পিনাকী রঞ্জন পাল : একসময় টেস্ট ক্রিকেটই ছিল প্রকৃত ক্রিকেটের সংজ্ঞা। পাঁচ দিনের ধৈর্যের লড়াই, কৌশল আর ক্লাসিক ব্যাটিং-বোলিংয়ের মেলবন্ধন ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে ছিল আবেগের জায়গা। কিন্তু আজকের যুগে টি-২০ ক্রিকেটের ঝড়ো গতির সামনে কি টেস্ট ক্রিকেট টিকে থাকতে পারবে? বিসিসিআই-এর নতুন উদ্যোগ কি এই ধ্রুপদী ফরম্যাটকে ফিরিয়ে আনতে পারবে তার হারানো গৌরব? সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, এই নতুন নিয়মের ফলে কি ক্রিকেটাররা আরও বেশি করে টেস্ট খেলতে আগ্রহী হবেন?
আইপিএল বনাম টেস্ট : কোনদিকে যাবে ক্রিকেট?
আগামীকাল, ২২ মার্চ থেকে শুরু হচ্ছে ১৮তম আইপিএল। বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি দর্শক রাতের পর রাত জেগে দেখবেন তাঁদের প্রিয় দলের খেলা। চার-ছক্কার বন্যা, শেষ ওভার পর্যন্ত উত্তেজনার রেশ ধরে রাখা, সব মিলিয়ে আইপিএল যে আধুনিক ক্রিকেটের রাজা, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু এই আইপিএল-ই কি ধীরে ধীরে টেস্ট ক্রিকেটের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে?
আজকের ক্রিকেটাররা কি টেস্ট ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছেন? কারণ, এখানে পরিশ্রম বেশি, ম্যাচের সময়সীমা লম্বা, কিন্তু আর্থিক দিক থেকে টি-২০ বা ওয়ানডের তুলনায় পিছিয়ে। যেখানে একজন আইপিএল খেলোয়াড় কয়েক সপ্তাহের টুর্নামেন্টে ১০-১৫ কোটি টাকা আয় করতে পারেন, সেখানে টেস্ট ক্রিকেটারদের আয় অনেক কম।
টেস্ট ক্রিকেট বাঁচাতে বিসিসিআই-এর নতুন দাওয়াই
এই সংকটের মধ্যেই বিসিসিআই ঘোষণা করেছে এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। এবার থেকে আইপিএলের বিপুল অর্থ ঢালা হবে টেস্ট ক্রিকেট ও ঘরোয়া ক্রিকেটের উন্নতিতে। বিশেষ করে টেস্ট খেলোয়াড়দের আর্থিক দিক সুরক্ষিত করতেই বিসিসিআই-এর এই উদ্যোগ।
এই নতুন পরিকল্পনার মূল দিকগুলো হলো:
✅ বিসিসিআই-এর প্লেয়ার কনট্রাক্ট তালিকায় খেলোয়াড় সংখ্যা বাড়িয়ে ২৬ থেকে ৩০ করা হবে।
✅ খেলোয়াড়দের চারটি গ্রেডে ভাগ করা হবে – A+ (৭ কোটি), A (৫ কোটি), B (৩ কোটি) এবং C (১ কোটি)।
✅ টেস্ট ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক বাড়ানো হবে, যেখানে প্রতি টেস্ট ম্যাচে পাওয়া যাবে ১৫ লাখ থেকে ৪৫ লাখ টাকা পর্যন্ত!
✅ যদি কোনও ক্রিকেটার বছরে ৭৫% বা তার বেশি টেস্ট খেলেন, তাহলে তিনি প্রতি ম্যাচে ৪৫ লাখ টাকা পাবেন।
✅ ৫০%-৭৫% ম্যাচ খেললে পাবেন ৩০ লাখ, আর ৫০%-এর নিচে হলে পাবেন ১৫ লাখ।
এটা বোঝাই যাচ্ছে, বিসিসিআই এবার টেস্ট ক্রিকেটকে পুনরুজ্জীবিত করতে বড়সড় পরিকল্পনা নিয়েছে।
এবার কি ক্রিকেটাররা টেস্টকে গুরুত্ব দেবেন?
বিসিসিআই-এর প্রেসিডেন্ট রজার বিনি স্পষ্ট জানিয়েছেন, টেস্ট ক্রিকেটই প্রকৃত ক্রিকেট, এবং এটিকে টিকিয়ে রাখতেই এই উদ্যোগ। এখন প্রশ্ন হলো, এই নতুন নিয়ম ক্রিকেটারদের টেস্ট খেলার প্রতি কতটা আগ্রহী করবে?
ক্রিকেট বিশেষজ্ঞদের মতে, একজন শীর্ষস্থানীয় ক্রিকেটার যদি বছরে ১০টি টেস্ট খেলেন, তাহলে শুধু টেস্ট থেকেই তিনি সাড়ে চার কোটি টাকা আয় করতে পারবেন। এর সঙ্গে যুক্ত হবে বোর্ডের চুক্তির টাকা – যা হতে পারে আরও ৭ কোটি। অর্থাৎ একজন A+ গ্রেডের টেস্ট ক্রিকেটার বছরে প্রায় ১২ কোটি টাকা আয় করতে পারবেন!
এখন পর্যন্ত টেস্ট ক্রিকেটকে অনেকেই শুধুমাত্র ক্যারিয়ার গড়ার সিঁড়ি হিসেবে দেখতেন, যেখানে মূল লক্ষ্য থাকত ওয়ানডে বা টি-২০ দলে ঢোকা। কিন্তু এখন যখন টেস্ট ক্রিকেট থেকেও এত বড় আয় করা সম্ভব, তখন ক্রিকেটাররা কি আরও বেশি করে টেস্টে মনোযোগ দেবেন?
ঘরোয়া ক্রিকেটেও নজর বিসিসিআই-এর
বিসিসিআই শুধু আন্তর্জাতিক পর্যায়েই নয়, ঘরোয়া লম্বা ফরম্যাটের প্রতিযোগিতাগুলোকেও বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে।
✅ এবার থেকে বোর্ডের প্লেয়ারদের ঘরোয়া ক্রিকেট খেলতে হবে বাধ্যতামূলকভাবে, নাহলে বাদ পড়ার ঝুঁকি থাকবে।
✅ এভাবে ঘরোয়া ক্রিকেটের মান বাড়ালে, ভবিষ্যতে আরও দক্ষ টেস্ট ক্রিকেটার উঠে আসবে।
টেস্ট ক্রিকেট কি ফিরবে তার স্বর্ণযুগে?
এই নতুন নিয়ম চালু হওয়ার পরও কিছু প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে –
1️⃣ ক্রিকেটাররা কি শুধুমাত্র টাকার জন্য টেস্ট খেলবেন, নাকি সত্যিই ধৈর্যের এই খেলাটার প্রতি ভালোবাসা ফিরবে?
2️⃣ বিসিসিআই-এর এই নীতি কি ভবিষ্যতে অন্য দেশগুলোর ক্রিকেট বোর্ডও গ্রহণ করবে?
3️⃣ আইপিএল ও টি-২০-এর জনপ্রিয়তার মধ্যে টেস্ট ক্রিকেট কি আবার নিজের জায়গা ফিরে পাবে?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর সময়ই দেবে। তবে এটা নিশ্চিত যে, বিসিসিআই-এর এই উদ্যোগ টেস্ট ক্রিকেটের ভবিষ্যতের জন্য একটি বড় পরিবর্তনের সূচনা। একদিকে যেমন টি-২০ ক্রিকেটের ঝড়ো জনপ্রিয়তা, অন্যদিকে টেস্ট ক্রিকেটকে বাঁচানোর লড়াই – এখন দেখার বিষয়, ক্রিকেটের প্রকৃত স্পিরিট আবার ফিরে আসে কিনা!