করলা নদীতে ঠাকুর ভাসান ও জলপাইগুড়ি

মূল লেখক : প্রদীপ সেনগুপ্ত
নতুন তথ্য সংযোজন ও রূপদান পঙ্কজ সেন

বাবুপাড়ার ঘাট ও সমাজ পাড়ার ঘাট ছিল জলপাইগুড়ি শহরে ঠাকুর বিসর্জনের এক অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র। দশমীর দিন করলা নদী একটু সাজগোজ করত। নদীর পারে বাঁশের খুঁটি পুঁতে তাতে আলো লাগানো হত। জলপাইগুড়ির সদ্য নীলমনি পাওয়ার হাউসের বেশি ক্ষমতা ছিল না। আলোগুলো টিমটিম করত কিন্তু তাতে উৎসবের আনন্দের কোন কমতি হত না। বিকেল হতেই সার সার নৌকা এসে জড়ো হত কোতয়ালি থানার সামনের ঘাটে। সেখান থেকে দুর্গা মাঈকী জয় বলে নৌকায় প্রতিমা ওঠানো হত। নৌকার উপর দুর্গা প্রতিমা আর ক্লাবের ছেলেরা। হ্যাজাক আর পেট্রোম্যাক্স এর আলোয় নৌকাগুলি ঝলমল করত। ছোটদের নৌকায় ওঠার অনুমতি ছিল না। দর্শনার্থীরা ঘাটে দাঁড়িয়ে দেখতো সোনার কমলের ন্যায় দুর্গার মুখগুলি। কোন পাড়ারটা বেশি সুন্দর হয়েছে, তাই নিয়ে বন্ধুদের সাথে তর্কাতর্কি হত। থানার সামনে থেকে শুরু করে সমাজ পাড়া হয়ে দিনবাজার পর্যন্ত করলার ধার ঘেঁষে হাজার হাজার মানুষে ভরে যেত। বহুদূর থেকে লোকে ভাসান দেখতে আসত। দুই-তিনটি নৌকা একত্র করে তাতে প্রতিমাগুলি তোলা হতো। প্রতিমা বহনের বড় নৌকাগুলোকে মাড় নৌকা বলা হত। অবশ্য বিসর্জন ঘাটে উপস্থিত শহরের অন্যান্য পরিবারের সদস্যরা মাঝারি ধরনের নৌকা ভাড়া করে করলার জলে ঘুড়ে বেড়াতো। প্রতিমা নিয়ে নৌকাগুলি নদীর মধ্যে ঘুরে বেড়াতো। আর বাজি পুড়ত। একটু বড়লোকেরা দামী জলবোমা, জলতুবড়ি এই সব পোড়াতো। জলবোমা ফাটার সময় বিশাল একটা জলোচ্ছাস উঠে আশেপাশের নৌকার আরোহীদের ভিজিয়ে দিতো। কোনো কোনো বিসর্জনের নৌকায় গ্রামোফোনের সাথে মাইক লাগিয়ে বাজতো সেই বছরের পূজার হিট গান, ‘আমি যে কত একেলা, তোমারই পথ চেয়ে চলেছি। আমারই তুমি শুধু আমারই……’। বর্তমানে যেখানে আর.বি দে কমপ্লেক্স রয়েছে পূর্বে সেখানে ছিল শান্তি স্টোরস। যার মালিক ছিল রাধা বল্লভ দে। পুজোর সময় গ্ৰ্যামোফোন, মাইক, হ্যাজাক, ডে-লাইট ইত্যাদি জিনিসপত্র পুজো কমিটিগুলিকে ভাড়া দিতেন। সবশেষে সাত পাক ঘুরিয়ে মহিলাদের উলু ও শঙ্খ ধ্বনি সহযোগে ঠাকুর বিসর্জন করানো হতো। সেই সময়ে, জলপাইগুড়িতে রাত নটা দশটা মানেই গভীর রাত। তখন একে একে প্রতিমাগুলিকে নদীতে নামিয়ে দেওয়া হত। আস্তে আস্তে নদীর ঘাট ফাঁকা হয়ে যেত। বিসর্জনের শেষ বাদ্যি বাজতে বাজতে পূর্ণার্থীরা নিজ নিজ ঘরের উদ্দেশ্যে রওনা দিত। বছরে ওই একটা দিন বন্ধুদের গলা জড়িয়ে রাত করে বাড়ি ফিরতাম। ফেরার সময় বলতে বলতে আসতাম, জলপাইগুড়ির মত এত সুন্দর ভাসান আর কোথাও হয় না। ৭০ এর দশকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত এরূপ বিসর্জন পর্ব শহরে চালু ছিল।

৯০ এর দশকের একেবারে শেষের দিক পর্যন্ত জলপাইগুড়ি শহরে নৌকায় করে দুর্গা প্রতিমা বিসর্জনের এই ধারা একমাত্র বজায় রেখেছিল শহরের বিগ বাজেটের পুজো “কল্যাণী গ্রুপ”। তারপরই আমাদের প্রিয় জল শহরের এই ঐতিহ্যবাহী ধারা একদম অবলুপ্ত হয়ে যায়। আজও দুর্গা ঠাকুর ভাসান হয়, যদি এখন ঘাটের সংখ্যা আগের থেকে অনেক বেড়েছে। কিন্তু সেই দিন, সেই মুহূর্ত, সেই আনন্দ আর হয়তো কোনদিনও ফিরে আসবে না।

ছবি ইন্টারনেটের সৌজন্যে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *