ের নিচে মাটি সরে যেতে লাগলো। চারপাশ অন্ধকারে ঢেকে গেল। রূপা বুঝতে পারলো, সে এই ব্রিজে আটকা পড়ে গেছে। সে চিৎকার করতে লাগলো, কিন্তু কেউ শুনতে পেল না।

ঠিক সেই মুহূর্তে, রূপার সামনে এক ঝিলিমিলি আলো দেখা দিল। আলোর মধ্য থেকে ধীরে ধীরে একজন বৃদ্ধ ব্যক্তি বেরিয়ে এলো। তার মুখে গভীর বিষণ্ণতার ছাপ। রূপা আতঙ্কিত হয়ে পেছনে সরে গেল। বৃদ্ধ ব্যক্তি মৃদু স্বরে বললো, “তুই এত ভয় পাচ্ছিস কেন, মা? আমি তোর ক্ষতি করতে আসিনি। আমি শুধু চাই, তুই আমার কাহিনীটা শোন।”

রূপা অবাক হয়ে গেল। সে ধীরে ধীরে বললো, “আপনি কে? আপনার কাহিনী কী?”

বৃদ্ধ ব্যক্তি একটু দূরে দাঁড়িয়ে মৃদু হেসে বললো, “আমার নাম রঘু। আমি এই গ্রামেই জন্মেছি, বড় হয়েছি। একদিন কিছু দুষ্কৃতী আমাকে এই বটগাছের নিচে মেরে ফেলে। আমার আত্মা তখন থেকেই এই গাছের সঙ্গে মিশে গেছে। আমি শান্তি চাই, মুক্তি চাই। আমার কষ্টের অবসান চায়।”

রূপা চুপচাপ শুনছিল। তার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো। সে বললো, “কী করলে আপনার মুক্তি হবে?”

রঘু ধীরে ধীরে বললো, “তুই যদি আমার মৃতদেহের অবশিষ্ট হাড়গুলোকে পবিত্র জল দিয়ে ধুয়ে একটা মন্দিরে নিয়ে গিয়ে পূজা করিস, তবে আমার আত্মা মুক্তি পাবে। আর তুই নিরাপদে বাড়ি ফিরে যেতে পারবি।”

রূপা বুঝতে পারলো, সে ছাড়া এই বৃদ্ধের মুক্তি আর কেউ ঘটাতে পারবে না। সাহস সঞ্চয় করে সে বললো, “আমি চেষ্টা করবো।”

রঘু ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেল। রূপা বটগাছটার নিচে গিয়ে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করলো। বেশ কিছুক্ষণ খোঁড়ার পর, সে একটা কঙ্কাল খুঁজে পেল। কঙ্কালটা হাতে তুলে নিয়ে সে দ্রুত গ্রামে ফিরে গেল। গ্রামের মন্দিরের পুরোহিতকে সব ঘটনা খুলে বললো। পুরোহিত তাকে সাহায্য করতে রাজি হলেন। পবিত্র জল দিয়ে কঙ্কালটা ধুয়ে পূজা সম্পন্ন হলো।

পূজা শেষ হতেই রঘুর আত্মা আবার রূপার সামনে দৃশ্যমান হলো। তার মুখে প্রশান্তির হাসি। সে বললো, “তুই আমাকে মুক্তি দিলি, মা। তুই এখন নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারবি। তোর প্রতি আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা। তুই আর কখনো এই ব্রিজটা পাড়ি দেওয়ার সময় ভয় পাবি না। আমি তোর সাথে থাকবো, তোকে রক্ষা করবো।”

রঘু ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেল। রূপা মন্দির থেকে বেরিয়ে সেই ব্রিজটার দিকে পা বাড়ালো। এবার আর কোনো অদ্ভুত অনুভূতি হলো না। গাছটার নিচ দিয়ে সে নির্ভয়ে হেঁটে গেল। ব্রিজটাও আর দীর্ঘ হলো না। সে সহজেই ব্রিজটা পাড় হয়ে বাড়ি পৌঁছালো।

সেই রাতের পর থেকে, গ্রামের কেউ আর ব্রিজটা নিয়ে ভীত নয়। রূপার সাহসিকতা এবং বুদ্ধিমত্তার জন্য গ্রামবাসী তাকে ধন্যবাদ জানালো। অভিশপ্ত ব্রিজটা এখন মুক্ত। বটগাছটার নিচে আজও যেন রঘুর আত্মার শান্তির ছায়া বিরাজ করছে।

© পিনাকী রঞ্জন পাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *