তিস্তা নদী – জলপাইগুড়ি ও উত্তরবঙ্গ

লেখক পঙ্কজ সেন

উত্তরবঙ্গের হৃদয় হলো জলপাইগুড়ি জেলা, আর জলপাইগুড়ির হৃদয় হলো আমাদের সকলের অতি প্রিয় তিস্তা নদী। তিস্তা উত্তরবঙ্গের প্রধান নদী এবং পশ্চিমবঙ্গের তৃতীয় বৃহত্তম নদী (গঙ্গা এবং দামোদরের পর)। হিন্দু পুরাণ অনুসারে এটি দেবী পার্বতীর স্তন থেকে উৎপন্ন হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে নদীটির বাংলা নাম তিস্তা এসেছে “ত্রিস্রোতা” বা তিনটি প্রবাহ থেকে। অষ্টাদশ শতকের প্রায় শেষ ভাগ পর্যন্ত এই নদীটি জলপাইগুড়ির দক্ষিণে তিনটি ধারায় প্রবাহিত হতো। যথা পূর্বে করতোয়া, পশ্চিমে পুনর্ভবা এবং মধ্যভাগে আত্রাই। অনুমান করা হয় যে, এই তিনটি ধারার অনুষঙ্গেই নদীটি “ত্রিস্রোতা” হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলো। কালক্রমে পরবর্তীতে সে তিস্তা নামে জনমানষে পরিচিতি পায়। তারও পূর্বে প্রাচীনকালে ঋক বৈদিক যুগে নদীটির নাম ছিল “সদানীর”।

তিস্তা নদীর উৎপত্তি ভারতের উত্তর সিকিমের হিমালয় পর্বতমালার অন্তর্গত জেমু হিমবাহ বা চোলামু লেক থেকে। নদীটির মোট দৈর্ঘ্য ৩১৫ কিলোমিটার। তার মধ্যে ১১৫ কিলোমিটার বাংলাদেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত। সিকিম এবং পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিংয়ের পাহাড়ি এলাকায় তিস্তার পান্না সবুজ জল মানুষকে পাগল করে দেয়। যা দেখে কাটিয়ে দেওয়া যায় ঘন্টার পর ঘন্টা। তিস্তার আবেগ তার রূপ বারবার মানুষকে টেনে নিয়ে যায় তার কাছে। পাহাড়ি এলাকায় তিস্তা “রংতু” নামে পরিচিত। তিস্তার অনেকগুলি উপনদী থাকলেও তার অন্যতম প্রধান উপনদী হলো রঙ্গিত। তিস্তা উত্তরবঙ্গবাসীর কাছে গঙ্গা নদীর মতোই এক অতি পবিত্র নদী। তাদের বিভিন্ন ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে তিস্তার জল ব্যবহৃত হয়। এই সমগ্র এলাকার মানুষের জনজীবনে নদীটির অপরিসীম গুরুত্বের জন্য তিস্তা নদীকে সিকিম ও উত্তরবঙ্গের লাইফ লাইন বলে। সিকিমের পার্বত্য এলাকা থেকে প্রথমে প্রবাহটি দার্জিলিং এর সমভূমিতে নেমে আসে। শিলিগুড়ি শহর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে সেবকের করোনেশন সেতু পেরিয়ে তিস্তা পশ্চিমবঙ্গের সমভূমি অঞ্চলে প্রবেশ করেছে। সেখান থেকে জলপাইগুড়ি জেলা হয়ে বাংলাদেশের লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম এবং গাইবান্ধা জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চিলমারী নদী বন্দরের দক্ষিণে ব্রহ্মপুত্র নদে মিলিত হয়েছে।বাংলাদেশে তিস্তা নদীর উপর অবস্থিত একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যারেজ হলো লালমনিরহাট জেলার ডালিয়া ব্যারেজ। উল্লেখ্য, জলপাইগুড়ির সীমানা অতিক্রম করে নদীটি নীলফামারী জেলার কালীগঞ্জ বা খড়িবাড়ি সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।

জলপাইগুড়ির জনজীবনে তিস্তা নদীর ভূমিকা অপরিসীম। এই নদীর তীরেই ১৭৭৩ সালে ইংরেজ সেনাপতি ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট বৈকুণ্ঠপুরের রাজা দর্পদেবের বাহিনীকে পরাস্ত করে রংধামালির দশ মাইল উত্তরে তার জঙ্গল ঘেরা দুর্গ দখল করে নেন। উত্তরবঙ্গের মানুষের প্রচলিত বিশ্বাস দেবী চৌধুরানীও আসতেন রংপুর থেকে বজরায় করে তিস্তা নদী ধরে। তারপর করলা নদীর পথে জলপাইগুড়িতে এসে গোশালার শ্মশান কালী মন্দিরে যেতেন। ১৯৬৫ সালের আগে তিস্তা সেতু গড়ে ওঠার আগে বর্তমান জলপাইগুড়ি শহরের জুবলি পার্কে অবস্থিত ছিল বার্নিশঘাট। সেখানে নৌকায় করে নদীর ওই পারে অবস্থিত বার্নিশের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা হতো। তৎকালীন সময়ে তিস্তার এই অঞ্চলে বাঘের মতো হিংস্র প্রাণীরা ঘুরে বেড়াতো। পঞ্চাশের দশকে তিস্তা নদীর তীরে এমনই একটি ১১ ফুট লম্বা বাঘ মেরে শহরে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিলেন বাঘারু রসিকলাল দে। সেই মৃত বাঘটিকে নিয়ে আসা হয় বর্তমান থানা মোড় এলাকায়। ১৯৬৮ সালের ৪ঠা অক্টোবর লক্ষী পূজার দিন তিস্তার ভয়াবহ ধ্বংসাত্মক রূপের কথা শহরবাসী আজীবন মনে রাখবে। জলপাইগুড়ি জেলা তথা শহরের আর্থিক মেরুদন্ড ভেঙে দেওয়ার ক্ষেত্রে এই বন্যার একটি গভীর প্রভাব ছিলো। এই ভয়াল রূপটির জন্যই তিস্তা নদীকে “উত্তরবঙ্গে দুঃখ” বলা হয়। পরবর্তীতে শহর পার্শ্ববর্তী গাজলডোবায় ১৯৭৩ সালে গড়ে ওঠে তিস্তা ব্যারেজ। ক্ষেত্র বিশেষে দেওয়া হয় বিভিন্ন নদী বাঁধ। এর ফলে তিস্তা হারিয়ে ফেলে তার পূর্বের ধ্বংসাত্মক রূপ। অনেকটা শান্ত হয়ে যায় সে! জলপাইগুড়ি শহরে তিস্তার সুখা মরশুমে বিভিন্ন প্রকার শাকসবজির চাষ করা হচ্ছে। বর্তমানে জুবলি পার্ক সংলগ্ন তিস্তা নদীর এলাকায় শীতকালে শহরের স্থানীয় জনগণ মহাসমারোহে বনভোজনের আয়োজন করে থাকে। শহরের দোলনা পুল (১৯৬১) ধ্বংস হওয়ার আগে পর্যন্ত এই তিস্তা নদীর তীরেই শহরের ৯০ শতাংশ ছট পূজার ঘাট করা হতো। তিস্তার বৈরালী ও শোল মাছ বরাবরই বিখ্যাত ছিলো। জেলার মূল প্রশাসনিক কেন্দ্রটি এই নদীর তীরে অবস্থিত। বর্তমানে তিস্তায় জলের প্রবাহ একদমই কম। নদী বিশেষজ্ঞ “কল্যান রুদ্র কমিটি” তিস্তার এই জলপ্রবাহ কমে যাওয়ার জন্য তিস্তা নদীর উপর গড়ে ওঠা জলবিদ্যুৎ প্রকল্প এবং নদী বাঁধগুলিকে দায়ী করেছেন। তার ওপর রয়েছে প্রতিবেশী বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের তিস্তার সুষ্ঠ জল বন্টনের দাবি।

আমার আপনার ভালোবাসা দিয়ে তিস্তাকে বাঁচাতেই হবে। বিবরণীটি লিখতে মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছে। তিস্তাকে নিয়ে আপনাদের অনুভূতি কমেন্ট বক্সে লিখে জানান। তিস্তাকে পুনরায় পুনর্জীবিত করার উপায় কি?

কৃতজ্ঞতা স্বীকার : গুগল।

ছবি সৌজন্যে ইন্টারনেট।

Leave a reply

  • Default Comments (0)
  • Facebook Comments

Your email address will not be published. Required fields are marked *