জিলা স্কুল ও জলপাইগুড়ি

লেখক পঙ্কজ সেন

জলপাইগুড়ি জিলা স্কুল শহরের উত্তরপ্রান্তে তিস্তা নদীর ধারে একটি সুন্দর পরিবেশে অবস্থিত। সামনে খেলাধুলার মাঠ,গাছ-গাছড়া ও রকমারি ফুলের বাগান এই সব দেখেই মুগ্ধ না হয়ে থাকা যেত না।

জলপাইগুড়ি জিলাস্কুলের সদর ফটকে উল্লিখিত বিদ্যালয় স্থাপনা কাল দেখে জানা যায় যে, বিদ্যালয়ের পথ চলার শুরু ১৮৭৬ সালের ২৮শে মে। জলপাইগুড়ি যেহেতু তৎকালীন রাজশাহী বিভাগের প্রধান কার্যালয় ছিল,তাই সরকারি ব্যবস্থাপনায় গড়ে ওঠে এই বিদ্যালয়। তৎকালীন জলপাইগুড়ির আভিজাত্যের প্রতীক ছিল এই একমাত্র সরকারি বিদ্যালয়টি।

১৯৩৯ সালে তদানীন্তন অবিভক্ত বাংলার গভর্নর স্যার আর্থার হারবার্ট জিলা স্কুল পরিদর্শনে এসেছিলেন।স্বাধীনতার আগে (১৯৩৯) জিলাস্কুলের সরস্বতী পূজা বিদ্যালয়ে না হয়ে তেলী পাড়া কালী বাড়িতে হত। সরকারি জমি বা বাড়িতে তখন পূজা নিষিদ্ধ ছিল। বিখ্যাত বিপ্লবী তথা স্বাধীনতা সংগ্রামী তথা জলপাইগুড়ি জেলার প্রথম শহীদ বিপ্লবী বীরেন্দ্রনাথ দত্তগুপ্ত ১৯০৮ সালে জিলাস্কুল থেকেই মেট্রিকুলেশন পাশ করেন। ইংরেজ আমলে জলপাইগুড়ির কেন্দ্রীয় কারাগারে তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়।

১৯৩৯ সালে বিদ্যালয়ের ছাত্রদের করা সায়েন্স এক্সিবিশনে বিখ্যাত বিজ্ঞানী ডঃ মেঘনাদ সাহা সহ বিখ্যাত বৈজ্ঞানিকরা অংশগ্রহণ করেছিলেন। ১৯৪০ সালে বিখ্যাত গণিতজ্ঞ রমেশ চন্দ্র বসু জিলা স্কুলে এসেছিলেন। ১৯৩৮ সালে জিলা স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন বিদ্যালয়ের ছাত্র হাকিমপাড়া নিবাসী অভয় কুমার মজুমদার। ১৯৫৮ সালে জিলা স্কুলের কৃতি ছাত্র অশোক বসু স্কুল ফাইনাল পরীক্ষায় পশ্চিমবঙ্গে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি আইএএস হয়েছিলেন, এবং জ্যোতি বসুর মুখ্যমন্ত্রীত্বকালে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্য সচিব হিসেবে নিযুক্ত হন।

১৯৯৬ সালে বিদ্যালয়ের অপর কৃতি ছাত্র অভিষেক বসু উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পশ্চিমবঙ্গে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। বিদ্যালয়ের অপর কৃতি ছাত্র শুভঙ্কর সেন (১৯৯৩ সালে উচ্চমাধ্যমিকে বিদ্যালয়ে প্রথম) বর্তমানে ধানবাদ আইআইটি’ তে অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর হিসেবে নিযুক্ত রয়েছেন।কিন্তু এই বিদ্যালয়ের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে একটি ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের গল্প। ১৯০৭ সালের ১৫ই জনুয়ারি এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ধ্বংস হয়ে যায় বিদ্যালয়ের সকল রেকর্ড পত্রাদি এবং তৎকালীন বিদ্যালয় ভবনটি। তখন অবশ্য জিলা স্কুলের অবস্থান ছিল বর্তমান কমিশনার সাহেবের বাসস্থানের জায়গায়। কিন্তু এই অগ্নিকাণ্ডের ফলে বিদ্যালয় তার পূর্ব জন্মস্থান ছেড়ে দিয়ে আশ্রয় নেয় একটি ভাড়া বাড়িতে। বেছে নেওয়া হয় দুটি কার্যালয়। একটি বর্তমান তিন নম্বর ঘুমটির কাছে যে স্থানে নৃপেন শিকদারের বাড়ি, সেই স্থানে ও অপরটি ‘নরেন ভিলা’। সেই সময় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন ডি.এন. নিয়োগী। ১৯১৪ সালের শেষ বা ১৯১৫ এর প্রথম দিকে বিদ্যালয়টি তার বর্তমান স্থানে (সেনপাড়া, জলপাইগুড়ি পুরসভার তিন নাম্বার ওয়ার্ড) উপনীত হয়। বিদ্যালয়ের নকশা তৈরি করেছিলেন তৎকালীন রাজশাহী বিভাগের নির্বাহী বাস্তুকার অসওয়াল্ড স্মিথ সাহেব। বর্তমানে আমরা যে স্থানে বিদ্যালয়কে দেখি তখন তার নাম ছিল “কর্নেল কুটি”, সেখানে তখন বাস করতেন হেদায়েত আলী, তিনি ইংরেজদের অত্যন্ত প্রিয় পাত্র ছিলেন। যার নামে আলিপুরদুয়ার কথাটির সৃষ্টি। বিদ্যালয়ের প্রথম প্রধান শিক্ষক ছিলেন নীলমণি পাল। স্বাধীনতার পূর্ব মুহূর্তে (১৯৪৭) জলপাইগুড়ি জেলায় যে ১৫টি উচ্চ বিদ্যালয় ছিল বালকদের জন্য তার মধ্যে জিলা স্কুল ছিল অন্যতম। ১৯৬৮ সালের ৪ ঠা অক্টোবর রাতের ভয়াবহ বন্যায় বিদ্যালয়ের শতাব্দী প্রাচীন মূল্যবান গ্রন্থের সেই লাইব্রেরীর নিদারুণ ক্ষতি হয়। বন্যায় হারিয়ে যায় বিদ্যালয়ের তৎকালীন তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র সুশোভন। ১৯৭০-৭১’ এ সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতার রেশ জিলা স্কুলের শ্রেণিকক্ষের ভিতরেও আছড়ে পড়েছিল। স্কুলে-কলেজের তরুণ ছাত্র-ছাত্রীদের অভূতপূর্ব রাজনৈতিক আন্দোলনে কিছুদিনের জন্য বিদ্যালয়ের পঠন-পাঠন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। পরে অবশ্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছিল। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার সময় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন তামস রঞ্জন রায়। এই বিদ্যালয়ের ছাত্র হয়ে যারা পরবর্তীতে অসামান্য দক্ষতা রেখেছেন তারা হলো খগেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত, চারুচন্দ্র সান্যাল, নির্মল বসু, দেবেশ রায়, সমরেশ মজুমদার, প্রদীপ কুমার বন্দোপাধ্যায়, শচীন দাশগুপ্ত, বিনয় দাশগুপ্ত, নীতিশ দত্ত রায়, অশোক বসু, কল্যাণ বাগচী, সুকল্যাণ ঘোষ দস্তিদার প্রমূখ।

পূর্বে খেলাধুলাতেও জেলার মধ্যে সেরার সম্মান বহুবার পেয়েছে জিলা স্কুল। বিদ্যালয়ের অনেক ফুটবল খেলোয়াড় পরবর্তীতে ভারত কিংবা বাংলার হয়ে, কলকাতার নামকরা বড় বড় ক্লাবের হয়ে এবং জলপাইগুড়ি জেলা দলের হয়ে খেলেছেন। সুকল্যাণ ঘোষ দস্তিদার (১৯৭৪ সালে মোহনবাগান অধিনায়ক), মন্টু স্যান্যাল, প্রদীপ তলাপাত্র, বিকাশ ঘোষ, অমল সরকার, অরুণ সরকার, তপাই বাগচী, সত্য মুখার্জি, গোলকিপার বরুণ কমলের নাম এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। ভারতের বিখ্যাত ফুটবল খেলোয়াড়, প্রশিক্ষক ও টেকনিক্যাল ডিরেক্টর প্রদীপ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এই বিদ্যালয়েরই প্রাক্তন ছাত্র।

সাদা জামা ও কালো প্যান্ট এবং ইংরেজ আমলের এই লাল বিল্ডিং এর কথা, এর ঐতিহ্যের কথা এবং সকল বাধা বিপত্তি কাটিয়ে জলপাইগুড়ি জিলা স্কুল এগিয়ে চলবে শ্রেষ্ঠত্যের দিকে। সর্বদা হৃদয়ে রাখবো সেই চিরন্তন আদর্শ “find a way or make it”

কৃতজ্ঞতা স্বীকার : বিদ্যালয়ের ১২৫ বছর বার্ষিকী স্মরণিকা।

ছবি ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *