
পিনাকী রঞ্জন পাল : দ্রুত পরিবর্তনশীল এই সমাজে মেয়েরা আগের তুলনায় বর্তমানে অনেক বেশি স্বাধীন। সামাজিক চিন্তাধারাতেও এসেছে অনেক পরিবর্তন। আজ-অধিকাংশ কাজ তারা নিজে করতেই বেশি ইচ্ছুক। তাদের মধ্যে ক্রমশই বাড়ছে স্বনির্ভর হবার প্রবণতা। কিন্তু এত সবের পরে আজও মেয়েদের নিয়ে কতকগুলো বিষয় আছে যেগুলো এখনও বিতর্কিত। এদের মধ্যে প্রধানতম হল, ছেলে বন্ধু তথা ‘ফ্রেন্ড নিয়ে বিতর্ক’। মেয়েদের কি নিজেদের ‘বয়ফ্রেন্ড’ নির্বাচন করার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া উচিত? মেয়েরা কি এটাই চায় অথবা সাধারণত এই ব্যাপারে সক্রিয়? কেরিয়ার গঠনে বয়ফ্রেন্ড কতটা সহায়ক? মেয়েরা এই ব্যাপারে কি ভাবছে। তাই জানতে উপস্থিত হয়েছিলাম কিছু তরুণীর কাছে।

পৌষালী বোস বিএ প্রথম বর্ষের ছাত্রী। তার মতে, মেয়েরা যদি সাবধান না থাকে তবে তাকে বয়ফ্রেন্ডের নামে বেশ সমস্যায় পড়তে হয়। কলেজে প্রচুর রোমিও মেয়েদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার জন্য পেছনে পেছনে ঘুরতে থাকে। সেই জন্যেই সঠিক বয়ফ্রেন্ডের নির্বাচন অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়ে। নয়তো যখন কেরিয়ার তৈরির সময় থাকে, তখন সে নিজে প্রেম-ভালবাসার মিথ্যে আশ্বাসে সর্বনাশের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যায়। পৌষালীর বিচারে, বয়ফ্রেন্ড থাকাটা কোন অন্যায় নয়। আর যারা এর বিরোধিতা করে থাকে, অথবা সমাজের দোহাই দিয়ে বলে থাকে যে, ছেলেমেয়েদের মধ্যে মেলামেশা কর একদম উচিত নয়। আমার মতে, তারা সমাজকে অনেক পেছনে ঠেলে দিতে চায়।

দীপাঞ্জনা চক্রবর্তী বিএসসি প্রথম বর্ষের ছাত্রী। দীপাঞ্জনা বয়ফ্রেন্ড থাকাকে কিছুটা সমর্থন করার সঙ্গে সঙ্গে কেরিয়ার গঠনেই বেশি মনযোগ দেওয়া উচিত বলে মনে করে। তার মতে, আজকে যুব সমাজ ভীষণভাবে কেরিয়ারমনস্ক হয়ে উঠেছে। তবে পাশ্চাত্য আধুনিকতার অনুকরণকারী ভাইরাসে প্রায় সবাই কম বেশি আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। আর তাই মেয়েরা কেরিয়ার সচেতন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বয়ফ্রেন্ড সম্পর্কেও সচেতন হয়ে উঠেছে। বন্ধুত্বের পরিধি সঙ্কীর্ণ হচ্ছে বয়ফ্রেন্ড এবং গার্লফ্রেন্ডের পরিধি বেড়ে উঠেছে। অনেক আধুনিক মেয়ের কাছেই কেরিয়ার গঠনের সঙ্গে সঙ্গে বয়ফ্রেন্ড থাকাটা একটা ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ফ্যাশন বজায় রাখতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই কেরিয়ার যে খুব একটা মজবুত হয় না তা বলাবাহুল্য। কারণ দু’নৌকোয় পা দিয়ে চলা যায় না। আজকের প্রতিযোগিতার যুগে সুতোতে সামান্য ঢিলে দিলেই কেরিয়ার নামক ঘুড়িটি তো ভোকাট্টা হবেই, লাটাইটিও হাত থেকে ছুটে যেতে পারে। তাই কেরিয়ার অথবা বয়ফ্রেন্ড যে কোন একটির দিকে মনোনিবেশ করাই বাঞ্ছনীয়। তবে এও ঠিক, যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে। চুল বাঁধে বটে। তবে চুল বাঁধতেই যদি সব সময় চলে যায় তবে কিন্তু অভুক্তই থাকতে হবে। তাই কেরিয়ার গঠন করতে হলে ওদিকেই বেশি মন দেওয়া উচিত। বন্ধুত্ব একটা নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যে থাকলে অবশ্যই আপত্তির কিছু থাকে না।
কলা বিভাগের সদ্য স্নাতক মৌমিতা পালের বয়ফ্রেন্ড সম্পর্কে চিন্তাধারা হল, এ দেশে বয়ফ্রেন্ড সম্পর্কে অধিকাংশ লোক পুরনো ধারণায় এখনও বিশ্বাসী, তাই এই সম্পর্কটিকে সহজে গ্রহণ করতে তারা অক্ষম। মৌমিতা বলে, আমার মতে মেয়েদের ক্ষেত্রে ছেলেরা যতটা সাহাযাকারী, ততটা মেয়েরা নয়। স্বভাবতই প্রাকৃতিক কারণে ছেলেমেয়েদের মধ্যে সহজ আকর্ষণ থাকে, আর এই আকর্ষণকেও বন্ধুত্বে পরিবর্তিত করা যেতে পারে। হয়ত অনেকে আমার বক্তব্যের সঙ্গে একমত হবেন না, কিন্তু আমার নিজস্ব ধারণা হল, একজন মেয়ের এক বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে, বেড়াতে বা একত্রে পড়াশোনা করতে যত আনন্দ আসে তত আনন্দ কোন বান্ধবীর সঙ্গে আসে না।
একই স্বর শুনতে পাওয়া গেল আর এক স্নাতক যুবতী লোপামুদ্রা ব্যানার্জির কন্ঠে। লোপামুদ্রা বলে, আমার বিচারে বন্ধু তাকেই বলা যায়, যার সঙ্গে মনের কথা বলা যায়, বিচার পরামর্শ করা যায় কোন রকম সঙ্কোচ বা লজ্জা ছাড়া। কোন গভীর কিংবা ব্যক্তিগত সমস্যার মিলেমিশে সমাধানকারী ঙ্গীকেই বলা। যায় আসল বন্ধু। এ সব ব্যাপারে একটি মেয়ের ক্ষেত্রে একটি ছেলে বন্ধু বয়ফ্রেন্ড গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মেয়েদের প্রকৃতি হল যে, তাদের পেটে কোন কথা গোপন থাকে না, কোন বান্ধবীকে কোন গোপন কথা বলামাত্র তা সার্বজনীন হয়ে যায়। কিন্তু বয়ফ্রেন্ডের ক্ষেত্রে এটা হয় না।
মালবিকা মুখার্জি বিএ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। আধুনিকমনস্ক মালবিকার মতে, আজকালকার মেয়েরা ছেলেদের থেকে নিজেদের কোন অংশে কম বলে মনে করে না। তারা আজ শুধু Mrs. something হয়ে থাকতে চায় না। চায় নিজের একটা স্বতন্ত্র অস্তিত্ব গড়ে তুলতে। তাই আজ তারা কেরিয়ার সচেতন। আজকের মেয়েরা শুধু যে কেরিয়ার নিয়েই ভাবছে তা কিন্তু নয়। তারা আজ ‘কেরিয়ার’ এবং ‘বয়ফ্রেন্ড’ দুটোকেই সমান গুরুত্ব দিচ্ছে। অনেকের মতে ছেলে বন্ধু থাকলে পড়াশোনার ক্ষতি হয়, কেরিয়ার বাধাপ্রাপ্ত হয়। তবে আমার মতে, বয়ফ্রেন্ড কেরিয়ার তৈরি সহায়ক। সে যদি সহপাঠী এবং ভাল ছাত্র হয় তা হলে সবচেয়ে ভাল হয়। বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করলে নানা ব্যাপারে অনেক কিছু জানা যায়। শুধু যে পড়াশোনার ব্যাপারে তার সাহায্য পাওয়া যায় তাই নয়, পড়াশোনার বাইরে যে জগত আছে তার সম্পর্কেও অনেক জানা যায়। এগুলোও কেরিয়ার তৈরিতে সাহায্য করে থাকে। মালবিকা বলে, একজন বান্ধবীর কাছ থেকে কোন ব্যাপারে যতটা সাহায্য পাওয়া যায়, বয়ফ্রেন্ডের কাছ থেকে সেই ব্যাপারে আরও অনেক বেশি সাহায্য পাওয়া যায়।
দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রী স্বপ্না মিত্র। বয়ফ্রেন্ড সম্পর্কে বলে, বয়ফ্রেন্ডের অর্থ আমাদের দেশে সাধারণত ‘প্রেমিক’ রূপে চিহ্নিত হয়ে থাকে। একজন ভাল বন্ধু প্রেমিকও হতে পারে, কিন্তু সর্বদা একজন বন্ধু প্রেমিক নাও হতে পারে। বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে প্রতিদিন ৫-৬ ঘণ্টা আড্ডা মারলে আপনার পড়াশোনার ক্ষতি তো হবেই হয় কেরিয়ার বানাও, নয়ত বয়ফ্রেন্ড নিয়ে আনন্দ স্ফূর্তি কর। তাই একটা নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে মেলামেশা করা উচিত বলে আমি মনে করি।
বন্ধু শব্দের সঙ্গে প্রেম আর বিশ্বাস দুই ই জুড়ে আছে। তা গার্লফ্রেন্ড হোক অথবা বয়ফ্রেন্ড। কিন্তু এই শব্দের আড়ালে দু’জনেই দু’জনের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে থাকে বয়ফ্রেন্ড সম্পর্কে এই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বিএসসি তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী অনন্যা মিত্র। অনন্যা আরও বলে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই ধরনের বন্ধুত্ব ‘টাইম পাস’ বা ‘এন্টারটেইনমেন্টের’ জন্য হয়ে থাকে। এই বন্ধুত্ব শুধুমাত্র কাজ করিয়ে নেবার জন্য হয়ে থাকে। যতক্ষণ মতলব আছে, ততক্ষণ বিশ্বাস জাগিয়ে রাখা হয়। তারপর ভেঙে গেলেও কোন ব্যাপার নয়। এটা বন্ধুত্ব নয়, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শুধুই ধোঁকা। বিশ্বাস নিয়ে খেলা করাটাকে ফ্যাশনরূপে গ্রহণ করেছে অনেকে। এই কারণেই ছেলেমেয়েদের বন্ধুত্বের ওপর জিজ্ঞাসা চিহ্ন এসে যায়।
দেখা যাচ্ছে যে, আজকের যুবতীদের মধ্যে পুরুষ বন্ধু নিয়ে চিন্তাধারার পরিবর্তন এসেছে। তবে চিন্তাধারার বিভিন্নতা রয়েছে। কারও কাছে এটা শুধুমাত্র ‘টাইম পাস’, কারও কাছে। সবচেয়ে সাহায্যকারী সঙ্গী অথবা বিশ্বাসযোগ্য বন্ধু। অধিকাংশ যুবতীই মনে করে যে, বয়ফ্রেন্ডরা কেরিয়ার গঠনে সাহায্য করে থাকে। তবে সেটা একটা সীমা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত। ছেলেদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা ক্ষতিকর নয়, তবে সেটা সম্পূর্ণ নির্ভর করবে একটি মেয়ে তার জন্য কি ধরনের ছেলেবন্ধু নির্বাচন করে সেটার ওপর।
অধিকাংশ যুবতী এটা সমর্থন করলেও অভিভাবকদের অধিকাংশের মতামতই এর বিপক্ষে দেখা যায়। মৌমিতার কথায়, এ দেশের মানুষ এখনও বয়ফ্রেন্ড সম্পর্কে পুরনো ধারণায় বিশ্বাসী। অভিভাবকরা এই সম্পর্ককে ভয় পান, কারণ, না জানি কখন তাঁদের মেয়েরা নির্জনে বারবার ছেলে বন্ধুর সঙ্গে মিলতে মিলতে যৌবনের জোয়ারে ভেসে যায়, এ পরিস্থিতিতে মেয়েটি কিংবা তার পরিবারকে বেশ অস্বস্তিতে পড়তে হয়। সমাজে বদনাম হয়ে যাবার ভয় থাকে।
তবে কোন জিনিসের শুধুমাত্র খারাপ দিকই থাকে না, ভাল একটা দিকও থাকে। আর তার সবটাই নির্ভর করে, সেটাকে কিভাবে উপযোগ করা হয় তার ওপর। তাই ‘বয়ফ্রেন্ডে’র সঠিক নির্বাচন আর তার সঙ্গে গঠনমূলক কাজ করার চিন্তা কেরিয়ার তৈরিতে মহত্বপূর্ণ হয়ে থাকে, যদি এটা ভেবেচিন্তে করা যায়। আর তা নিয়ে কোন বিতর্ক থাকার কথা নয়।