Cricket : চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে বিরাট-সামির মহাপ্রত্যাবর্তন : ট্রফির থেকেও বড় প্রাপ্তি?

পিনাকী রঞ্জন পাল : অপেক্ষা ছিল প্রতিশোধের, উত্তরের। ২০২৩ বিশ্বকাপের ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে হার—সেই ক্ষত এখনও দগদগে। কিন্তু ভারত জানিয়ে দিল, তারা থেমে থাকার দল নয়। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালে পৌঁছে বিরাট-বাহিনী বুঝিয়ে দিল, এবার ইতিহাস লেখা হবে নতুন কালি দিয়ে।

গতকালের ম্যাচটা নিছক একটা জয় ছিল না। এদিন ২৬৪ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে ভারত দেখিয়ে দিল, তারা কেন এই টুর্নামেন্টের সেরা দল। রোহিত শর্মা বারবার সুযোগ পেয়েও ইনিংস লম্বা করতে পারলেন না, শুভমান গিলের ব্যাট এখনও নীরব। কিন্তু বিরাট? তিনি জানিয়ে দিলেন, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পাওয়া ফর্মটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না, তিনি ফিরে এসেছেন।

বিরাটের ৮৪ রানের দুরন্ত ইনিংস আর শ্রেয়স আইয়ারের সাহসী পার্টনারশিপই মূলত নির্ধারণ করে দিল ম্যাচের ভাগ্য। পরে অক্ষর প্যাটেল, কে এল রাহুল আর হার্দিক পান্ডিয়াও তাঁদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করলেন। তবে একদম নিখুঁত দিন ছিল না এটি—ভারত যেমন ফিল্ডিংয়ে কিছু সুযোগ হাতছাড়া করেছে, তেমনি অস্ট্রেলিয়াও তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ক্যাচ ফেলে ম্যাচ থেকে ছিটকে যায়।

অন্যদিকে, আজ ভাগ্য কারও পক্ষে ছিল না, সবটাই ছিল দক্ষতার ফল। স্মিথ স্ট্যাম্পে আঘাত লাগার পরেও নট আউট থেকে গেলেন, হেড অল্প রানে ফিরতে পারতেন কিন্তু সামির হাত ফসকে গেল ক্যাচ। এসব যেন ম্যাচের রোমাঞ্চ আরও বাড়িয়ে তুলল।

কিন্তু এই টুর্নামেন্টের সবচেয়ে বড় গল্প কি শুধুই ফাইনালে ওঠা? নাকি ভারতের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি বিরাট কোহলি আর মহম্মদ সামির ফিরে আসা?

স্রোতের বিপরীতে চলতে গেলে অসীম সাহস লাগে। বিরাট কোহলি আর মহম্মদ সামি সেটাই করে দেখালেন। সময়ের চাকার মতোই ক্রিকেটও ঘুরে ফিরে আসে, কিন্তু সবাই ফিরে আসতে পারে না। অনেকে হারিয়ে যায়, অনেকের গল্প অসমাপ্ত থেকে যায়। কিন্তু বিরাট-সামি? তাঁদের গল্প ফিনিক্স পাখির মতো, যারা ছাই থেকে উঠে এসে প্রমাণ করল—তাদের শেষ বলে কিছু নেই।

প্রথমেই বলি বিরাটের কথা। “তিনি শেষ!”—বছর খানেক আগে এই কথাটা বলা শুরু হয়েছিল। রান আসছিল না, ব্যাট কথা বলছিল না। যাঁর ব্যাটিং ছিল কবিতার মতো সুরেলা, তা হয়ে গিয়েছিল নিছকই অনুশীলনের একঘেয়ে ধ্রুপদি রাগ। কিন্তু বিরাট কোহলির আরেকটা গুণ আছে—তিনি নিজেকে হারাতে জানেন না।

ক্রিকেটের মঞ্চে অনেকবারই তিনি ফিরে এসেছেন। ২০১৪-১৫-এর খারাপ সময় কাটিয়ে, ২০২২-এর হতাশা ভুলিয়ে, বারবার যেন শূন্য থেকে শুরু করে চূড়ায় পৌঁছেছেন। পাকিস্তানের বিপক্ষে সেঞ্চুরির পরও প্রশ্ন ছিল—এটা কি শুধুই এক ম্যাচের জ্বালা? কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৮৪ রানের ইনিংস দিয়ে বিরাট নিজেই উত্তর দিয়ে দিলেন—তিনি ফিরেছেন, এবং এবার আরও ভয়ংকর হয়ে।

গতকাল শুধু রান নয়, তার ব্যাটিংয়ে ছিল সেই আগুন, যে আগুনটা ভারতের প্রতিটি জয়ের ইন্ধন। শেষ পর্যন্ত অপরাজিত থেকে ম্যাচ শেষ করতে পারেননি, কিন্তু গোটা দেশ জানে—রবিবার সেই কাজটা তিনি করেই ছাড়বেন।

এবার বলি সামির ফিরে আসার কথা। একটা সময় মনে হয়েছিল, সামির ক্রিকেট জীবন শেষের দিকে। চোট, দল থেকে বাদ পড়া, বয়স, সন্দেহের চোখ—সবকিছু মিলিয়ে চাপের পাহাড় ছিল তাঁর সামনে। কিন্তু কিছু ক্রিকেটারের মধ্যে বিশেষ কিছু থাকে, যা তাঁদের আলাদা করে তোলে। সামির মধ্যে ছিল সেই লড়াই করার ক্ষমতা। তিনি চুপচাপ নিজের কাজটা করে গেছেন, ভারতীয় ক্রিকেটের সেরা ফাইটারদের একজনের মতো। রঞ্জি ট্রফি, দলীপ ট্রফি, ইংল্যান্ড সিরিজ পেরিয়ে তিনি যখন দুবাইতে পা রাখলেন, তখনও কেউ ভাবেনি, তিনি এমনভাবে ফিরবেন।

আর দুবাইয়ের মঞ্চে যেন পুরনো সামিকে ফিরে পেল ভারত। বল হাতে জাদু দেখালেন, প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের বিভ্রান্ত করলেন, উইকেট তুলে নিয়ে ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিলেন। স্টিভ স্মিথের উইকেট নেওয়ার সেই রহস্যময় ফুলটসটা? সেটাই হয়তো অভিজ্ঞতার জবাব, যেটা পরিসংখ্যানের খাতায় ধরা যায় না।

ফাইনালে ওঠার আনন্দ তো আছেই, কিন্তু রবিবারের অপেক্ষা যেন আরও আকুল করে তুলেছে ভারতবাসীকে। রবিবার ভারতের সামনে সুযোগ নিজেকে ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখানোর। এই ভারত এখন আত্মবিশ্বাসী, ভয়ডরহীন। বিরাটের চোখের আগুন, সামির ধারালো স্পেল, দলের বাকি খেলোয়াড়দের অবদান—সব মিলিয়ে ভারতীয় ক্রিকেটের এক মহাকাব্য রচনা হতে চলেছে।

ট্রফি কি এবার আসবে সাগর পেরিয়ে? সময়ই দেবে তার উত্তর। রবিবার সেই গল্পের শেষ অধ্যায় লেখা হবে, আর তার সঙ্গে হয়তো ক্রিকেট ইতিহাসেরও নতুন এক অধ্যায়!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *