পিনাকী রঞ্জন পাল : এ বছর দেওয়ালিতে গুড়িয়াদের বাড়িতে একটিও প্রদীপ কেউ জ্বালায়নি। আশপাশের সব বাড়িতেই প্রদীপ জ্বলছিল। গুড়িয়ার জেঠু মারা যাওয়ায় তাদের বাড়িতে ছিল শোকের পরিবেশ। কিন্তু ছোট্ট গুড়িয়া কি অতশত বোঝে। তাই তার মন ছিল ভীষণ উদাস।
রাত বাড়লে উদাস মনেই গুড়িয়া ঘুমিয়ে পড়ে। হঠাৎ অনুভব করে, তার অন্ধকার ঘরে অজস্র প্রদীপ জ্বলে উঠল। নানা আকারের প্রদীপ ছিল অবর–কিছু বড়, কিছু ছোট আবার কতগুলি মাঝারি আকারের। কিছু প্রদীপ ছিল তেলে পরিপূর্ণ, আবার অনেকটায় ছিল অর্ধেক, কতগুলোয় তো তেল প্রায় ছিলই না। তেলে পরিপূর্ণ প্রদীপগুলোর দীপ্তি ছিল ভীষণ উজ্জ্বল, তেল ফুরিয়ে যাওয়াগুলো মিটিমিটি করে জ্বলছিল।
গুড়িয়া উঠে বসে দেখল, এ কোথায় এল সে। কোথাও কোন বাড়িঘর নেই। চারদিকে শুধু প্রদীপই প্রদীপ। গুড়িয়া আরও অবাক হল। এটা দেখে, আকাশটা যেন অনেক নিচে নেমে এসেছে। তারাগুলো আগের চেয়ে অনেক বড় বড় লাগছিল। সে প্রদীপমালার মধ্যে দাঁড়িয়ে চারদিকে দেখছিল। দূর থেকে একজনকে তার দিকে আসতে দেখে গুড়িয়া। দুধসাদা দীর্ঘ দাড়ির অধিকারী ব্যক্তিটি মুসলমান ফকিরদের মত চাপকান একটি কালো পরে ছিল।
কাছে এসে বৃদ্ধা বলেন, কি মেয়ে, প্রদীপ দেখছ? গুড়িয়া হ্যাঁ বলে মাথা নাড়ায়। বৃদ্ধ ব্যক্তি নিচু হয়ে এমন একটি প্রদীপ তুলে নেয় যার তেল ফুরিয়ে এসেছিল। তেল কমে আসায় তার শিখাটি দপদপ্ করছিল। বৃদ্ধ সেই প্রদীপটিকে কাত্ করে রাখে। প্রদীপের অবশিষ্ট তেল সলতেকে স্পর্শ করলে তার শিখা পুনরায় দৃঢ় হয়।
এই প্ৰদীপগুলো কেন জ্বলছে? গুড়িয়া জানতে চায়। অল্প হেসে বৃদ্ধটি উত্তর দেন, তোমাদের পৃথিবীতে যে সমস্ত মানুষ আছে, তাদের নামের প্রদীপ এগুলো।
-তাদের নামের প্রদীপ। গুড়িয়া বিস্মিত হয়।
– হ্যাঁ, প্রত্যেক ব্যক্তির নামের একটা করে প্রদীপ জ্বলছে। যে ব্যক্তির মধ্যে যতখানি সদ্গুণ আছে, তার প্রদীপে ততটাই তেল রয়েছে। যেভাবে এর তেল সলতের মাধ্যমে জ্যোতি প্রকাশ করে. সেইভাবেই মানুষের সদ্গুণ। নিজের নামের প্রদীপ দেখতে চাইবে। এসো, দেখাচ্ছি।
বৃদ্ধ ব্যক্তির পিছে পিছে গুড়িয়া চলতে থাকে। নিজের নামের প্রদীপ দেখার উৎসাহ তার ক্রমশ বাড়তেই থাকে। সে ভাবে, তার প্রদীপটা আকারে কত বড় হবে। সেটাতে কতটাই বা তেল আছে? তার শিখাটি কি বড় , না সেটা নিভেই গেছে? এরকম অজস্র প্রশ্ন তার ছোট মনে এসে ভিড় করল।
একস্থানে দাঁড়িয়ে বৃদ্ধ বলেন, এই দেখ তোমার নামের প্রদীপ। নিজের প্রদীপ দেখে ওড়িয়া ভীষণ খুশি হয়। এক লহমায় তার মন থেকে যা আশঙ্কা দূর হয়ে যায়। তার মুখে হাসি ফুটে ওঠে।
প্রদীপটি ছিল তারই মত আকারে ছোট, কিন্তু তার শিখা ছিল দীর্ঘকায় এবং সেটি ছিল তেলে পরিপূর্ণ। শুড়িয়া প্রশ্ন করে, এটা কি সদ্য জ্বালান হয়েছে?
– নাতো। অনেকক্ষণ ধরেই জ্বলছে। বৃদ্ধ জানাল।
— তবে যে এর তেল ভর্তি রয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে এখনই জ্বালানো হয়েছে।
আর একটি নিভে আসা প্রদীপ দেখে তাতে তার থেকে কিছুটা তেল ঢেলে দেয়। আরও একটি খালি হওয়া প্রদীপে তেল ঢেলে সে ফিরে এসে নিজের স্থানে প্রদীপটি রাখে। কিন্তু কি আশ্চর্য! তার প্রদীপটি পূর্বের মতই তেলে পরিপূর্ণ ছিল। এ কেমন জাদু–এতগুলো প্রদীপে তেল ঢালার পরেও তার ছোট্ট প্রদীপ ছিল তেল ভর্তি। গুড়িয়া বৃদ্ধের কাছে এর কারণ জানতে চায়।
বৃদ্ধ তার পিঠে হাত রেখে বলেন, এতে অবাক হওয়ারই কথা, আবার নয়ও। যেভাবে বিদ্যা খরচ করলে কখনওই তা কমে না, সেরকমই ভাল আদর্শ খরচ করলেও কখনওই তা কমে না, বরং বেড়েই চলে।
বৃদ্ধের কথা শুনে গুড়িয়া নিজের প্রদীপটি তুলে নিয়ে চারদিকে ঘুরতে থাকে। যেই কোন প্রদীপে তেল ফুরিয়ে আসতে দেখে সে সঙ্গে সঙ্গে নিজের প্রদীপ থেকে তাতে তেল ঢেলে দিতে লাগল। এরকম করতে করতে একসময় গুড়িয়ার মনে হল। সব প্রদীপের শিখাগুলোই যেন প্রোজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। তাদের মাঝে দাঁড়িয়ে গুড়িয়ার ভীষণ গরম লাগছিল। সে চোখ মেলে তাকায়। তাকাতেই দেখে সে নিজের বিছানায় শুয়ে আছে, আর জানলা দিয়ে সকালের রোদ তার মুখে এসে পড়েছে।
গুড়িয়া বিছানায় শুয়ে শুয়ে অনেকক্ষণ ধরে রাতের স্বপ্নের কথা ভাবছিল। তার মন ভীষণ খুশি ছিল। সে ভাবল, সারারাত জ্বলার পরে নিশ্চয়ই তার প্রদীপের তেল অনেক কমে এসেছে। তাই আজকের দিনে কিছু ভাল কাজ তাকে করতে হবে যাতে প্রদীপটি আবার তেলে ভর্তি হয়ে যায়। প্রদীপের তেল ফুরিয়ে না যাওয়ার রহস্য সে জেনে গেছে। এইজন্য এখন তার প্রদীপ কোনদিনও নিভে যাবে না, সেটাকে সর্বদা সে জ্বালিয়েই রাখবে।
(সুখবীরের একটি হিন্দি গল্পের ছায়া অবলম্বনে লেখা)