উত্তরবঙ্গ থেকে আয়োজিত প্রথম যৌথ পর্বত অভিযান নিয়ে লিখেছেন বিশিষ্ট পর্বতারোহী ভাস্কর দাস।
উত্তরবঙ্গের অ্যাডভেঞ্চার ক্লাবগুলো এবার একসাথে হাতে হাত মিলিয়ে হিমালয়ের দুর্গম পর্বত শৃঙ্গ অভিযানে। এই ধরণের মিলিত উদ্যোগ উত্তরবঙ্গ তো বটেই পশ্চিমবঙ্গেও এই প্রথম। লাদাখ হিমালয়ের প্রায় একুশ হাজার ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট পোলোগংকা শৃঙ্গের মাথায় উত্তরবঙ্গের পতাকা ওড়ানোর উদ্দেশ্যে উত্তরের অভিযাত্রীদের যাত্রা শুরু আগামী ১লা জুলাই।

উত্তরের এই অঞ্চলের অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় ছেলেমেয়েদের মধ্যে প্রতিভার অভাব নেই তবে রয়েছে সুযোগের অভাব। ছেলেমেয়েরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে পর্বতেরোহণের কোর্স সম্পন্ন করলেও পর্বত অভিযানে যাওয়ার সুযোগ তাঁদের হয় না বিভিন্ন কারণে। যার মধ্যে আর্থিক কারণই মুখ্য। অ্যাডভেঞ্চার ক্লাবগুলোর কোনো আর্থিক সংস্থান নেই। সদস্যদের চাঁদাতেই চলে ক্লাবগুলোর কর্মকান্ড। নেই কোনো সরকারি বা বেসরকারি অর্থের যোগান। অন্যদিকে এককভাবে একটা দল তৈরী করে অভিযান করার জন্য দরকার বেশ কিছু সংখ্যক শিক্ষিত পর্বতারোহী আর সেই সঙ্গে দরকার প্রচুর অর্থের। এই দুটো ক্ষেত্রেই উত্তরের সিংহভাগ ক্লাবগুলো রয়েছে অনেক পিছনে।
এই সমস্ত কারণেই যৌথ উদ্যোগে এই পর্বতারোহণের আয়োজন। এটাই হয়তো সময়ের দাবী। এই উদ্যোগের মাধ্যমে একদিকে যেমন উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অ্যাডভেঞ্চার ও পর্বতপ্রেমী ছেলেমেয়েরা উচ্চ হিমালয়ের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারবে, অন্যদিকে ক্লাবগুলোকেও শুধুমাত্র এক দুজনেরই দায়িত্বই নিতে হবে।
আলিপুরদুয়ার থেকে শিলিগুড়ি, উত্তরের ছয়টি অ্যাডভেঞ্চার ক্লাব একত্রিত হয়েছে দুর্গম এই অভিযানের লক্ষে। ১২ জন সদস্যের দল তৈরি হয়েছে এই মিশনের জন্য। নেতৃত্বের গুরুদায়িত্ব পড়েছে আমার উপর। বাকি সদস্যরা হলেন, জয়ন্ত সরকার, সুজয় বনিক, ত্রিদিব সরকার, ডঃ স্বরুপ খান, হিরক ব্রহ্ম, নবনিশ দত্ত, পিয়ালী বিশ্বাস, আমুল ঠাকুর, সায়ন ঘোষ, পার্থ প্রতিম দে এবং সুস্মিতা সরকার। এই ১২ জন সদস্য ছাড়াও, দলের সঙ্গে দুইজন গাইড এবং দুইজন কিচেন স্টাফ যোগ দেবেন লাদাখ থেকে। যারা অভিযাত্রীদের সাথে মূল শিবিরে যোগ দেবেন আগামী ৭ই জুলাই।
রোভার্স অ্যান্ড মাউন্টেনিয়ার্স ক্লাব, আলিপুরদুয়ার, কুচবিহার মাউন্টেনিয়ার্স ক্লাব, ওদলাবাড়ী নেচার অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার সোসাইটি, ময়নাগুড়ি এনভার্নমেন্ট অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার ক্লাব, নেচার অ্যান্ড ট্রেকার্স ক্লাব অফ জলপাইগুড়ি, নর্থবেঙ্গল এক্সপ্লোরার্স ক্লাব, শিলিগুড়ি থেকে বাছা হয়েছে এই ‘টীম নর্থবেঙ্গল’। এই সংস্থাগুলো ছাড়াও উত্তরের বাকি অন্যান্য সংস্থাগুলোও রয়েছে এই উদ্যোগের পাশে।
১লা জুলাই শিলিগুড়ি থেকে শুরু হবে যাত্রা। দিল্লী হয়ে অভিযাত্রীরা পৌঁছাবে হিমাচলের মানালি। সেখান থেকে দরচা ও লাদাখের সোকার লেক হয়ে দলটি আগামী ৭ই জুলাই পৌঁছাবে অভিযানের মূল শিবিরে, যার উচ্চতা প্রায় ১৬ হাজার ফুট। মূল শিবির বা বেস ক্যাম্পের উপরে বিভিন্ন উচ্চতাতে স্থাপন হবে আরও দুটি ক্যাম্প। এরপর সব কিছু ঠিক থাকলে আগামী ১২ বা ১৩ই জুলাই করা হবে শৃঙ্গ আরোহণের চেষ্টা। ১৯শে জুলাই পর্বতারোহীরা ফিরে আসবে শিলিগুড়ি।
এই শৃঙ্গ আরোহণ পর্বে পর্বতারোহীদের লাদাখের কঠিন অক্সিজেন বর্জিত অঞ্চলের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হবে। উচ্চতা জনিত শারীরিক সমস্যা ছাড়াও প্রচণ্ড ঠাণ্ডা হাওয়া ও সঙ্গে পাহাড় থেকে আলগা পাথর পড়ার সম্ভাবনাও রয়েছে এই শৃঙ্গ পথে, যেগুলোকে অভিযাত্রীদের সম্মুখীন হতে হবে।
ইন্ডিয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ফাউন্ডেশন থেকে ইতিমধ্যে অভিযানের প্রয়োজনীয় অনুমতি পত্র পাওয়া গিয়েছে। তবে এই অভিযানের জন্য এখনও পর্যন্ত কোন সরকারি বা বেসরকারি সাহায্যের আশ্বাস পাওয়া যায়নি। সদস্য এবং ক্লাবগুলোর নিজস্ব আর্থিক সংস্থানই একমাত্র ভরসা। তাই উত্তরের অ্যাডভেঞ্চার ক্লাবগুলো সর্বস্তরে সাহায্যের আহ্বান করছে। উত্তরের অভিযাত্রীরা উত্তরবঙ্গের পতাকা হিমালয় শৃঙ্গে উড়িয়ে দিতে বদ্ধপরিকর। দরকার শুধু সকলের এই উদ্যোগের পাশে থাকা।
উত্তরের অ্যাডভেঞ্চার ক্লাবগুলোর যৌথ এই উদ্যোগ এই অঞ্চলের অ্যাডভেঞ্চার ও পাহাড় প্রিয় ছেলে মেয়েদের হিমালয়ের বুকে থেকে অভিজ্ঞতা অর্জনের এক বিরাট সুযোগ এনে দেবে। আগামীতে এই অঞ্চলের আরো বেশী সংখ্যক ছেলে মেয়ে পর্বতেরোহণের কোর্স সম্পন্ন করে আরো উচ্চ হিমালয়ে যাওয়ার জন্য নিজেদের তৈরী করবে। তবে পর্বতারোহণ শুধু পাহাড়ের চূড়াতে পৌঁছানো মাত্রই নয়। পর্বতারোহণ একদিকে যেমন একজনের মানসিক ও শারীরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করে, অন্য দিকে এই খেলা একজনকে বিপদে স্থির থাকা, সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং যে কোনো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখিতে ঘাবড়ে না যাওয়া শেখায়। এই অভিযান ক্লাবগুলোর মধ্যে একটা সমন্বয় গড়ে তুলবে যা আগামীতে আরও যৌথ প্রোগ্রাম করতে নিঃসন্দেহে তাদেরকে উৎসাহিত করবে। এটা বলাই যায় উত্তরবঙ্গ আগামীতে হয়ত অন্যদেরও পথ দেখাবে এবং এগিয়ে আসতে উদবুদ্ধ করবে।