লেখক : পিনাকী রঞ্জন পাল
শঙ্করের সকাল শুরু হয় সমুদ্রের গন্ধে, মাছের আঁশটে ঘ্রাণে। কুঁড়েঘরের ছোট্ট উঠোনে বসে কাঁকড়া বাছছিল তার স্ত্রী রত্না। বুড়ি মা শান্তা তার পাশে, জোড়া পাটি পেতে বসে লাঠিতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিলেন। দিনের প্রথম আলো যেন ক্লান্ত, কালো মেঘের চাদরে মোড়া। কয়েকদিন ধরেই গ্রামের মানুষগুলোতে এক অদ্ভুত উৎকণ্ঠা, শঙ্কা কাজ করছে। খবর এসেছে—সাইক্লোন দানো ধেয়ে আসছে।
শঙ্করের পরিবারে দারিদ্র্যের ছাপ স্পষ্ট। মাটির ঘরের দেয়ালে ফাটল, ছাদের খড়ের ছাউনির কিছু অংশ উড়ে গেছে আগের ঝড়ে। এই দুর্দশার মধ্যেও জীবন চলছিল, চলছিল তাদের প্রতিদিনের সংগ্রাম। সমুদ্রের ওপর নির্ভর করেই তো তাদের জীবিকা। শঙ্করের বাবা-দাদাও মৎস্যজীবী ছিলেন। বাবা বলতেন, “এই সমুদ্র আমাদের সব দেয়, আবার সবকিছু কেড়েও নেয়।”
আরো পড়ুন : গল্পের নাম : সাজের আড়ালে
সাইক্লোনের খবর রত্নাকে ভয় পাইয়ে তুলেছে। সে বারবার শঙ্করকে বলে, “কিছু একটা করো। ঘরটাকে তো আর এই অবস্থায় ফেলে রাখা যাবে না। যদি সব উড়ে যায়?” শঙ্কর মুখে সান্তনা দেয়, “কিচ্ছু হবে না। এতবার দেখেছি ঝড়। সমুদ্র রেগে থাকে ঠিকই, কিন্তু শেষমেশ শান্ত হয়। আমরা যদি ভয় পাই, সমুদ্র আমাদের ধরেই ফেলবে।”
কিন্তু বুড়ি শান্তা একসময় গলা চড়িয়ে বলে ওঠেন, “আমরা বুড়ো হয়েছি বলে কিছু বুঝি না? এত বড়ো সাইক্লোন আগে আসেনি। ওদের কথা শোন, শঙ্কর। কিছু একটা ব্যবস্থা কর।” কিন্তু শঙ্কর কি করবে? হাতে টাকা নেই। গ্রামের সবাই নিরাপদ জায়গায় যেতে বলছে, কিন্তু কোথায় যাবে? তাদের সম্বল, তাদের ঘর—সব তো এখানে, সমুদ্রের কাছেই।
ঝড়ের আগের দিন, সমুদ্র তীরে এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে আসে। দূর থেকে কালো মেঘের ছায়া আরও গভীর হচ্ছে। বাতাসের বেগ বাড়ছে। গ্রামের মানুষদের চোখে আতঙ্ক। কিছু পরিবার ইতিমধ্যেই আশ্রয়কেন্দ্রে চলে গেছে, কিন্তু শঙ্করের পরিবার ছাড়া যাওয়ার উপায় নেই।
আরো পড়ুন : হাসির গল্প : গদাধর দাদু আর মোটরসাইকেলের মহাকাণ্ড
রত্না আর শান্তার চোখে উৎকণ্ঠা। রত্না বলে, “আমরা কি বাঁচব?” শঙ্কর এক মুহূর্ত চুপ করে থাকে, তারপর বলে, “একমাত্র ঈশ্বরই জানেন। আমরা শুধু আশা করতে পারি।”
রাত বাড়তে থাকে, আর ঝড়ের শব্দ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। বাতাসে ফিসফিসানি, যেন সমুদ্রের ক্রোধের আগমনী বার্তা। দূরের আকাশে বিদ্যুতের ঝলকানি, আর সমুদ্র থেকে ভেসে আসছে উত্তাল তরঙ্গের গর্জন।
সেই রাতে, শঙ্কর, রত্না, শান্তা—তারা তিনজনেই একে অপরের পাশে বসে থাকে, চুপচাপ। যেন ঝড়ের আগে এক কঠিন পরীক্ষার জন্য তারা প্রস্তুত হচ্ছে।
রাত বাড়ার সাথে সাথে বাতাসের তীব্রতা আরও বাড়তে থাকে। খড়ের ছাউনির কিছু অংশ উড়ে গিয়ে বাইরে পড়ে। রত্না ভয়ে শঙ্করের কাছে সরে আসে, শান্তা এক হাতে নিজের লাঠি আর অন্য হাতে রত্নার হাত ধরে। ঘরের ভিতর প্রতিটি শব্দ যেন ভয়াবহ শঙ্কার বার্তা নিয়ে আসে। কাঁচা ঘরের দেয়াল কাঁপতে থাকে, মনে হয় যেন এক মুহূর্তে সব ভেঙে পড়বে।
শঙ্কর বাইরে বেরিয়ে এসে ঘরের চারপাশে বাঁধা দড়ি দেখে। কিন্তু এ তুফানের সাথে লড়াই করার মতো কিছুই নেই। তার চোখে আতঙ্ক, কিন্তু মুখে দৃঢ়তা রেখে ঘরে ফিরে আসে।
আরো পড়ুন : গোয়েন্দা গল্প : গয়না চুরির রহস্য উদঘাটন
বৃষ্টির সাথে বাতাস আরও তীব্র হয়। সমুদ্রের গর্জন যেন সমুদ্র তার সমস্ত ক্রোধ নিয়ে আঘাত করতে আসছে। শঙ্কর জানে, এখান থেকে বাঁচতে হলে ঈশ্বরের উপরেই ভরসা রাখতে হবে।
রত্না চোখের জল চেপে রাখে, কিন্তু বৃদ্ধা শান্তা কাঁদতে থাকে, “আমার ছেলেরা… তোমরা কীভাবে বাঁচবে?”
শঙ্কর মাকে সান্তনা দিয়ে বলে, “মা, তুমি চিন্তা কোরো না। আমরা একসাথে আছি, সব ঠিক হয়ে যাবে।”
তাদের তিনজনের মধ্যেই এক মূক প্রত্যাশা—এই রাতটা যেন কেটে যায়, যেন বেঁচে থাকে ঘর, বেঁচে থাকে তারা।
রাত গভীর হতে থাকে, ঝড়ের তাণ্ডবও বাড়তে থাকে। ঘরের দেয়াল কাঁপতে কাঁপতে আর দাঁড়াতে পারছে না। হঠাৎ এক প্রবল ঝটকা ঘরের খড়ের ছাউনিটা খুলে নেয়, বৃষ্টির স্রোত ঘরে ঢুকে পড়ে। রত্না আর শান্তা ভয়ে চিৎকার করে উঠে। শঙ্কর তাড়াতাড়ি তাদের দুই হাত ধরে শক্ত করে বসে থাকে, যেন তারই হাত তাদের একমাত্র আশ্রয়।
শঙ্কর জানে, এই ঝড় তাদের এক রাতের নয়, জীবনের দীর্ঘ সংগ্রামের একটি অংশ মাত্র। ঝড় শেষ হবে, আবার জীবন শুরু হবে। কিন্তু সেই অস্থির রাতের প্রতিটি মুহূর্ত যেন একটা পরীক্ষার মতো—বাঁচার পরীক্ষা, স্থিতির পরীক্ষা।
আরো পড়ুন : গল্পের নাম : অনলাইন দুনিয়া আর অফলাইন মানবতা
ঘরটি পুরোপুরি ভেঙে পড়ে না, কিন্তু ক্ষতি ব্যাপক। ঘরের ভিতরটা ভিজে জলে ভেসে যায়। শঙ্কর আশ্রয়কেন্দ্রে যাবার কথা ভাবছিল, কিন্তু বৃদ্ধ মা শান্তা যেতে রাজি হন না। তার বিশ্বাস, এই জায়গা তাদের শত প্রজন্ম ধরে বাঁচিয়ে রেখেছে, এটা তাদের কোনোভাবেই ছাড়তে হবে না। রত্নাও তার মায়ের কথায় সায় দেয়।
ভোরের আলো আসার আগেই ঝড় কমতে থাকে, তবে শঙ্করের পরিবার জানে, আসল বিপর্যয় এখনও শেষ হয়নি। সমুদ্রের পাশের সবকিছু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শঙ্করকে এখন সমুদ্রেই ফিরে যেতে হবে রুটিরুজির জন্য, কিন্তু কোন মাছ থাকবে সমুদ্রে? সবকিছু তো সাইক্লোনে উড়িয়ে নিয়ে গেছে।
তারা ঘরের বাইরে এসে দেখে—সমুদ্র এখন শান্ত, কিন্তু গ্রামের চারপাশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। শঙ্করের চোখে জল আসে, কেমন করে সবকিছু আবার গড়ে তুলবে? কিন্তু রত্না তার পাশে এসে দাঁড়ায়, মুখে দৃঢ়তা, “আমরা আছি, শঙ্কর। আমরা আবার সবকিছু গড়তে পারব।”
শঙ্করের বুকের ভিতরে একটু আশা জাগে। যদিও জীবন তাদের বারবার আঘাত করেছে, কিন্তু তাদের দৃঢ় সংকল্পই তাদের ভরসা।
শঙ্কর, রত্না, এবং শান্তা ঘরের বাইরের ধ্বংসের দৃশ্য দেখে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে। শঙ্কর গভীর চিন্তায় পড়ে, কীভাবে আবার শুরু করবে, কীভাবে সবকিছু গড়ে তুলবে। গ্রামের অন্যান্য মানুষও একই পরিস্থিতির সম্মুখীন। তবে সবার মধ্যে আশার একটি সুপ্ত স্রোত প্রবাহিত হয়, একসাথে মিলে তাদের ঘরবাড়ি আবার পুনর্নির্মাণ করার আশা।
শঙ্কর সমুদ্রের দিকে তাকায়, তার পরিবারের অস্তিত্ব যে সমুদ্রের উপর নির্ভরশীল, তা জানে। রত্নার দৃঢ়তায় সে আবার শক্তি পায়। “আমরা পারব,” সে মনে মনে নিজেকে বলে, “এই ঝড় আমাদের ভাঙতে পারবে না।”
শান্তা উঠে দাঁড়ায় লাঠিতে ভর দিয়ে। বৃদ্ধা মা বলে, “শঙ্কর, জীবন ঝড়ের মতোই আসে, কিন্তু তুমি যখন বিশ্বাস রাখবে, তখনই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।”
শঙ্কর একটু হাসল, এবার তার চোখে আর ভয় নেই। “চলো, মা। আবার শুরু করি।”
আরো পড়ুন : একটি শিক্ষণীয় গল্প : ভাগ্যের সন্ধানে
শঙ্কর আবার সমুদ্রের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে, কিন্তু এবার তার মনের মধ্যে সেই অন্ধকার ঝড়ের পরও বেঁচে থাকার প্রতিজ্ঞা জাগ্রত হয়েছে।
শঙ্কর সেই দিন সকালে রওনা দেয় সমুদ্রের দিকে। চারদিকে ধ্বংসের চিহ্ন, তবু তার মনে একটা নতুন জাগরণ আছে। রত্না তাকে বিদায় জানায়, কিন্তু তার চোখে সেই ভয় মিশ্রিত উদ্বেগটা স্পষ্ট।
“সাবধানে যেও,” রত্না বলল, শঙ্করের হাত ধরে।
“চিন্তা করো না,” শঙ্কর হাসল। “সমুদ্র আমাদের সব কিছু দিয়েছে, আবার দেবে। ঈশ্বর চাইলে সব ঠিক হবে।”
সমুদ্রের পথে হাঁটতে হাঁটতে শঙ্কর ভাবে—এই ঝড় কেবল তাদের ঘর-বাড়ি নয়, তাদের মনও কাঁপিয়েছে। কিন্তু আজ আবার শুরু করতে হবে, বেঁচে থাকার তাগিদেই। মৎস্যজীবীদের জীবনটা এমনই—আজ সবকিছু ধ্বংস, কাল আবার নতুন করে গড়া।
গ্রামে এসে শঙ্কর দেখে, সবাই একসাথে কাজ করছে। ভাঙা ঘর মেরামত, কুঁড়ে ঘরগুলো আবার গড়ে তোলা হচ্ছে। সে দেখল, গ্রামের মাঝের কুঁড়েঘরে তার বন্ধু বীরেনও কাজ করছে। বীরেন তার দিকে হাত নাড়ল, “আরে শঙ্কর, দেরি করে ফেললি তো। চল, সবাই মিলে আবার সব গড়ে তুলতে হবে।”
শঙ্কর মাটিতে হাত দিয়ে উঠে বলে, “হ্যাঁ, দেরি হয়েছে, কিন্তু দেরিতে হলেও শুরু তো করতে হবে।”
রত্না আর শান্তা ঘরের মধ্যে সামান্য যা অবশিষ্ট আছে তা গুছিয়ে নেয়। রত্না জানে, তাদের এই সামান্য জমিটুকু আর সমুদ্রই সব। আর কিছু না থাকলেও, যতদিন এই জমি আছে, তারা একসাথে নতুন করে সব গড়ে তুলতে পারবে।
বিকেলে, শঙ্কর সমুদ্রে ফিরে আসে, সে জানে আজ মাছ ধরা হবে না, কিন্তু সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে সে আকাশের দিকে তাকায়। হালকা রোদ উঠেছে, কালো মেঘ সরে গেছে। সমুদ্র এখন শান্ত, যেন সবকিছুই নতুন করে শুরু হবে।
আরো পড়ুন : গোয়েন্দা গল্প : নায়েক ভিলার রহস্য
শঙ্কর গভীর শ্বাস নিয়ে বলে, “আমরা আবার পারব, সমুদ্র। আমাদের ছেড়ে যেও না।”
এই কথাগুলো বলতে বলতে সে উপলব্ধি করে, জীবনের ঝড় যেমনই আসুক, প্রত্যেকটা ঝড়ের পর একটা নতুন সকাল আসে। সমুদ্রও তেমন, যতই রেগে যাক, শেষে সে শান্ত হয় এবং জীবনের নতুন সম্ভাবনা এনে দেয়।
ঘরে ফিরে শঙ্কর দেখে, রত্না আর শান্তা মিলে তাদের ঘরটাকে যতটা সম্ভব গুছিয়ে তুলছে। আশপাশের মানুষও সাহায্য করছে।
শঙ্কর এবার স্থিরভাবে বলে, “আমরা পারব। এই ঝড় আমাদের জীবন থেকে অনেক কিছু কেড়ে নিলেও, আমাদের একসঙ্গে থাকার শক্তিটা কেড়ে নিতে পারেনি। আমাদের এই সমুদ্রই আবার আমাদের নতুন কিছু দেবে।”
রত্না একটুও সময় নষ্ট না করে বলল, “হ্যাঁ, যতদিন বেঁচে আছি, আমরা আবার শুরু করব।”
বৃদ্ধা শান্তা, যে এতদিন পর্যন্ত ঝড়ের ভয়েই ছিল, এবার শান্ত মুখে বলে উঠল, “আমার ছেলেরা যেমন এ সমুদ্রকে ভালোবাসত, তুমিও তেমনি ভালোবাসো। তাই এ সমুদ্র তোমাদের কখনো ছেড়ে যাবে না।”
ঝড়ের পর নতুন জীবনের আশা নিয়ে তারা আবার একসাথে দিন শুরু করে।
রাত পেরিয়ে যখন ভোরের আলো ফুটতে শুরু করে, ঝড়ের প্রলয় থেমে যায়। আশেপাশের সবকিছুই ধ্বংস হয়ে গেছে, কিন্তু শঙ্করের পরিবার জীবিত আছে। শঙ্কর, রত্না, এবং শান্তা জানে, নতুনভাবে বাঁচার লড়াই শুরু করতে হবে। শঙ্কর সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে দেখে, সেটি আবার শান্ত হয়েছে। ঝড় যতই ধ্বংস করুক, জীবনের শেষ কথা তো কখনও ঝড়ের নয়। একসাথে তাদের জীবন আবার গড়ার প্রত্যয়ে, শঙ্কর এবং তার পরিবার সিদ্ধান্ত নেয়—এখন বাঁচতে হবে, লড়াই করতে হবে, এবং নতুন করে স্বপ্ন বুনতে হবে।
তাদের সংগ্রাম সেখানেই শেষ নয়, তবে আশা থেকেই শুরু হয় প্রতিটি নতুন দিন।
© পিনাকী রঞ্জন পাল