১৩৭ বছরের প্রাচীন জলপাইগুড়ি পুরসভার পরবর্তী চেয়ারম্যান কে হবেন? এটাই এখন লাখ টাকার প্রশ্ন। আর সেই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে সম্ভবত আগামীকাল সোমবার। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল কংগ্রেসের সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করবেন ১৮৮৫ সালে স্থাপিত রাজ্যের অন্যতম প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী জলপাইগুড়ি পুরসভার পরবর্তী চেয়ারম্যান কে হবেন। এ নিয়েই লিখেছেন পিনাকী রঞ্জন পাল।

বিশেষ প্রতিবেদন : গত ২৭শে ফেব্রুয়ারি রাজ্যের ১০৮টি পুরসভার সাথে জলপাইগুড়ি জেলার তিনটি পুরসভায় ভোট গ্রহণ হয়। এরপর ২রা মার্চ ভোট গণনা শেষে জলপাইগুড়ি জেলার জলপাইগুড়ি, ময়নাগুড়ি ও মালবাজার পুরসভার দখল নেয় রাজ্যের শাসক দল। শাসক দলের জয়ের দাপটে বিরোধীদের আতস কাঁচ নিয়ে খুঁজতে হচ্ছে। জলপাইগুড়ি জেলার জলপাইগুড়ি পুরসভার মোট ২৫টি আসনের মধ্যে ২২টি আসনে তৃণমূল কংগ্রেস, বাকি তিনটি আসনের মধ্যে ২টিতে কংগ্রেস এবং ১টি আসনে জয়ী হয় বামফ্রন্ট। নবগঠিত ময়নাগুড়ি পুরসভার মোট ১৭টি আসনের মধ্যে ১৬টিতে তৃণমূল কংগ্রেস এবং ১টি আসনে নির্দল জয়ী হয়। মাল পুরসভার ১৫টি আসনের মধ্যে তৃণমূল ১৪টি এবং বিজেপি ১টি আসনে জয়ী হয়।

তবে এই প্ৰতিবেদনে আমাদের মূল আলোচনার বিষয় হল জলপাইগুড়ি পুরসভা। ১৮৮৫ সালে ব্রিটিশ আমলে নির্মিত এই লাল বাড়ির দখল আগামী আগামী পাঁচ বছরের জন্য ফের রাজ্যের শাসক দলের হাতে। নতুন পুর বোর্ডকে উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রচুর কাজ করতে হবে। সেসব নিয়ে আমরা পরে আলোচনা করছি। তার আগে একবার আমরা ফ্লাশ ব্যাকে ফিরে যাই।

এবারের পুরভোট ঘোষণার দিন থেকেই জলপাইগুড়ি পুরসভার ২৫টি আসনের মধ্যে ২৫টিতেই জয়ের লক্ষে ঝাঁপিয়েছিল শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস। তাদের নেতৃত্বরা বারবার বিরোধী শূন্য পুরবোর্ড গঠনের কথা বলছিলেন। নিরপেক্ষ রাজনৈতিক দৃষ্ঠিভঙ্গিতে গণতন্ত্রে বিরোধী শূন্য যে কোন প্রশাসন ভয়ঙ্কর ক্ষতিকারক, সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার তা পরিপন্থী। আর তারই প্রতিফলন জলপাইগুড়িবাসী দেখছে এবারের পুর ভোটের মনোনয়ন পত্র জমা দেওয়ার সময় থেকে শুরু করে ভোট গ্রহণের দিন পর্যন্ত। বরাবরই শান্ত শহর জলপাইগুড়ি। এখানে এতকাল ছিল সৌজন্যের রাজনীতি। কিন্তু সেই ঐতিহ্য কে এবার পুরভোটে বিনষ্ট হতে দেখলো শহরবাসী।

জলপাইগুড়ি পুরসভার ১নং ওয়ার্ডের বিক্ষুব্ধ তৃণমূল নেতা মলয় ব্যানার্জী ওরফে শেখর ব্যানার্জী নির্দল হিসাবে মনোনয়ন পত্র জমা দিতে গেলে বারবার তাকে পুলিশ প্রশাসন দিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে আটকে দেওয়া হল। তিনি স্বাভাবিকভাবে মনোনয়ন পত্র জমা করতে পারলেন না। বিষয়টি নিয়ে মলয় বাবু হাইকোর্ট পর্যন্ত যান। হাইকোর্টে শেষ পর্যন্ত রায় মলয় বাবুর ফেভারে যায়। যদিও ততদিনে তৃণমূল নেতৃত্বরা মলয় বাবুর মানভঞ্জন করে তাকে মামলা তুলে নিতে রাজি করিয়েছিলেন। তাই হাইকোর্টে জিতেও শেষ পর্যন্ত মলয় বাবু মনোনয়ন পত্র জমা করেন নি। ফলে শাসক দল বা প্রশাসন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। কিন্তু এই ঘটনা প্রমান করে দেয় যে শাসক দল কিভাবে বেআইনীভাবে পুলিশ প্রশাসন এমনকটি রাজ্য নির্বাচন কমিশনের প্রতিনিধিদের ব্যবহার করে এই অগণতান্ত্রিক কাজটি সংঘটিত করেছিলেন। এরপর ২৭শে ফেব্রুয়ারি ভোট গ্রহণের দিন যে সন্ত্রাস শহরবাসী চাক্ষুস করলেন তা জলপাইগুড়ির ইতিহাসে নজিরবিহীন। বুথে বুথে ছাপ্পা ভোট, ভুয়ো ভোটার, বুথ দখল, মুখে কাপড় বেঁধে লাঠি বাহিনীর তান্ডবের সাক্ষী থাকল জলপাইগুড়িবাসী। আর এই সব খবর করতে গিয়ে আক্রান্ত হলেন গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ সাংবাদিকরাও। পুলিশের সামনেই চললো এই ভোট লুঠ। যদিও শাসক দলের নেতৃত্বরা এই সমস্ত ঘটনা কে বিরোধীদের চক্রান্ত বলেই নিজেদের দায় ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলে দিতে চেয়েছেন। কিন্তু শাসক দলের মদত ছাড়া এই ধরনের কাজ কি সম্ভব? যদি বিরোধীরাই এই কাজ করেছিল তবে পুলিশ প্রশাসন সেদিন চুপ করে দাঁড়িয়েছিল কেন? যেখানে সসক দলের নেতৃত্বরাই বারবার বলেছেন যে পুর ভোটে বিরোধীদের খুঁজেই পাওয়া যায় নি, সেখানে বিরোধীরা এত বড়ো সন্ত্রাস সংগঠিত করতে পারে এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? এই প্রশ্ন শহরবাসীর। আবার এই পুলিশই কিন্তু ভোটের পরদিন ছাপ্পা ভোটের প্রতিবাদে ডেপুটেশন দিতে যাওয়া বামফ্রন্টের মিছিলে নির্বিচারে লাঠিচার্জ করেছিল। এই সক্রিয়তা যদি পুলিশ রবিবার দেখাতো তবে ভোট গ্রহণ কে কেন্দ্র করে কলঙ্কিত হত না জলপাইগুড়ির ইতিহাস। প্রশাসনিকভাবে যদিও এই ভোটগ্রহণ পর্ব নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়েছে বলে ঘোষণা করা হলেই সেটা যে আদৌ সত্যি নয় তা জলপাইগুড়িবাসী জানেন। তাই এই কলঙ্কজনক ঘটনার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন জলপাইগুড়ির সচেতন নাগরিকরা। তারা কদমতলা মোড়ে একত্রিত হয়ে এই ঘটনার ধিক্কার জানিয়ে প্রতিবাদ সভা করেছিলেন।

যাইহোক এবার আশা যাক নতুন চেয়ারম্যান প্রসঙ্গে। ইতিমধ্যে জলপাইগুড়ি পুরসভার বোর্ড গঠনের বিজ্ঞপ্তি জারি হয়েছে। জলপাইগুড়ি পুরসভার নতুন বোর্ড গঠন হবে আগামী ১৬ই মার্চ। তার আগে সোমবার তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতা থেকে সাংবাদিক সম্মেলন করে রাজ্যের বিভিন্ন পুরসভার সাথে জলপাইগুড়ি পুরসভারও চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানের নাম ঘোষণা করবেন। জানা গেছে, তৃণমূল সুপ্রিমো এই নাম বাছাইয়ের ক্ষেত্রে দলের প্রস্তাবের সঙ্গে সঙ্গে প্রশান্ত কিশোর ও পুলিশের রিপোর্ট কে গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। এদিকে পুরসভার চেয়ারম্যান হতে চেয়ে জলপাইগুড়ির তৃণমূল কাউন্সিলররা রাজ্যের শীর্ষ নেতৃত্বদের কাছে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন এবং অনেকেই কলকাতায় পৌঁছে গেছেন নেতা মন্ত্রীদের দরবারে হাজিরা দিতে। তবে তৃণমূলে শেষ সিদ্ধান্ত নেবেন মূখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সুতরাং কি হবে তার জন্য সোমবার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
কিন্তু জলপাইগুড়ি পুরসভার চেয়ারম্যান পদের জন্য চারজনের নাম উঠে আসছে বিভিন্ন মহলে। এই চারজন হলেন তপন ব্যানার্জী, পাপিয়া পাল, সন্দীপ মাহাতো এবং সৈকত চ্যাটার্জী।

প্রবীণ নেতা তপন ব্যানার্জী জলপাইগুড়ি পুরসভার ১৫ নং ওয়ার্ড থেকে কখনো পরাজিত হন নি। একসময় পুরসভার ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্বও সামলেছিলেন তপন বাবু। এবার চেয়ারম্যান পদের অন্যতম দাবিদার তপন বাবু।

প্রাক্তন পুরপ্রধান পাপিয়া পাল রাজনীতিতে ভদ্র, বিনয়ী হিসাবে পরিচিত। তার জনসংযোগও যথেষ্ট। ৭নং ওয়ার্ড থেকে এবার জয়ী হয়েছেন তিনি। পাপিয়া দেবীও রয়েছেন চেয়ারম্যান পদের দৌড়ে।

রাজনীতিতে স্বল্পভাষী হিসাবে পরিচিত ৫ নং ওয়ার্ড থেকে বিজয়ী সন্দীপ মাহাতোও এবার রয়েছেন চেয়ারম্যান পদের দৌড়ে। পুরসভার তৃণমূল কাউন্সিলরদের মধ্যে তারই অভিজ্ঞতা সবচেয়ে বেশি।

পুরসভার চেয়ারম্যান হতে আগ্রহী সৈকত চাটার্জিও। তার নামও ভাসছে চেয়ারম্যান পদের জন্য। তাছাড়া এবার সৈকত বাবু নিজে বিরাট ব্যবধানে জেতার পাশাপাশি পুরসভার একাধিক ওয়ার্ড থেকে তিনি তার অনুগামীদের জিতিয়ে এনেছেন।
কিন্তু নারী দিবসে তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, “চেয়ারম্যান হতে গেলে এলাকায় জনপ্রিয়তা থাকতে হবে। স্বচ্ছতা থাকতে হবে। অভিজ্ঞতা আছে, তবে লবিবাজি করেন না – এমন কাউন্সিলরই এই পদের যোগ্য।” এবার দেখার এই চারজনের মধ্যে কাউকে নাকি চমক হিসাবে নতুন কোন নাম সোমবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেন চেয়ারম্যান পদে এখন তারই জন্য অপেক্ষা করছেন জলপাইগুড়ির তৃণমূল কর্মীদের সাথে জলপাইগুড়িবাসী।
তবে নতুন পুর বোর্ডে যেই হোন না কেন চেয়ারম্যান তার ওপর থাকবে একাধিক প্রত্যাশার চাপ। এবার জলপাইগুড়ি পুরসভা প্রায় বিরোধী শূন্য। টিমটিম করে বিরোধীদের প্রদীপ জ্বলছে তিনটি ওয়ার্ডে। তাই শহরবাসীর আশা এবার শহরে উন্নয়নের জোয়ার আসবে। শাসক বিরোধী ভুলে শহরকে নতুনভাবে সাজিয়ে তুলবে নতুন পুর বোর্ড এমনিই আশা শহরবাসীর। প্রাচীন এই শহরে এখনো রয়েছে জলাবদ্ধতার সমস্যা, প্রয়োজন করলা নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি করে দূষণ রোধ করা। পাশাপাশি পুরসভার ২৫ টি ওয়ার্ডের বেশিরভাগ রাস্তাই বেহাল, তার সংস্কার দরকার। শহরে রয়েছে শুয়োরের অত্যাচার। বহু নিকাশি নালা বন্ধ হয়ে যেতে বসেছে সংস্কারের অভাবে, সেগুলো ঠিক করতে হবে। জলপাইগুড়ি পুরসভাকে করপোরেশনে উন্নীত করা। অমরুত প্রকল্প, সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট দ্রুত চালু। শহরের পার্কিং ব্যবস্থা, যানজট নিরসন, টোটোর অত্যাচারে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে নতুন পুর প্রশাসনকে। সেইসাথে বাড়ি বাড়ি থেকে আবর্জনা নেওয়ার ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। বর্তমানে ৩০/৩৫ শতাংশ বাড়ি থেকে আবর্জনা সংগ্রহ করা হয়। এটা ১০০% করে আবর্জনা নেওয়ার মূল্য কমাতে হবে। তবেই শহর পরিষ্কার থাকবে এবং মূল্য কম হলে সকলেই আবর্জনা দিতে রাজি থাকবে। সেইসাথে সুলভে পুর পরিষেবা দেওয়ার দিকে নজর দিতে হবে।