পিনাকী রঞ্জন পাল
১৯০৮ সালের এপ্রিলের শেষাশেষি। বিহারের এক ধর্মশালায় দুই বাঙালি যুবক দীনেশ রায় আর দুর্গা সেন এসে ঘর ভাড়া নিলেন। ধর্মশালার মালিককে তাঁরা জানালেন, পথে তাঁদের টাকা-কড়ি চুরি হয়েছে। কলকাতায় খবর দিয়েছেন। টাকা এলেই চলে যাবেন। ঘর ভাড়া নিয়ে দুই যুবক সারাদিন শহরে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। দেখলেন মজঃফরপুর আদালত, বিচারক ভি এইচ কিংসফোর্ডের কোয়ার্টার, ইউরোপীয়ানদের ক্লাব। আর ভালো করে পর্যবক্ষেণ করলেন কিংসফোর্ডের গতিবিধি। দু’জনে আলাদাভাবে অনুসন্ধান করে জানলেন যে, কিংসফোর্ড কাছারিতে যাওয়া আসা ছাড়া বাড়ি থেকে খুব একটা বের হন না। কিন্তু কোয়ার্টারের কাছেই ইউরোপীয় ক্লাবে তাস খেলতে যান। ফেরেন সন্ধ্যার কিছু পরে ফিটন গাড়ি চড়ে।
৩০ এপ্রিল। রাত আটটার কাছাকাছি। ইউরোপীয় ক্লাবের পাশে একটি বড় গাছের প্রায়ান্ধকার ছায়ায় গুঁড়ির আড়ালে আত্মগোপন করে ফিটন গাড়িটিকে লক্ষ্য করে বোমা ছুঁড়লেন দুর্গা সেন। শক্তিশালী সেই বোমার আঘাতে ফিটন গাড়ি ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। আর গাড়ির সকলেই মারা গেলেন। কিন্তু যাঁকে হত্যা করার জন্য এই বোমা ছোঁড়া হয়েছিল সেই কুখ্যাত কিংসফোর্ড গাড়িতেই ছিলেন না। তাঁর পরিবর্তে আর এক ব্যারিস্টার মিঃ কেনেডির স্ত্রী ও কন্যা নিহত হলেন।
বোমার শব্দ শুনে ক্লাবের ইংরেজ সভ্যরা বেরিয়ে এলেন। কিংসফোর্ডও বেরিয়ে এলেন। এদিকে, বোমা ছুঁড়েই দুর্গা সেন এবং দীনেশ রায় দু’জনে বিপরীত দিকে দৌড় লাগালেন। মজঃফরপুর থেকে ২৩ মাইল দূরে ওয়েইনি স্টেশন সংলগ্ন একটি দোকান থেকে মুড়ি কেনার সময় দুর্গা সেনের কন্ঠে বাংলা ভাষা শুনে সাদা পোশাকের পুলিসের সন্দেহ হয়। ওরা তাঁকে জাপটে ধরে। দুর্গা সেনের দেহ তল্লাস করে দু’টি রিভলবার, ৩০টি কার্তুজ এবং দু’টি বোমা পায় পুলিশ।
অন্যদিকে আগের দিনই মোকামা স্টেশনে দীনেশ রায় মজঃফরপুরের পুলিশ সুপার আমস্ট্রং-এর হাতে ধরা পড়েন। কিন্তু দীনেশ ক্ষিপ্রতার সঙ্গে শরীরের এক গোপন স্থান থেকে ব্রাউনিং পিস্তল বার করে নিজের গলার নলিতে চেপে ধরে ট্রিগার টিপলেন। শ্বাসনালি ফুঁড়ে গুলি বেরিয়ে গেল।
আর দুর্গা সেন? জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের বিচার থেকে দায়রায় সোপার্দ হয়ে প্রায় তিন মাস পরে ১১ আগস্ট ১৯০৮ সালে মজঃফরপুর জেলে ফাঁসি হল দুর্গা সেনের। দেশ মাতৃকার বেদিতে নিভে গেল আর এক আরতির শিখা। মৃত্যুর সময় দুর্গা সেনের বয়স ছিল ১৮ বছর ৮ মাস। তিনিই হলেন বিপ্লবী বাংলায় প্রথম শহিদ।
কি, তোমরা ভাবছো দুর্গা সেন আবার কে? বাংলার প্রথম শহিদ তো ক্ষুদিরাম বসু। হ্যাঁ, তোমরা ঠিকই ধরেছো। আসলে বিচারক কিংসফোর্ডকে হত্যার জন্য মজঃফরপুরের ধর্মশালায় দীনেশ রায় আর দুর্গা সেন ছদ্মনামে ঘর ভাড়া নিয়েছিলেন দুই বিপ্লবী কলকাতার প্রফুল্ল ঢাকী এবং মেদিনীপুরের ক্ষুদিরাম বসু।
১৮৮৯ সালের ৩ ডিসেম্বর মেদিনীপুর জেলার কেশরপুর থানার বহুবনী গ্রামে ক্ষুদিরাম জন্মগ্রহণ করেন। বাবা ত্রৈলোক্যনাথ বসু নাড়াজোলের জমিদারের কাছারিতে তহশিলদারের কাজ করতেন। জন্মলগ্নেই ক্ষুদিরাম নামকরণের পেছনে একটা ঘটনা ছিল। ত্রৈলোক্যনাথের ৬টি সন্তান জন্মগ্রহণ করেছিল। প্রথম তিনটি মেয়ে-অপরূপা, সরোজিনী, ননীবালা। এরপর দুই ছেলে। দু’জনেই আঁতুর ঘরেই মারা যায়। তাই ক্ষুদিরামের জন্মের সময় একদিকে যেমন সকলেই খুশি আবার অন্যদিকে ভয়। এই নবজাতকটিও যদি অসময়ে হারিয়ে যায়। তাই গ্রামবাংলার একটা প্রচলিত প্রথাকে আঁকড়ে ধরে মা লক্ষ্মীপ্রিয়া নিজেকে সান্ত্বনা দিতে চাইলেন। নবজাত সন্তানের প্রাণ রক্ষার জন্য তিন মুঠো ক্ষুদের বিনিময়ে তাকে বিবাহিতা বড়দি অপরূপা দেবীর কাছে বেচে দেওয়া হল। ক্ষুদের বিনিময়ে বেচা হয়েছিল বলেই নাম হয়েছিল ক্ষুদিরাম।
কিন্তু অদৃষ্টের কি নির্মম পরিহাস। ক্ষুদিরামের ছ’বছর বয়সে মা মারা গেলেন। মায়ের পিছু পিছু বাবা। ব্যবধান মাত্র ছয় মাসের। তাই বাধ্য হয়ে বড়দি অপরূপা দেবীর আশ্রয়ে চলে এলেন ক্ষুদিরাম। ১৯০৪ সালের জানুয়ারিতে ক্ষুদিরামের বড় জামাইবাবু মেদিনীপুরে বদলি হয়ে চলে এলেন। কালবিলম্ব না করে ক্ষুদিরামকে ভর্তি করে দিলেন মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলে। এই স্কুলেরই এক শিক্ষক ক্ষুদিরামের মধ্যে লক্ষ্য করেছিলেন বিপ্লবের আগুন। ভারতে তখন ব্রিটিশ শাসন আর শোষণের রথ অপ্রতিহত গতিতে চলছে। আর পরাধীনতার জ্বালা ক্ষুদিরামকে কুরে কুরে খাচ্ছে। শিক্ষক মহাশয় ক্ষুদিরামকে বিপ্লব মন্ত্রে দীক্ষা দিলেন। গুরুর নির্দেশ পালন করে ক্ষুদিরাম কালীমূর্তির শানিত কৃপান দিয়ে বুকের রক্ত বার করে, সেই রক্তে ভেজা বেলপাতা অঞ্জলি দিয়ে বলেন, ‘মা তোমার কাছে নিজেকে বলি দিলাম’। আর তারপর তো ইতিহাস। একদিন বিপ্লবী হেমচন্দ্ৰ কানুনগোর তাগিদেই ক্ষুদিরামকে সুকুদা ওরফে বারীন ঘোষ আর প্রফুল্ল চাকীর, সঙ্গে পাঠালেন বিচারক কিংসফোর্ডকে হত্যা করতে। বন্দিনী দেশমাতৃকার শেকল ছেঁড়ার কাজে হাসিমুখে ফাঁসির দড়ি গলায় দিয়ে ক্ষুদিরাম মায়ের পায়ে বলি দিলেন নিজের জীবন। কিশোর ক্ষুদিরামের আত্মবলিদান ব্যর্থ হয়নি। স্বাধীনতার সূর্য ঝলমল করছে আজ আকাশে।
Photo Credit- google.