মৌমাছিদের ভাষা

পিনাকী রঞ্জন পাল

ঘরের মধ্যে একটা মৌমাছি (Bees) অনেকক্ষণ ধরেই ভনভন্ শব্দ করে উড়ছিল। উড়তে উড়তে মৌমাছিটা কখনও পাপুর কানের পাশ দিয়ে, কখনও হৃদির নাকের ওপর দিয়ে আবার কখনও পাপু – হৃদির ছোটমামার মাথার ওপরে ভনভন করছিল। এর ফলে ওদের তিনজনের গল্পের আসরে বারবার বাধা পড়ছিল। পাপু আর হৃদি ওদের ছোটমামার কাছ থেকে একটি মজার গল্প শুনছিল। গল্পে বারবার বাধা পড়ায় বিরক্ত হয়ে পাপু বলে ওঠে, ধুস্ মৌমাছিটা একদম কথা শুনছে না। বারবার গায়ের ওপর এসে গল্পের মজাটাই নষ্ট করে দিচ্ছে।

মৌমাছিটারও বোধহয় মামার গল্পটা ভাল লেগেছে। তাই গল্প শোনার জন্যই বারবার এখানে উড়ে আসছে। হৃদি মুচকি হেসে বলে।

আচ্ছা মামা, আমাদের মত মৌমাছিদেরও কি নিজস্ব ভাষা আছে? পাপ্পু, জানতে চায়।

ছোটমামা হেসে বলেন, অবশ্যই। আমরা যেমন পরস্পরের ভাষা বুঝতে পারি তেমনি মৌমাছিরাও একে অপরের ভাষা বুঝতে পারে।

মামা, মৌমাছিরাও কি আমাদের মত কথা বলে? হৃদির জিজ্ঞাসু মন প্রশ্ন করে।

মৌমাছিদের নিজস্ব ভাষা (The language of bees) আছে। তবে ভাষার মাধ্যম মানুষের মত কথা নয়। তাদের ভাষার মাধ্যম হল নাচ আর গান।

নাচগান! সেটা কিরকম? পাপু আর হৃদি একসঙ্গে প্রশ্ন করে।

শোন, তবে বলি। এই পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান জীব হচ্ছে মানুষ। মানুষ শুধু নিজেদের ভাষা জেনেই থেমে থাকেনি। মানুষ নক্ষত্রের ভাষা, বিভিন্ন জীবজন্তুর ভাষা বোঝার চেষ্টা করে চলেছে। কৌতূহলী ব্যক্তিরা এই নেশায় মেতে রয়েছেন।

সেরকমই এক কৌতূহলী ব্যক্তি হলেন কীটতত্ত্ববিদ অ্যাড্রিয়েন ওয়েনার। ইনি মেতে উঠলেন মৌমাছিদের ভাষা বোঝার নেশায়। বহুদিনের গবেষণা আর অক্লান্ত পরিশ্রমে ওয়েনার উদ্ধার করলেন মৌমাছিদের ভাষা।

পর্দা সরিয়ে পাপুদের মা ট্রে-তে করে খাবার নিয়ে প্রবেশ করলেন— নে এগুলো খেতে খেতে গল্প শোন। চানাচুর দিয়ে মাখা মুড়ি তিনজনের সামনে আর ছোটমামার সামনে চায়ের কাপ রেখে বললেন, দেখিস, সুজিত, ওরা যেন শুধু গল্পই না গেলে, মুড়িগুলোও যেন খায়।

মা বেরিয়ে যেতেই হৃদি বলে, মামা, তারপর……..

নে নে খাওয়া শুরু কর, চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ছোটমামা বলেন।

অ্যাড্রিয়েন ওয়েনারের মতে, কোন মৌমাছি যদি খাবারের সন্ধান পায় তবে তখনই একা সেটা খেলে ফেলে না। খাবারটা দেখার সঙ্গে সঙ্গে মৌচাকে ফিরে আসে।

ফিরে এসে যেদিকে খাবার আছে পেটটাকে ফুলিয়ে দুলিয়ে দুলিয়ে নাচতে থাকে। তার সঙ্গে গুনগুন আওয়াজে গান করতে থাকে। এই নাচগান দেখে মৌচাকের অন্য মৌমাছিরা বুঝতে পারে কোন খাবারের সন্ধান মিলেছে। শুধু তাই নয়, নাচের গতি আর গানের ধরন দেখে তারা বুঝতে পারে খাবারটা কোন্‌দিকে এবং কতটা দূরে আছে।

মৌমাছিরা কি শুধু খাবারের সন্ধান পেলেই গান করে? পাপু জানতে চায়।

না, না। বিভিন্ন কাজের জন্য ওদের প্রায় দশ ধরনের নাচগান প্রচলিত আছে। যেমন, অন্য কোন জীব দ্বারা মৌচাক আক্রান্ত হলেও মৌমাছিদের নাচগান করতে দেখা গেছে। এক্ষেত্রে গানের মাত্রা ও তীক্ষ্ণতা বেড়ে যায় আর ঘন ঘন ওঠানামা করতে থাকে মৌমাছিরা। মুড়ি চিবোতে চিবোতে ছোটমামা বলে চলেন।

তোরা নিশ্চয়ই জানিস যে প্রত্যেক মৌচাকে মাত্র একটা রানী মৌমাছি থাকে। এই রানী মৌমাছি হল মৌচাকের সর্বময় কর্ত্রী। এদের আওয়াজ আবার একটু ভিন্ন ধরনের।

সেটা কিরকম? হৃদির প্রশ্ন। রানী মৌমাছি দু’রকম আওয়াজে গান করে। এরা সম্পূর্ণ তৈরি হয়ে নিয়ে কোষ ফেটে যখন বেরিয়ে আসে তখনই সে বাঁশির হাল্কা মিষ্টি সুরে গান করে। এদের আর একরকম গান শোনা যায় যুদ্ধের সময়। এই সময় গানের আওয়াজ হয় ঠিক হাঁসেরা যেমন প্যাঁক প্যাঁক করে তেমন।

রানী মৌমাছি যুদ্ধও করে। কেন? দু’জনে জানতে চায়।

‘রানী মৌমাছি জন্মের পরই অন্য রানী মৌমাছিদের মেরে ফেলে। কিন্তু সহজেই তো আর মারা যায় না। এর জন্য যুদ্ধ করতে হয়। পাহারারত প্রহরীদের সঙ্গে বাধে তুমুল যুদ্ধ। এই যুদ্ধ চলে ২৪ ঘণ্টা থেকে এক সপ্তাহ পর্যন্ত। যুদ্ধের সময় সুরের কম্পাঙ্ক মাত্রা এত বেড়ে যায় যে ১০ ফুট দূর থেকেও শোনা যায়। আর সেইসঙ্গে চলে প্যাঁক প্যাঁক গান’। আচ্ছা মামা, মৌমাছিরা কিসের দ্বারা গান করে? গলা দিয়ে? হৃদির প্রশ্ন।

গলা নয়, মৌমাছিদের গানের উৎপত্তি হয় ডানা থেকে। ডানা দ্বারাই এর তীব্রতা ও তীক্ষ্ণতা নিয়ন্ত্রিত। মৌমাছিরা কিন্তু কান দিয়ে কিছু শুনতে পায় না। অনেকের মতে, পায়ের তলায় থাকা শব্দযন্ত্রের সাহায্যে এরা শুনতে পায়। আবার শুঁড়ের সাহায্যে এরা শুনতে পায়, তারও প্রমাণ পাওয়া গেছে। নেনে ওঠ, অনেক গল্প হয়েছে। এবার খেতে চল। মা এসে ওদের তাড়া দেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *