ছাতা কাহিনী

ছাতা নিয়ে জীবনে কোন ঘটনা ঘটেনি, এমন মানুষ পাওয়া ভার। এক একজন জীবনে যে কত ছাতা খুইয়েছেন তার সঠিক হিসাব হয়তো নিজেরাও দিতে পারেন না। রোদ-বৃষ্টির অন্যতম আপনজন ছাতার আবিষ্কার আর তার বিবর্তনের কথা শোনাচ্ছেন পিনাকীরঞ্জন পাল

ছাতা কাকে বলে? একজন লিখেছিলেন, ‘খানিকটা কালো কাপড় লোহার কতকগুলো শিক, আর বাঁশ কিংবা বেতের বাঁকানো বাঁটের সমবায়ে রোদ – জল আটকানো, গরু তাড়ানো, বেধড়ক মারপিট ইত্যাদি বহুমুখী উদ্দেশ্যসাধক একটা অপরিহার্য বস্তু।’ আজ থেকে বছর তিরিশ আগেও কালো রংয়ের ছাতার প্রচলনই বেশি ছিল, কিন্তু সময় আর ফ্যাশনের স্রোতে ছাতাও নিজের রূপ বদলে নিয়েছে।

ছত্রপতি : সেকাল ও একাল

আমরা ছাতা ব্যবহার করি মূলত বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচার জন্য, কিন্তু ছাতার আবিষ্কার হয়েছিল রৌদ্রের প্রখর তাপ থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য। ইংরাজিতে ছাতাকে বলা হয়- UMBRELLA, এটি আসলে ল্যাটিন ভাষার শব্দ। ল্যাটিনে ‘UMBA’ শব্দের অর্থ হল ‘ছায়া’। বলা হয় যে ছাতা বানাবার চিন্তা এসেছে গাছকে দেখে।

ছাতার জন্ম কাহিনি নিয়ে আমাদের পুরাণে একটি গল্প আছে। একদিন ভরদুপুরে জমদগ্নি মুনি তির- ধনুক নিয়ে শর চালনা অভ্যাস করছেন। তাঁর স্ত্রী রেণুকা এবড়ো খেবড়ো বালি পাথর ভরা রুক্ষ্ম ডাঙ্গা থেকে ছুটে ছুটে বাণগুলো কুড়িয়ে আনছিলেন। পরশুরামের মা হলে কি হবে, রেণুকার তখন তেজ ছিল না, ঘেমে নেয়ে গেলেন, পায়ের যন্ত্রণায় অস্থির। রেণুকার মন্থর গতি দেখে জমদগ্নি বুঝে নিলেন ব্যাপার। সূর্যের দিকে যেই শরসন্ধান করবেন অমনি ভগবান আদিত্যদেব ছুটে এলেন চর্মপাদুকা আর রৌদ্রজলবারনাথম উত্তম ছত্র নিয়ে। এই হল ছত্র -পাদুকার জন্মকাহিনি। এই কাহিনি আছে মহাভারতেও। এছাড়া ছাতার বর্ণনা আছে রামায়ণ, হর্ষচরিত, কাদম্বরী, দশকুমার চরিত প্রভৃতিতে। কালিদাসের দুষ্মন্ত বলেছিলেন- ‘রাজ্যং স্বহস্তধৃতদন্ডমিরাতপত্রম’ অর্থাৎ প্রকান্ড ভারি ছাতা সর্বক্ষণ নিজেকে বইতে হলে যেমন আরামের চেয়ে ক্লেশই বেশি রাজত্ব করাও তেমনি অবসরবিহীন শ্রমের কাজ। ভগবান রামচন্দ্রের ছবিতে ছত্রধারী হিসাবে তাঁর ভাই লক্ষ্মণকে দেখা যায়। অন্যথায় সমস্ত রাজদরবারে এই কাজের জন্য মহিলাদের নির্বাচন করা হত। অজন্তার ছবি থেকে শুরু করে মধ্যযুগের মোগল আর রাজস্থানী ছবিতে ছত্রধারিণীরা রাজার পার্শ্বচর।

The story of the past and the present of the umbrella

আজ থেকে চার হাজার বছর আগে। প্রাচীন গ্রীসে রাজপরিবারের লোকেরা ছাতা মাথায় ঘোরা নিয়ে গর্ববোধ করতেন। সেই সময় অবশ্য ছাতার আকারও ছিল বিচিত্র। তিন ফুট লম্বা সোনার দন্ডের ওপরে হীরা-মতি জড়ানো মখমল থাকতো। সেটি চারটি পাতলা কাঠের লাঠির ওপরে থাকতো। অবশ্য এই ছাতা বৃষ্টির উপযুক্ত ছিল না।

ছাতা সম্পর্কে বিশ্বের বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে এ রলেখা রয়েছে, দেবতাদের মাথায় ছায়ার জন্য সোনা বা রূপার ছত্র লাগানো হত। কালীঘাট মন্দিরে রাজা নবকৃষ্ণ দেব সোনার ছাতা দিয়েছিলেন। মাদুরায় মীনাক্ষী, দেবীর মন্দিরে আছে আগাগোড়া মুক্তোর ছাতা। মা-ঠাকুমার ঠাকুরঘরে পেতলের সিংহাসনে পেতল বা রূপোর ছোট ছোট ছাতা মাথায় শালগ্রাম বা শিবলিঙ্গ কিংবা বালগোপাল তোমরা অবশ্যই দেখে থাকবে।

অনেকের মতে, চীন দেশে দশম শতকে ছাতার ব্যবহার ছিল। তারপর গ্রীস-এর মহত্ব বাড়তে থাকে। এরপরে জাপানি জাপানেও ছাতার প্রচলন শুরু হয়। অষ্টাদশ শতকে ছাড়া নতুন রূপ পায়। আমেরিকাতে ফোল্ডিং ছাতার আবিষ্কার হয় ১৭৩৪ সালের ৫ আগস্ট। এই ঘটনাকে মনে রেখে আমেরিকার শিশুরা প্রতি বছর ৫ আগস্ট সেদেশে ‘ছাতা দিবস’ পালন করে। কেউ কেউ আবার বলেন যে, পারস্যের এক কারিগরের হাতেই ১৭১৫ সালে ফোল্ডিং ছাতার আবিষ্কার হয়েছিল।

একালে ছত্রপতি সকলেই। এখন ঘরে ঘরেই ছাতা। কিন্তু এমন এক সময় ছিল যখন সাধারণ মানুষ ছাতা ব্যবহার করার কথা ভাবতেই পারতেন না কিংবা নিজস্ব ছাতা রাখার সামর্থও ছিল না। পুরাকালে শুধু দেবতা বা রাজা মহারাজাদের মাথার ওপরই ছাতা ধরে রাখা হতো, ছাতা মাথায় চলেছেন রাজ চক্রবর্তী। এইসব ছাতা বহন করার জন্য থাকতেন ছত্রবাহক। রাজকীয় ছাতার নাম ছিল ‘ওস্তাদ’। যুবরাজের ছাতার নাম ছিল ‘প্রতাপ’। সভাসদদের ছাতার নাম ছিল ‘কণকদন্ড’। রাজছত্রের দৌলতেই শিবাজী ছত্রপতি।

পুরনো কলকাতার ছবিতে কাশীর ঘাটের পান্ডা পুরোহিতদের সেই বিশাল ছাতার মতই বড় বড় ছাতার তলে চৌরঙ্গি এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন সাহেব-বিবিরা। তাঁদের মাথার ওপর ছাতা ধরে আছে এ দেশীয় সেবক ছাতাবরদার। অন্যান্য পেশার মত এটাও একটা চাকরি ছিল সেকালে। কিন্তু আজ সকলেই ‘ছত্রপতি’ হওয়ায় সেই চাকরিও গেল। আজ ছাতা মহিলাদের হ্যান্ডব্যাগে কিংবা পুরুষদের | পোর্টফোলিওতে দিব্য স্থান করে নিয়েছে।

ছাতা হয়ে উঠেছে শৌখিন। আজকাল লেডিস ছাতা খুললে ফুল বলে ভুল হতে পারে। হালকা ফিনফিনে ফুলেল বাহারি এই সব ছাতা রোদ কিংবা বৃষ্টি ঠেকাতে কতখানি পারে সেটা অন্য প্রশ্ন।

তবে আজ ছাতা আমজনতার সম্পত্তি হলেও একসময় সাধারণ মানুষ ছাতা ব্যবহার করার কথা ভাবতেই পারতেন না একথা আগেই বলা হয়েছে। একটা ঘটনা বলি। ১৭৩০ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক স্তরের ছাত্রদের ব্যবহারের জন্য একটি মাত্র ছাতা ছিল এবং সেটি ব্যবহার করতে হলে এক সপ্তাহ আগে কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করতে হত। আবার এমনও ছিল, কোনো বিশেষ সম্মানীয় ব্যক্তির সামনে ছাতা ব্যবহার করাও অপরাধ বলে গণ্য হত। বাংলাদেশে আর ওড়িশায় বিধবাদের মধ্যে জুতো আর ছাতা এই দুইয়ের ব্যবহার এককালে নিষিদ্ধ ছিল।

বাংলা সাহিত্যেও এই ছাতার উল্লেখ বারবার এসেছে। খেয়াল-খুশির রাজা সুকুমার রায়ের আঁকা ছাতা বগলে মানুষের ছবির সঙ্গে কিছু কবিতাও আছে যেমন, ‘সাত জার্মান জগাই একা তবু জগাই লড়ে/এলোপাতাড়ি ছাতার বাড়ি ধুপুস ধাপুস কত/চক্ষু বুজে কায়দা খেলায় চর্কিবাজির মত।’ কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্তের সঙ্গে ইন্দ্রনাথের প্রথম দেখার দিনেই ছিল ‘ছত্রভঙ্গ’। ইস্কুলের খেলার মাঠে দু’দলের ফুটবল ম্যাচ, একদল হেরে যেতেই মারামারি শুরু। অচিরে শ্রীকান্তের পিঠে আস্ত ছাতির বাঁট পটাশ করে ভাঙল। আরও গোটা দুই তিন গেল মাথা আর পিঠে। সেইসময় ইন্দ্রনাথ এসে শ্রীকান্তকে উদ্ধার করে।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতিতে কালো ছাতা মাথায় তাঁর মাস্টারমশায়ের যে হৃদয় বিদারক আর্বিভাবের বর্ণনা রয়েছে ভোলার নয়। মেডিকেল কলেজের কোনও ছাত্র অমরবাবু শিশু রবিকে পড়াতেন। তিনি কোনোদিনও কামাই করতেন না। একদিন মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। পুকুর ভেসে গেছে, রাস্তায় এক হাঁটু জল। মাস্টার মশারের আসবার সময় দুই চার মিনিট পেরিয়ে গেছে। তবু বলা তো যায় না তাই ছাত্র রাস্তার মুখে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ তাঁর বুকের মধ্যে হৃৎপিন্ডটা যেন আছাড় খেয়ে হা হতোহষ্মী বলে পড়ে গেল। দৈব দুর্যোগে অপরাহত সেই কালো ছাতাটি দেখা দিয়েছে।

ভারতে ছাতা তৈরির প্রথম কারখানা মুম্বাইতে আজ থেকে প্রায় ১১৫ বছর আগে। এক সরছিল। তখন ভারি আর কালো ছাতা তৈরি হত। বর্তমানে এদেশে প্রায় ৮০০ কারখানায় বিভিন্ন ধরনের প্রায় তিন কোটি ছাতা প্রতি বছর তৈরি হয়। এদেশের ছাতা ৫০টিরও বেশি দেশে রপ্তানি করা হয়।

ইদানীং ছাতার বদলে অনেকেরই ঝোঁক বর্ষাতির দিকে। তবুও ছাতার মাহাত্ম্য কিন্তু বিন্দুমাত্র কমেনি। ছাতা ছাতাই, ছাতার কোনো বিকল্প নেই।

Photo source- Pixel & Uttarbanga Sambad.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *