পিনাকী রঞ্জন পাল
একটি ছেলে, সে ইতিমধ্যেই পড়তে শুরু করেছে বিশ্বের বড় বড় মানুষদের জীবন কাহিনি। একদিন ক্লাসের সহপাঠীদের ডেকে সে বললো : এগারোই আগস্ট শহিদ ক্ষুদিরামের ফাঁসির দিন। ওইদিন আমরা সবাই উপবাস করবো, স্মরণ করবো তাঁর আত্মদানের ইতিহাস !
সমস্ত ছাত্রই সেই ছেলেটির প্রস্তাবে সাড়া দিল। কেউ সেদিন কিছু খেল না। খবর পৌঁছে গেল ব্রিটিশ শাসকদের কানে। ছাত্রদের মধ্যে, বিশেষ করে সেই ছেলেটির চেতনার উন্মেষের লক্ষণ দেখে তাঁরা মনে করলেন, প্রধান শিক্ষক মহাশয়েরও প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় রয়েছে ছাত্রদের পক্ষে। তাই ইংরেজ শাসকরা তাঁকে বদলি করে দিল।
বলোতো সেই সাহসী ছেলেটি কে ? কে প্রথম প্রস্তাব দিয়েছিল উপবাস করার জন্য ? কি পারলে না বলতে ? ঠিক আছে সেই ছেলেটির আর একটি গল্প বলছি। দেখি তোমরা চিনতে পারো কিনা।
ছেলেটি তখন প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র। এলগিন রোডের বাড়ি থেকে প্রত্যহ যাতায়াত করতো। যাওয়া আসার পথে প্রত্যহ দেখা হতো এক অন্ধ বৃদ্ধার সাথে। বৃদ্ধাটি তাঁদের বাড়ির সামনে ফুটপাতে বসে ভিক্ষে করতো। তার গায়ে ছিল লজ্জা নিবারণের অনুপযোগী এক জীর্ণ বস্তু। ঝড়-বৃষ্টি মাথার ওপর দিয়ে বয়ে যেত। বৃদ্ধার দৈনন্দিনের জীবন সংগ্রাম বড় ব্যথা দিয়েছিল সেই ছেলেটিকে। ছেলেটি তিনতলা বাড়ির ঘরে বসে প্রায়ই ভাবতো এই বৃদ্ধার কথা। তাঁর বারবার মনে হতো আমার তিনতলায় বাস করার কি এমন অধিকার আছে, যখন ওই বৃদ্ধাটি খোলা আকাশের নিচে বাস করছে। ওই বৃদ্ধার দুঃখ-কষ্ট তাঁর হৃদয়কে ক্ষত-বিক্ষত করে দেয়। সে ভাবতো, সমাজ পরিবর্তন ছাড়া এই বৃদ্ধার মুক্তি নেই। কিন্তু সে অনেক দূরের কথা ! এখন কি করা যায় ? মনে মনে উত্তরও পেয়ে যায় সে। ট্রামে যাতায়াতের জন্য | বাড়ি থেকে প্রতিদিন কিছু পয়সা দেওয়া হতো তাঁকে। পরদিন থেকে ছেলেটি হেঁটে কলেজে যাওয়া-আসা শুরু করে আর ভাড়ার পয়সার সবটাই তুলে দেয় ওই বৃদ্ধার হাতে।
কি এবারও পারলে না চিনতে ? তবে আমিই বলি, আজও যাঁকে আমরা শ্রদ্ধার সাথে বলি নেতাজি, তিনিই হচ্ছেন সেই ছেলেটি। অদম্য সাহসী এই বিপ্লবীর ওপরটা বজ্রের মতো কঠিন হলেও অন্তরে তাঁর সঞ্চিত ছিল অপার করুণা।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ধ্রুবতারার মতো উজ্জ্বল নক্ষত্র নেতাজি’ সুভাষচন্দ্র বসু জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৮৯৭ সালে ২৩ জানুয়ারি। তাঁর বাবা জানকীনাথ বসু, মা প্রভাবতী দেবী। ১৯১১ সালে তিনি দর্শনশাস্ত্রে অনার্সসহ স্নাতক হন। ১৯২০ সালের জুলাই মাসে তিনি আই, সি. এস. পরীক্ষায় চতুর্থ স্থান অধিকার করেন।
তিনি দেশবন্ধুর নেতৃত্বে দেশের কাজে যোগ দেন এবং কংগ্রেসের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। ১৯২১ সালে তিনি প্রথম কারাবরণ করেন। ১৯২৩ সালে ‘ফরোয়ার্ড’ পত্রিকার কর্মাধ্যক্ষ ও সম্পাদক হন। ১৯২৪ সালে তিনি সর্বসম্মতিক্রমে কলিকাতা কর্পোরেশনের চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার হিসাবে দেশের কাজে সর্বোতোভাবে আত্মনিয়োগ করেন।
১৯২৪ সালের অক্টোবরে সুভাষ আন্তরীণ হন। প্রথমে কলিকাতায়, তারপর বহরমপুর এবং অবশেষে তাঁকে ১৯২৬ সালের ২৫ জানুয়ারি মান্দালয় জেলে স্থানান্তরিত করা হয়। তিনি ১৯২৮ সালে কলিকাতায় অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় কংগ্রেস অধিবেশনের জি. ও. সি. ছিলেন। মহাত্মা গান্ধির সাথে তাঁর রাজনৈতিক মত পার্থক্য একসময় গুরুতর আকার ধারণ করেছিল। তার ফলে কংগ্রেসের সভাপতির পদ ত্যাগ করে তিনি ফরোয়ার্ড ব্লক স্থাপন করেছিলেন।
১৯৪১ সালের ১৭ জানুয়ারি ব্রিটিশের সমস্ত প্রহরাকে ফাঁকি দিয়ে পাঠানের বেশে ‘মৌলভি জিয়াউদ্দিন নামে ভোর রাতে মোটরে চড়ে অন্তর্ধান হলেন সুভাষচন্দ্র। চলে গেলেন বিদেশে। সেখানে পৌঁছে ইংরেজ বিরোধী দেশ জাপানের সাথে হাত মেলালেন। গড়ে তুললেন ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’ নামে একটি সামরিক বাহিনী।
আজাদ হিন্দ ফৌজ সিঙ্গাপুর জয় করে প্রথম স্বাধীনতার স্বাদ পেল। তারপরই ভারতের বিদেশি শাসক ইংরেজদের বিরুদ্ধে তাঁরা যুদ্ধ ঘোষণা করলো। ১৯৪৫ সালের ১৮ মার্চ ভারতের মাটিতে স্বাধীন ভারতের। জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে ভারত ইতিহাসের বুকে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন আমাদের সকলের প্রিয় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু।
Photo Credit- google.