পিনাকী রঞ্জন পাল
দার্জিলিংয়ের কুয়াশায় লুকানো রহস্য! এক ছায়াচিত্র, এক কিংবদন্তি, আর এক দুর্ধর্ষ চক্র। ফিরে এলেন গোয়েন্দা অরুণ সেনগুপ্ত, সত্যের খোঁজে!
অধ্যায় ১: রহস্যের সূত্রপাত
শীতের সকাল। দার্জিলিংয়ের বাতাসের শিরশিরানি কাঁচের জানালা ভেদ করে অরুণের ঘরে প্রবেশ করছে। প্রায় দু’দশক ধরে কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করার পর, অরুণ সেনগুপ্ত অবশেষে অবসর নিয়েছেন।
কোলাহলপূর্ণ শহর ছেড়ে তিনি দার্জিলিংয়ের এক নিরিবিলি কটেজে এসেছেন, যেখানে তার একমাত্র সঙ্গী তার প্রিয় বই আর এক কাপ ধোঁয়া ওঠা চা। দিনগুলো কাটছিল শান্তিতে, বই পড়ে আর প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য উপভোগ করে। কিন্তু নিয়তির হয়তো অন্য পরিকল্পনা ছিল।
অরুণের কটেজের লাগোয়া কটেজেই থাকতেন নীলাঞ্জন। পেশায় তিনি ফটোগ্রাফার, তবে শখের বশে। প্রকৃতির ছবি তুলতে ভালোবাসতেন। বিশেষ করে দার্জিলিংয়ের কুয়াশার সৌন্দর্য তাকে মুগ্ধ করত। সেদিনও সকাল সকাল নীলাঞ্জন ক্যামেরা হাতে বেরিয়েছিলেন। চারিদিক ঘন কুয়াশায় ঢাকা। দৃষ্টি কয়েক ফুট দূরেও পৌঁছায় না। নীলাঞ্জন এমন কুয়াশার মধ্যে ছবি তুলতেই বেশি পছন্দ করতেন। হঠাৎ, তার ক্যামেরার লেন্স ভেদ করে এক অদ্ভুত দৃশ্য চোখে পড়ে। ঘন কুয়াশার আবরণের মধ্যে আবছা এক ছায়ামূর্তি। অত্যন্ত দ্রুতগতিতে তা মিলিয়ে গেল, যেন কুয়াশার অংশবিশেষ। নীলাঞ্জন প্রথমে ভেবেছিলেন হয়তো চোখের ভুল, বা কুয়াশার কোনো অদ্ভুত খেলা। কিন্তু তার অভিজ্ঞ চোখ তাকে ধোঁকা দিতে পারে না। তিনি দ্রুত কয়েকটি ক্লিক করেন। নিশ্চিত হতে পারছিলেন না, আদৌ কিছু লেন্সবন্দী হয়েছে কিনা।
সন্ধ্যায় নীলাঞ্জন তার ক্যামেরার মেমোরি কার্ড থেকে ছবিগুলো ল্যাপটপে লোড করছিলেন। হঠাৎ একটি ছবিতে চোখ আটকে গেল। অবিশ্বাস্য! কুয়াশার আবছা ক্যানভাসে স্পষ্ট না হলেও, একটা মানবাকৃতির অবয়ব ধরা পড়েছে। কালো, অস্পষ্ট, কিন্তু তার মনে এক শিহরণ জাগিয়ে তোলে।
পরদিন সকালে নীলাঞ্জন অধীর আগ্রহে ছবিগুলো নিয়ে অরুণের কাছে এলেন। অরুণ তখন বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিলেন। নীলাঞ্জনের অস্থিরতা দেখে তিনি হেসে বললেন, “কী ব্যাপার নীলাঞ্জন, সকাল সকাল এত উত্তেজিত কেন?”
নীলাঞ্জন ল্যাপটপটা অরুণের দিকে ঘুরিয়ে দিলেন। অরুণ ছবিটা দেখে মুহূর্তেই গম্ভীর হয়ে গেলেন। তার অভিজ্ঞ চোখ বুঝতে পারছিল, এটা নিছকই কুয়াশার খেলা নয়। ছায়ামূর্তিটি এতটাই অস্পষ্ট যে তাকে চিহ্নিত করা অসম্ভব, কিন্তু তার উপস্থিতি অরুণের মনে এক গভীর কৌতূহল জাগিয়ে তুলল। দীর্ঘদিনের গোয়েন্দা জীবনের অভিজ্ঞতা তাকে বলেছিল, যেখানে রহস্য, সেখানেই সত্যের খোঁজা উচিত।
অরুণ কাপটা নামিয়ে রেখে বললেন, “নীলাঞ্জন, এই ছবিতে কিছু একটা আছে। এটা নিছকই কুয়াশার বিভ্রম নয়।” তার কণ্ঠস্বরে স্পষ্ট বোঝা গেল, অবসর ভেঙে হয়তো তিনি আবার তার পুরনো রূপে ফিরছেন।
অধ্যায় ২: পুরোনো কিংবদন্তি
অরুণের কৌতূহল নীলাঞ্জনের উৎসাহকে আরও বাড়িয়ে দিল। সেদিন বিকেলে দু’জন মিলে স্থানীয় বাজারে গেলেন। উদ্দেশ্য – কিছু পুরোনো কাহিনীর খোঁজ করা। পুরোনো বাজারে স্থানীয়দের আড্ডা জমে, আর সেখানেই লুকিয়ে থাকে অনেক লোককথা। অরুণ তার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে বাজারের এক বয়স্ক চা বিক্রেতার সাথে কথা শুরু করলেন। কথার মাঝেই তিনি কুয়াশার প্রেতাত্মা বা অদ্ভুত ছায়ামূর্তির কথা তুললেন। বৃদ্ধ চা বিক্রেতা প্রথমে একটু ইতস্তত করলেন, তারপর ফিসফিস করে বলতে শুরু করলেন এক পুরোনো কিংবদন্তির কথা।
“অনেক বছর আগে, এই পাহাড়ে এক অশুভ শক্তি ঘুরে বেড়াতো,” বৃদ্ধ বললেন। “ঘন কুয়াশার মধ্যে তার আবির্ভাব হতো, আর তারপরই গ্রামের কেউ না কেউ উধাও হয়ে যেত। কেউ বলত সে প্রেতাত্মা, কেউ বলত দানব। স্থানীয়রা তাকে ‘কুয়াশার প্রেতাত্মা’ নাম দিয়েছিল।” বৃদ্ধের গল্প শুনে অরুণ এবং নীলাঞ্জন দু’জনই হতবাক।
চা বিক্রেতা আরও বললেন, “অনেকে বলে, এই প্রেতাত্মা পুরোনো মন্দিরের আশপাশেই বেশি দেখা যেত, যেখানে অনেক অমূল্য জিনিস লুকিয়ে আছে।” তার কথায় একটা উদ্বেগ স্পষ্ট ছিল।
এরপর তারা কয়েকজন ট্যুরিস্ট গাইড এবং স্থানীয় অধিবাসীর সাথেও কথা বললেন। সবার কাছেই প্রায় একই ধরনের গল্প শোনা গেল। কিছু অন্তর্ধানের ঘটনা কয়েক দশক আগে ঘটেছিল, কিছু ঘটনা সাম্প্রতিক অতীতেও। কিন্তু অদ্ভুতভাবে, পুলিশ রেকর্ড বা স্থানীয় থানায় এ ধরনের কোনো অভিযোগ নথিভুক্ত ছিল না।
অরুণ বুঝতে পারলেন, এই কিংবদন্তি কেবল নিছকই গল্প নয়, এর পেছনে হয়তো কোনো সত্য লুকিয়ে আছে। সম্ভবত, কিছু মানুষ এই কিংবদন্তিকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে। নীলাঞ্জন তার ক্যামেরায় বৃদ্ধের এবং অন্যান্য স্থানীয়দের কথা রেকর্ড করে রাখলেন, যাতে পরে বিশ্লেষণ করতে পারেন।
সেদিন রাতে কটেজে ফিরে অরুণ একটি পুরোনো মানচিত্র নিয়ে বসলেন। মানচিত্রে সেই পুরোনো মন্দিরটির অবস্থান চিহ্নিত করার চেষ্টা করলেন, যার কথা বৃদ্ধ চা বিক্রেতা বলেছিলেন। তার মনে প্রশ্ন জাগল, এই “কুয়াশার প্রেতাত্মা”র আসল উদ্দেশ্য কী? এটা কি নিছকই গুজব, নাকি কোনো বড় অপরাধের আড়াল? তাদের অনুসন্ধানের প্রথম ধাপ শেষ হলো। তারা একটি সূত্র খুঁজে পেয়েছেন। কিন্তু সেই সূত্র তাদের কোন দিকে নিয়ে যাবে, তা তখনো অজানা।
অধ্যায় ৩: লুকানো সূত্র
পরদিন সকালে অরুণ ও নীলাঞ্জন পুরোনো মন্দিরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। মানচিত্র অনুযায়ী মন্দিরটি কটেজ থেকে বেশ খানিকটা দূরে, এক নির্জন পাহাড়ি পথে অবস্থিত। পথটা ছিল খুবই দুর্গম, চারিদিক ঘন জঙ্গলে ঘেরা। কুয়াশার কারণে দৃশ্যমানতাও কম। প্রায় দু’ঘণ্টা হাঁটার পর তারা মন্দিরের কাছে পৌঁছালেন। মন্দিরটি ছিল জীর্ণ, ভেঙে পড়া দেওয়াল আর শ্যাওলা ধরা পাথরের স্তূপ। দেখে মনে হচ্ছিল বহু বছর ধরে এখানে কোনো মানুষের আনাগোনা নেই।
তারা মন্দিরের ভেতরে প্রবেশ করলেন। চারিদিকে ছড়ানো পুরোনো ভাঙা মূর্তি আর ধুলোর আস্তরণ। নীলাঞ্জন তার ক্যামেরায় ছবি তুলছিলেন, আর অরুণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলেন প্রতিটি কোণ। হঠাৎ অরুণের চোখ পড়ল মন্দিরের এক ভাঙা স্তম্ভের দিকে। স্তম্ভের গায়ে খোদাই করা কিছু অদ্ভুত প্রতীক। প্রতীকগুলো দেখে অরুণের মনে হলো, এগুলি স্থানীয় কোনো প্রাচীন লিপির অংশ হতে পারে। তিনি তার ফোন বের করে প্রতীকগুলোর ছবি তুলে নিলেন।
কিছুক্ষণ পর নীলাঞ্জনের নজর গেল মন্দিরের পেছনের দিকে। সেখানে একটা ভাঙা দেয়ালের আড়ালে একটা ছোট সুড়ঙ্গের মতো কিছু একটা দেখা যাচ্ছে। সুড়ঙ্গটা এতোটা আবছা ছিল যে সহজেই চোখ এড়িয়ে যেতে পারতো। তাদের মনে হলো, এই সুড়ঙ্গটি হয়তো কোনো গুপ্ত পথের অংশ। দু’জন মিলে সুড়ঙ্গের ভেতর ঢোকার চেষ্টা করলেন।
ভেতরে ঢোকার পর, তারা আবিষ্কার করলেন সুড়ঙ্গটি একটি ছোট কক্ষের দিকে গেছে। কক্ষের ভেতরে আরো কিছু প্রতীক এবং চিত্র আঁকা ছিল, যা মন্দিরের প্রতীকের মতোই রহস্যময়। কক্ষের এক কোণে একটা ছোট ভাঙা বাক্সও পাওয়া গেল। বাক্সের ভেতরে কিছু পুরোনো পুঁথি ছিল, যা সম্ভবত প্রাচীন উপজাতিদের লেখা। পুঁথিগুলো জীর্ণ হয়ে গেলেও, কিছু লেখা এখনো পড়া যাচ্ছিল। লেখাগুলোতে বারবার “শিকারী”, “কুয়াশা” এবং “লুকানো ধন” শব্দগুলো উল্লেখ ছিল।
অরুণ বুঝতে পারলেন, এই পুঁথিগুলোই হয়তো “কুয়াশার প্রেতাত্মা” কিংবদন্তির উৎস। এই প্রতীক এবং লেখাগুলো হয়তো কোনো গুপ্তধনের ম্যাপ বা কোনো প্রাচীন রহস্যের চাবিকাঠি। তাদের মনে নতুন প্রশ্ন জাগল: এই গুপ্তধন কী? আর কারা এর পেছনে ছুটছে? তারা সাবধানে পুঁথিগুলো এবং কক্ষের ভেতরের সব কিছুর ছবি তুলে নিলেন।
মন্দিরের বাইরে আসার পর অরুণ বললেন, “আমাদের মনে হচ্ছে আমরা একটা বড় রহস্যের জাল ভেদ করতে চলেছি। এই প্রতীক আর পুঁথিগুলো নিছকই প্রাচীন কিংবদন্তি নয়, এর পেছনে কোনো বাস্তব উদ্দেশ্য লুকিয়ে আছে।” তাদের মনে হলো, এই লুকানো সূত্রগুলো হয়তো তাদের অপ্রত্যাশিত কোনো বিপদের দিকে ঠেলে দিতে পারে।
অধ্যায় ৪: বিপদের আগমন
পুরোনো মন্দির থেকে ফিরে আসার পর অরুণের মনটা বেশ অস্থির ছিল। পুঁথি এবং প্রতীকগুলো তার মনে নতুন চিন্তার জন্ম দিয়েছিল। তিনি নিশ্চিত ছিলেন, এর পেছনে কোনো বড় অপরাধ চক্র জড়িত। আর তাদের এই অনুসন্ধান সেই চক্রের চোখে পড়েছে। সেদিন বিকেলে যখন অরুণ তার কটেজের বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিলেন, তখন তার তীক্ষ্ণ নজর পড়ল রাস্তার ওপারে একটি কালো গাড়ির দিকে। গাড়িটি অনেকক্ষণ ধরে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন হয়তো কোনো পর্যটক, কিন্তু গাড়ির ভেতর থেকে দু’জন লোক বারবার তাদের কটেজের দিকে তাকাচ্ছিল। অরুণের পুরোনো অভিজ্ঞতা তাকে সতর্ক করে দিল। এটা নিছকই কাকতালীয় নয়।
তিনি নীলাঞ্জনকে ডাকলেন এবং ইশারা করে গাড়িটি দেখালেন। নীলাঞ্জন প্রথমে বুঝতে পারেননি, কিন্তু অরুণের সতর্ক চোখ তাকে বুঝিয়ে দিল যে কিছু একটা গড়বড় আছে।
অরুণ বললেন, “আমাদের মনে হচ্ছে, কেউ আমাদের অনুসরণ করছে। মন্দিরে আমরা যে সূত্রগুলো পেয়েছি, সেগুলো হয়তো ওদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।”
রাতের বেলা পরিস্থিতি আরও গুরুতর হয়ে উঠল। রাতের খাবার খেয়ে অরুণ আর নীলাঞ্জন যখন মন্দিরের প্রতীকগুলো নিয়ে আলোচনা করছিলেন, তখন হঠাৎ করে তাদের কটেজের ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। চারিদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার। অরুণ দ্রুত টর্চ বের করে। বাইরে একটা মৃদু আওয়াজ শোনা গেল। অরুণ সতর্ক হয়ে নীলাঞ্জনের দিকে তাকালেন। দু’জনই বুঝতে পারলেন, এটা নিছকই লোডশেডিং নয়।
অরুণ নিঃশব্দে জানালার দিকে এগিয়ে গেলেন। ঘন কুয়াশার আবরণের মধ্যে কিছু আবছা ছায়ামূর্তি দেখা যাচ্ছে। তারা কটেজের দিকে এগিয়ে আসছে। তাদের হাতে কিছু ভারী অস্ত্র থাকার আভাস পাওয়া গেল। অরুণ দ্রুত নীলাঞ্জনকে ইশারা করে আত্মগোপন করতে বললেন। তার দীর্ঘদিনের ট্রেনিং তাকে শিখিয়েছিল, বিপদের সময় ঠান্ডা মাথায় কাজ করতে হয়। তিনি তার পুরোনো সার্ভিস রিভলভারটি হাতে নিলেন। দরজায় ধাক্কা দেওয়ার শব্দ হলো। বাইরে থেকে কেউ কথা বলার চেষ্টা করছে। তাদের গলার স্বর শুনে মনে হলো তারা স্থানীয় নয়। অরুণ বুঝতে পারলেন, তাদের অনুসন্ধান তাদের বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে। এই ছায়ামূর্তিগুলোই হয়তো “কুয়াশার প্রেতাত্মা” নামে পরিচিত। তাদের উদ্দেশ্য পরিষ্কার – অরুণ এবং নীলাঞ্জনকে থামানো। তাদের হাতে বেশি সময় নেই। দ্রুত কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তাদের মনে প্রশ্ন জাগল, এই লোকগুলো কারা? আর কিসের জন্য তারা এত মরিয়া?
অধ্যায় ৫: অপ্রত্যাশিত মোড়
অরুণ এবং নীলাঞ্জন কটেজের ভেতরে আত্মগোপন করে রইলেন। বাইরে থেকে আসা শব্দগুলো ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। অরুণ বুঝতে পারছিলেন, এই আক্রমণ সাময়িক। ওরা আবার আসবে। পরদিন সকালে ইলেকট্রিসিটি ফিরে আসার পর, তারা কটেজের নিরাপত্তা জোরদার করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু আসল বিপদটা তখনও আসেনি। নীলাঞ্জন যখন তার ল্যাপটপে মন্দিরের ছবিগুলো দেখতে গেলেন, তখন তিনি আঁতকে উঠলেন। তার ক্যামেরার মেমোরি কার্ড থেকে কুয়াশার প্রেতাত্মার ছবিগুলো উধাও! এমনকি মন্দিরের প্রতীক আর পুঁথিগুলোর ছবিও নেই। মেমোরি কার্ডটা একদম ফাঁকা। নীলাঞ্জন হতভম্ব হয়ে অরুণের দিকে তাকালেন। “অরুণদা, ছবিগুলো নেই! সব ডিলিট হয়ে গেছে!” তার কণ্ঠে হতাশা স্পষ্ট।
অরুণ দ্রুত নীলাঞ্জনের ক্যামেরা এবং ল্যাপটপ পরীক্ষা করলেন। কোনো হ্যাকিংয়ের চিহ্ন নেই। দেখে মনে হচ্ছে, কেউ যেন শারীরিক ভাবে মেমোরি কার্ড থেকে ছবিগুলো ডিলিট করেছে। কিন্তু কখন? রাতে তো তারা কটেজের ভেতরেই ছিলেন। অরুণ তার মনে মনে ঘটনার পরম্পরা সাজালেন। রাতে ইলেকট্রিসিটি চলে যাওয়া, বাইরে থেকে আসা শব্দ, আর এখন ছবি উধাও হয়ে যাওয়া – সবকিছুর মধ্যে একটা যোগসূত্র আছে। এরপরই নীলাঞ্জন আবিষ্কার করলেন তার কটেজের পেছনের দিকের জানালাটা আলগা করা। সম্ভবত রাতের অন্ধকারে কেউ সেই পথ দিয়েই প্রবেশ করেছিল। অরুণ বুঝতে পারলেন, ওরা শুধুমাত্র তাদের ভয় দেখানোর জন্য আসেনি, তাদের উদ্দেশ্য ছিল সুনির্দিষ্ট। সেই কুয়াশার প্রেতাত্মার ছবিগুলো এবং মন্দিরের সূত্রগুলোই ওদের লক্ষ্য ছিল।
এই অপ্রত্যাশিত মোড় অরুণকে আরও বেশি সতর্ক করে তুলল। তিনি বুঝতে পারছিলেন, এই চক্রটি অত্যন্ত ধূর্ত এবং সুসংগঠিত। তারা শুধুমাত্র “কুয়াশার প্রেতাত্মা” গুজব ছড়িয়ে মানুষকে ভয় দেখায় না, তারা আধুনিক প্রযুক্তি এবং পদ্ধতিও ব্যবহার করে। এই ঘটনার পর নীলাঞ্জন বেশ বিচলিত হয়ে পড়লেন। কিন্তু অরুণ তাকে সান্ত্বনা দিলেন।
তিনি বললেন, “ভয় পেও না নীলাঞ্জন। এই ঘটনা প্রমাণ করে যে আমরা সঠিক পথেই আছি। ওরা যা কিছু লুকানোর চেষ্টা করছে, তার পেছনেই লুকিয়ে আছে আসল সত্য।”
অরুণের দৃঢ়তা নীলাঞ্জনকে কিছুটা সাহস যোগাল। তারা বুঝতে পারলেন, এই ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন নয়, বরং একটি বড় ষড়যন্ত্রের অংশ। তাদের হাতে এখন কোনো ছবি বা সূত্র নেই, কিন্তু অরুণের মস্তিষ্কে ঘটনার প্রতিটি অংশ ধীরে ধীরে জোড়া লাগছিল। তাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে, সেটাই ছিল এখন আসল প্রশ্ন।
অধ্যায় ৬: ষড়যন্ত্রের জাল
ছবিগুলো গায়েব হয়ে যাওয়ার পর অরুণ একটি ঠান্ডা মস্তিষ্কের বিশ্লেষণ শুরু করলেন। তার দীর্ঘদিনের গোয়েন্দা অভিজ্ঞতা তাকে শিখিয়েছিল, যেকোনো অপরাধের পেছনে থাকে একটি উদ্দেশ্য। “কুয়াশার প্রেতাত্মা”র গুজব, রহস্যময় অন্তর্ধান, মন্দিরের প্রাচীন পুঁথি, এবং এখন ছবিগুলো উধাও হয়ে যাওয়া – সবকিছুর মধ্যে একটি সুতো লুকিয়ে আছে। তিনি নীলাঞ্জনকে নিয়ে বসলেন এবং ঘটনাগুলোর প্রতিটি অংশ নিয়ে আলোচনা করলেন।
অরুণ বললেন, “প্রথমত, ‘কুয়াশার প্রেতাত্মা’ কোনো সত্যিকারের প্রেতাত্মা নয়। এটা স্রেফ একটা গুজব। কিন্তু কেন এই গুজব ছড়ানো হয়েছে? এর পেছনে নিশ্চয়ই কোনো উদ্দেশ্য আছে।”
নীলাঞ্জন জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে?”
অরুণ ব্যাখ্যা করলেন, “সাধারণত, এ ধরনের গুজব জনমানবশূন্য এলাকা তৈরি করতে সাহায্য করে, যাতে কোনো অবৈধ কার্যকলাপ নির্বিঘ্নে চালানো যায়।” এরপর তিনি পুরোনো পুঁথিগুলোর কথা তুললেন, যেখানে “লুকানো ধন” এবং “শিকারী” শব্দগুলো বারবার উল্লেখ ছিল। “আমার মনে হচ্ছে, এই অঞ্চলে প্রাচীন কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রয়েছে। সেই নিদর্শনগুলোই এই চক্রের মূল লক্ষ্য। আর ‘কুয়াশার প্রেতাত্মা’ হলো সেই নিদর্শনগুলো পাচারের জন্য তৈরি করা একটি আড়াল।”
তাদের মনে পড়ল পুরোনো মন্দিরের কথা, যেখানে তারা প্রতীক এবং পুঁথি পেয়েছিলেন। অরুণ নিশ্চিত ছিলেন, সেই মন্দিরটি ছিল চক্রের কার্যকলাপের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। যারা রাতে তাদের কটেজে অনুপ্রবেশ করেছিল, তারা নিশ্চয়ই এই চক্রের সদস্য। তারা বুঝতে পেরেছিল যে অরুণ এবং নীলাঞ্জন তাদের আসল উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে পেরেছেন, তাই তারা প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা করেছিল।
অরুণ তার পুরোনো গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের মাধ্যমে কিছু তথ্য সংগ্রহ করতে শুরু করলেন। তিনি কিছু গোপন ফোন কল করলেন এবং পুরোনো সহকর্মীদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করলেন। ধীরে ধীরে তার সামনে ষড়যন্ত্রের জাল স্পষ্ট হতে শুরু করল। দার্জিলিং এবং সংলগ্ন অঞ্চলে একটি বড় চোরাচালান চক্র সক্রিয়, যারা প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাচার করে বিদেশে মোটা টাকা রোজগার করে। এই চক্রের মূল হোতা একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি, যার সমাজে যথেষ্ট সম্মান আছে। “কুয়াশার প্রেতাত্মা” ছিল তাদের একটি কৌশল, যা মানুষকে ভয় দেখিয়ে মন্দির এবং সংলগ্ন এলাকা থেকে দূরে রাখত, যাতে তারা নির্বিঘ্নে তাদের কাজ চালিয়ে যেতে পারে। রহস্যময় অন্তর্ধানগুলো ছিল সেই সব মানুষ, যারা হয়তো দুর্ঘটনাবশত এই চক্রের কার্যকলাপের সাক্ষী হয়েছিল। অরুণ বুঝতে পারলেন, তারা এখন এই বিপজ্জনক চক্রের সরাসরি নিশানায় আছেন। তাদের হাতে সময় খুব কম। মূল হোতাকে খুঁজে বের করে এই চক্রকে থামাতে হবে।
অধ্যায় ৭: মুখোশের আড়ালে
অরুণ এবং নীলাঞ্জন এবার সরাসরি চোরাচালান চক্রের মূল হোতাকে চিহ্নিত করার পরিকল্পনা করলেন। অরুণের পুরোনো গোয়েন্দা তথ্য এবং নীলাঞ্জনের স্থানীয় জ্ঞান – এই দু’য়ের সাহায্যে তারা একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির দিকে সন্দেহের তির ছুঁড়লেন। ইনি হলেন স্থানীয় শিল্পপতি এবং সমাজসেবী, মি. বিক্রম রায়। সমাজে তার একটি পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি ছিল, কিন্তু অরুণের সন্দেহ ছিল যে এই মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক অন্ধকার জগত।
অরুণ তার পুরোনো পরিচিত এক সংবাদকর্মীর মাধ্যমে বিক্রম রায়ের ব্যবসা এবং ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কিছু তথ্য জোগাড় করলেন। তিনি জানতে পারলেন, বিক্রম রায়ের বেশ কয়েকটি চা বাগান এবং রিসর্ট রয়েছে, যার মধ্যে একটি পুরোনো চা বাগান ছিল সেই মন্দিরের কাছাকাছি, যেখানে তারা পুঁথিগুলো পেয়েছিলেন। সন্দেহ আরও ঘনীভূত হলো। অরুণের মনে হলো, বিক্রম রায় হয়তো তার ব্যবসা আর সমাজসেবার আড়ালে এই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাচারের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। “কুয়াশার প্রেতাত্মা”র গুজবও হয়তো তার নিজেরই তৈরি করা।
তাদের কাছে সরাসরি প্রমাণ ছিল না, কিন্তু অরুণের অভিজ্ঞতা তাকে বলছিল, বিক্রম রায়ই সেই ব্যক্তি। তারা একটি সাহসী পরিকল্পনা করলেন। অরুণের এক পুরোনো সহকর্মী, যিনি এখনো পুলিশে কর্মরত ছিলেন, তাকে গোপনে সাহায্য করার জন্য রাজি করানো হলো। পরিকল্পনা অনুযায়ী, অরুণ এবং নীলাঞ্জন বিক্রম রায়ের একটি রিসর্টে একটি গোপন অভিযান চালাবেন। তারা জানতেন এটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে, কিন্তু তাদের হাতে আর কোনো উপায় ছিল না।
এক গভীর রাতে, অরুণ এবং নীলাঞ্জন বিক্রম রায়ের সেই পুরোনো চা বাগানের ভেতরের রিসর্টের দিকে রওনা দিলেন। রিসর্টটি বাইরে থেকে দেখতে সাধারণ লাগলেও, অরুণ জানতেন যে এর ভেতরেই লুকিয়ে আছে আসল রহস্য। তাদের কাছে কোনো সরাসরি প্রমাণ ছিল না, কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য ছিল একটাই – বিক্রম রায়ের আসল মুখোশ উন্মোচন করা এবং তার অপরাধের প্রমাণ সংগ্রহ করা। তারা রিসর্টের পেছনে একটি গোপন প্রবেশ পথ খুঁজে বের করলেন, যা সম্ভবত কর্মচারীদের জন্য ব্যবহার করা হতো। সাবধানে তারা ভেতরে প্রবেশ করলেন। এই মুহূর্তটা ছিল থ্রিলারের চরম মুহূর্ত। তারা জানতেন না ভেতরে কী অপেক্ষা করছে, কিন্তু সত্য উদঘাটনের জন্য তারা বদ্ধপরিকর ছিলেন। তাদের মনে এক অদ্ভুত উত্তেজনা কাজ করছিল। তারা এবার ষড়যন্ত্রের মূল হোতার মুখোমুখি হতে চলেছেন।
অধ্যায় ৮: সত্যের উন্মোচন ও পরিণতি
রিসর্টের ভেতরে প্রবেশ করে অরুণ এবং নীলাঞ্জন সাবধানে এগোতে লাগলেন। চারিদিকে নিস্তব্ধতা, যা এক অজানা আশঙ্কায় ভরা। তারা একটি বড় গুদাম ঘরে পৌঁছালেন, যা বাইরে থেকে দেখে সাধারণ স্টোররুম মনে হলেও, ভেতরে এক ভিন্ন চিত্র। গুদাম ঘরের এক কোণে একটি গোপন দরজা। অরুণ তার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সেই দরজা খুললেন। ভেতরে ঢুকে তারা যা দেখলেন, তাতে তাদের চোখ কপালে উঠল।
একটি বিশাল কক্ষ। কক্ষের মাঝখানে সারি সারি প্রাচীন মূর্তি, ভাস্কর্য, এবং বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। কিছু নিদর্শন বাঁশের ঝুড়িতে প্যাকেজিং করা, দেখে মনে হচ্ছে বিদেশে পাচারের জন্য প্রস্তুত। এটাই ছিল বিক্রম রায়ের চোরাচালানের আস্তানা। তারা বুঝতে পারলেন, “কুয়াশার প্রেতাত্মা” এবং রহস্যময় অন্তর্ধানের পেছনের আসল কারণ। এই নিদর্শনগুলোই ছিল সেই “লুকানো ধন”, যার কথা প্রাচীন পুঁথিতে উল্লেখ ছিল।
হঠাৎ কক্ষের এক কোণ থেকে একটি ভারী পায়ের শব্দ শোনা গেল। বিক্রম রায় তার কয়েকজন দেহরক্ষী নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করলেন। তার মুখে এক শয়তানি হাসি। “আমি জানতাম তোমরা আসবে,” বিক্রমের কণ্ঠে ব্যঙ্গ। “তোমাদের মতো নাক গলানো মানুষেরা কখনোই বেশি দিন টিকে থাকে না।” অরুণ ঠান্ডা মাথায় পরিস্থিতি সামলালেন। তার রিভলভার প্রস্তুত ছিল। নীলাঞ্জন দ্রুত তার ফোনের ক্যামেরা বের করে প্রমাণ সংগ্রহ করতে শুরু করলেন।
শুরু হলো এক হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। বিক্রম রায়ের দেহরক্ষীরা অরুণ এবং নীলাঞ্জনকে আক্রমণ করল। অরুণ তার পুরোনো ট্রেনিংয়ের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে তাদের মোকাবিলা করতে লাগলেন। নীলাঞ্জনও তার পাশে দাঁড়িয়ে সাহস জোগালেন। লড়াইয়ের এক পর্যায়ে অরুণের পাঠানো পুলিশ ফোর্স ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছাল। তার পুরোনো সহকর্মী, ইন্সপেক্টর রঞ্জন, ফোর্স নিয়ে গুদাম ঘরে প্রবেশ করলেন। পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে গেল।
বিক্রম রায় এবং তার দেহরক্ষীরা কোণঠাসা হয়ে পড়ল। পালানোর কোনো পথ ছিল না। পুলিশ তাদের হাতেনাতে ধরে ফেলল। অরুণ নিশ্চিত করলেন, সমস্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন উদ্ধার করা হয়েছে এবং ঘটনার সব প্রমাণ সংগ্রহ করা হয়েছে। বিক্রম রায়ের মুখোশ উন্মোচিত হলো। তার সমাজসেবার আড়ালে লুকিয়ে ছিল এক জঘন্য অপরাধের জাল। “কুয়াশার প্রেতাত্মা”র রহস্য উন্মোচিত হলো। এটি ছিল নিছকই একটি গুজব, যা চোরাচালান চক্র তাদের অবৈধ কার্যকলাপের জন্য ব্যবহার করত।
পরদিন সকালে, দার্জিলিংয়ের আকাশে কুয়াশা কাটতে শুরু করেছে। সূর্য উঁকি দিচ্ছে। অরুণ এবং নীলাঞ্জন, যারা এই কাহিনীর অংশ ছিলেন, তারা আজ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন। অঞ্চলের মানুষ স্বস্তি ফিরে পেল, কিন্তু “কুয়াশার প্রেতাত্মা”র এই কাহিনীর স্মৃতি তাদের মনে দীর্ঘস্থায়ী ছাপ ফেলে গেল। অরুণ তার অবসর জীবনে ফিরে গেলেন, কিন্তু তার মনে এই থ্রিলারের স্মৃতি চিরকাল অমলিন থাকবে। নীলাঞ্জন তার ফটোগ্রাফির মাধ্যমে এই সত্যকে ক্যামেরাবন্দী করলেন, যা ভবিষ্যতে মানুষকে সতর্ক করবে। সত্যের উন্মোচন সবসময়ই কঠিন, কিন্তু তার জয় অনিবার্য।
শেষ

ছবি এআই
© পিনাকী রঞ্জন পাল