টিকটিকির শয়তানি (ফিলিপিন্সের লোককথা)

বলা হয়, কুমীর আর অজগর পরস্পরের মুখদর্শন পর্যন্ত করে না। যদি কোথাও তারা মুখোমুখি পড়ে যায় তবে দু’জনের মধ্যে এমন ভয়ঙ্কর যুদ্ধ হয় যে সম্পূর্ণ বন-জঙ্গল কেঁপে ওঠে। কেন এমনটা হয়?

পিনাকী রঞ্জন পাল : সে অনেক দিন আগেকার কথা। তখন কুমীর আর অজগরের মধ্যে বন্ধুত্ব ছিল গভীর। অজগর খাবার উপযুক্ত কোন শিকার করলে তা থেকে অর্ধেকটা অবশ্যই কুমীরকে দিত। আবার কুমীর শিকার পেলে সেটা অজগরের সাথে ভাগাভাগি করে না খেলে তার ভালো লাগতো না। এইভাবে একদিকে যেমন ওদের বন্ধুত্ব গাঢ় হচ্ছিল, অপরদিকে তেমনিই ওরা আর কোনদিন না খেয়ে থাকতো না। কেননা প্রতিদিন কেউ না কেউ তো শিকার পেয়েই যেত!

সেই জঙ্গলেই বাস করতো এক টিকটিকি। সে এত স্বার্থপর ছিল যে পুরো জঙ্গলে তার একজনও বন্ধু ছিল না। যখন সে কোন শিকার পেত তখন কয়েকদিনের জন্য তার ভোজনের ব্যবস্থা হয়ে যেত, কিন্তু যেদিন শিকার পেত না তখন তাকে বেশ কয়েকদিন না খেয়েই কাটাতে হতো। তাই যখন সে দেখতো যে বন্ধুত্বের ফলে অজগর আর কুমীর কোন দিনও খালি পেটে থাকতো না, তখন সে ঈর্ষায় জ্বলে যেত। তাই সে এই বন্ধুত্ব ভাঙ্গার প্রতিজ্ঞা করলো।

একদিন সকালে কুমীরের কাছে গিয়ে সে বললো-‘বড় ভাই, এখানে আছো কি?

কুমীর হেসে বলে—’আমি কি এতোই ছোট যে তোমাকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিতে হচ্ছে।’

টিকটিকি বললো- “না ভাই, তোমাকে কেন দেখা যাবে না, তুমি তো এই জঙ্গলের রাজা। কিন্তু ওরা যে বলে…।”

এতটা বলেই টিকটিকি সামান্য থামে। তাকে সংকোচ করতে দেখে কুমীর জিজ্ঞেস করে—‘ওরা কি বলে?’

-‘না-না, আমার তা বলা উচিত হবে না”।

“বলো, বলো, অতো সংকোচ করছো কেন?’

—’ঠিক আছে। তুমি অতোই যখন জেদ করেছো, তখন বলেই দিই, ওদের মতে তোমার আকার বড় হলেও শক্তি নাকি খুবই কম।’

একথা শুনে কুমীর ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে বললো- ‘তুমিও যদি ওদের কথা বিশ্বাস করো তবে আমার লেজের এক ঝাপ্‌টা সহ্য করে দেখাও দেখি।’

–‘আরে, এসব কি আমার কথা নাকি। আমি তো তোমাকে রাজা বলেই মানি। আমি তো তোমারই এক বন্ধুর কথা বলছি।’

এবার কুমীর আত্মবিশ্বাসের সুরে বলে-‘আমার সমস্ত বন্ধুই আমায় ভীষণ ভালোবাসে, সম্মান করে।’


— “তোমার সামনে তো তারা তোমাকে ভালোবাসে, সম্মান করে। কিন্তু তোমার আড়ালে তারা কি বলে জানো? অবশ্য তুমি জানবেই বা কি করে। বিশেষ করে তোমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু…..।’

– “খবরদার, যদি আমার বন্ধু অজগরের বিষয়ে কোন কথা বলোতো”। কুমীর টিকটিকির মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে, ‘অজগর কখনো আমার সম্পর্কে মিথ্যে কথা বলতে পারে না, সে আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু।’


কিন্তু টিকটিকি সহজে দমে যাওয়ার পাত্র নয়। সে বলে- ‘সে যদি তোমার এতই প্রিয় বন্ধু হয়ে থাকে তবে কেন সে তোমাকে প্রতারণা করার কথা ভাবছে?’

পুনরায় কুমীর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। সে লেজ় আছড়ে তিরস্কার করে বলে- ‘চলে যাও এখান থেকে আর নিজের বিষাক্ত শব্দগুলিও সাথে নিয়ে যেও।”


-“আমি তো চলেই যাচ্ছি’; যেতে যেতে টিকটিকি বলে, ‘কিন্তু অজগর যদি তোমাকে প্রতারণা করে তবে বলতে পারবে না যে তোমাকে আগে থাকতে কেউ সাবধান করে দেয় নি।”

কুমীর ক্ষেপে গিয়ে বিড়বিড় করে এবং লেজের বাড়ি দিয়ে জল তোলপাড় করতে থাকে।

টিকটিকি সেখান থেকে অজগরের খোঁজে বেরিয়ে পড়লো। অজগর একটা গাছের সাথে জড়িয়ে সদ্য শিকার করা একটি জঙ্গলী শুকরকে মুখে ধরে রেখেছিল।

টিকটিকি এসে আওয়াজ দেয়—’বড় ভাই, এখানে আছো কি?”

অজগর হাসতে হাসতে জানতে “চায়—’আমি কি এতোই ছোট যে তোমাকে জিজ্ঞেস করতে হচ্ছে?’

–“না ভাই, তোমাকে কেন দেখা যাবে না, তুমি তো এই জঙ্গলের রাজা। কিন্তু ওরা যে বলে…।’

এতটা বলেই টিকটিকি সামান্য থামে। তাকে সংকোচ করতে দেখে অজগর বলে—’ওরা কি বলে?”

টিকটিকি এখানেও সেই একই ভাব করে যা করেছিল কুমীরের কাছে। বলে- ” না-না, আমার তা বলা উচিত নয়।’ অজগর আগ্রহ সহকারে জিজ্ঞেস করে–‘বলো, বলো, অতো সংকোচ করছো কেন?’

—’ঠিক আছে। তুমি সত্যিই যখন জেদ করছো তখন বলেই দিচ্ছি। ওদের মতে তোমার আকার বড় হলেও শক্তি নাকি খুবই কম।’

‘তুমিও কি ওদের কথা বিশ্বাস করো নাকি?’ অজগর টিকটিকির কাছে জানতে চায়, ‘যদি করো তবে এসো তোমাকে আমার লেজে পেঁচিয়ে শক্তির পরীক্ষা দিই।’

‘আরে, এসব কি আমার কথা নাকি। আমি তো তোমার এক বন্ধুর কথা বলছি।’

“তোমার ইশারা কি তবে বন্ধু | কুমীরের প্রতি? কিন্তু ও সেরকম বন্ধুই নয় যে আমাকে ছোট বলবে। আমি তাকে কখনোই ছোট বলে ভাবি না। আমি তো এখনই এই শূকর নিয়ে তার সাথে ভাগাভাগি করে খাবার জন্য যাচ্ছি।’

একথা বলে অজগর শিকার নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকলে টিকটিকি আওয়াজ দেয় ‘ভাই, যদি সে তোমার এতোই বন্ধু তবে কেন সে তোমাকে মেরে ফেলার জন্য চিন্তা করছে?”

এবার অজগর ভীষণ রেগে গিয়ে বলে- ‘খবরদার, মুখ সামলে কথা বলো, নয়তো এখানেই পিষে রেখে দেব।’

টিকটিকি যেতে যেতে বলে- “আমি চলে যাচ্ছি, কিন্তু তোমার সেই বন্ধু যদি তোমার সাথে প্রতারণা করে তখন কিন্তু বলতে পারবে না যে কেউ তোমাকে সাবধান করে নি।”

কথাগুলো বলেই টিকটিকি দ্রুত লাফিয়ে লাফিয়ে কুমীরের কাছে পৌঁছে দেখলো যে সে একটি হরিণকে মুখে ধরে অজগরের দিকে এগোচ্ছে।

‘কুমীর ভাই, তুমি আমাকে ঘৃণা করলেও আমি কিন্তু কখনোই এটা দেখতে পারবো না যে কেউ তোমাকে প্রতারণা করুক’, টিকটিকি বলে।

-‘খবরদার, যদি আবার কখনো এরকম কথা আমার সামনে বলো তো”, কুমীর রেগে গিয়ে বলে, “আমি তো এখনোই বন্ধুর সাথে ভাগাভাগি করে খাবার জন্য হরিণ ধরে নিয়ে যাচ্ছি।’

কিন্তু টিকটিকি দমবার পাত্র নয়। যাওয়ার আগে চেঁচিয়ে বলে যায়—’কারও সাথে কেউ প্রতারণা করে এটা আমার পছন্দ নয়। তোমার প্রিয় বন্ধু তোমাকে হল করে মারার জন্য এদিকেই আসছে। সে একটা শূকর ধরেছে। যার অর্ধেকটা সে তোমাকে দেবে আর যখন তুমি খেতে ব্যস্ত থাকবে তখন ধোঁকা দিয়ে সে তোমাকে মেরে ফেলবে। সাবধানে থেকো।’

কথাগুলো শুনে কুমীর কিছুটা চিন্তায় পড়ে গেল। সে ভাবলো—’সত্যিই কি অজগর আমাকে ধোঁকা দিতে চায়? আমি হরিণের অর্ধেকটা দিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করবো যে কি জন্য ওর এতো রাগ।”

টিকটিকি এবার অজগরের কাছে গিয়ে উপস্থিত হয়। অজগর অতি বিশ্বাসের সাথে কুমীরের দিকে এগোচ্ছিল।

টিকটিকি বলে—’অজগর ভাই, অজগর ভাই, আমি বলেছিলাম না যে কুমীর তোমাকে মারার জন্য ছল করছে। ও প্রথমে তোমাকে অর্ধেক হরিণ খেতে দেবে আর তারপর তোমাকে ধোঁকা দিয়ে মেরে ফেলবে।’
অজগর প্রথমে তাচ্ছিল্য করলেও টিকটিকির শেষ কথাগুলো তার মনেও সন্দেহের জন্ম দিল।

সে ভাবলো- “যদি টিকটিকির কথা সত্যি হয় তাহলে তো মনে হচ্ছে যে কুমীর কোন ব্যাপারে রেগে গেছে। আমি ওকে অর্ধেক শূকর দিয়ে জিজ্ঞেস করবো ঘটনাটা কি?”

টিকটিকি এবার গাছের আড়ালে লুকিয়ে লুকিয়ে মজা দেখার আশায় অজগরের পিছনে চলতে লাগলো। কুমীর সামনে থেকে হরিণ নিয়ে আসছিল। আর বারে বারেই ডানে-বামে দেখছিল যে কোথাও কোন গাছের পিছন থেকে কেউ আক্রমণ না করে বসে। আর একদিক থেকে শুকর নিয়ে অজগর আসছিল। সে যখন দেখলো যে কুমীর ধীরে ধীরে দু’পাশে সন্দেহের চোখে দেখতে দেখতে আসছে তখন সে তাড়াতাড়ি একটি গাছের পিছনে লুকিয়ে পড়ে। কুমীর সামনে এলে পড়ে অজগর শুকরটিকে একদিকে ছুঁড়ে ফেলে কুমীরকে আক্রমণ করে। কুমীরও হরিণ ছুঁড়ে ফেলে নিজের ভারী শরীর নিয়ে অজগরের আক্রমণের জবাব দিতে থাকে। ভয়ংকর যুদ্ধ হলো আর শেষে দুইজনেই আহত হয়ে নড়া-চড়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে তাদের মারা যাওয়ার আগেই টিকটিকি সেখানে পৌঁছে দুদিকে দেখে বলে- ‘ভাই, আমি আগেই বলেছিলাম যে তোমার প্রিয় বন্ধু তোমাকে মারার জন্য আসছে। কিন্তু তুমি বিশ্বাস করলে না।’ দু’জনে এটাই ভাবলো যে একথা তাকেই উদ্দেশ্য করে টিকটিকি বললো।

বলা হয়, তখন থেকেই কুমীর আর অজগর পরস্পরের মুখদর্শন পর্যন্ত করে না। যদি কোথাও তারা মুখোমুখি পড়ে যায় তবে দু’জনের মধ্যে এমন ভয়ঙ্কর যুদ্ধ হয় যে সম্পূর্ণ বন-জঙ্গল কেঁপে ওঠে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *