পিনাকী রঞ্জন পাল : পৃথিবীর সাত আশ্চর্যের একটি ‘মিশরের পিরামিডে’র কথা আজ কারোরই অজ্ঞাত নয়। নীল নদের তীরে এল-গিজে নামক স্থানে মিশরের চতুর্থ রাজবংশের ফেরো অর্থাৎ সম্রাট খুফু আনুমানিক ২,৫৮০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে তৈরি করেছিলেন পৃথিবীর বৃহত্তম পিরামিড। বর্তমানে এর উচ্চতা ৪৮০ ফুট। খুফুর পিরামিডের পাশেই আছে আরও দু’টি বিখ্যাত পিরামিড খা-ফ-রা’র পিরামিড আর মেনকাউরের পিরামিড। সুউচ্চ এই পিরামিডগুলি এক-একটি সমাধিসৌধ।

কয়েক হাজার পূর্বের মানুষ কি অদ্ভুত কৌশলে পিরামিডগুলি তৈরি করেছে, তা ভাবলে বিস্ময়ে অভিভূত হতে হয়। জানা গেছে, পরম্পরা অনুসারে মিশরের পুরনো বাদশাহরা সিংহাসনে বসেই নিজের জন্য সমাধিসৌধ বা পিরামিড নির্মাণ শুরু করে দিতেন। পিরামিডের ভিত্তিরেখা বর্গাকার হত আর সম্পূর্ণ আকার হত ত্রিকোণাকার। এদের গঠনশৈলী এমন, যেন একের ওপর এক-একটি রোয়াক বসান হয়েছে, যাদের ওপরেরটা থেকে নিচের রোয়াক আকারে ক্রমশ বড় হতে থাকে। দেখতে এমন লাগে যেন সিঁড়ির এক দীর্ঘ রেখা উঠে গেছে।

পিরামিডের শীর্ষ দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেন সূক্ষ্ম অগ্রভাগ। কিন্তু বাস্তবে সেটা একটা বিশাল রোয়াক। যার প্রতি পাশের দৈর্ঘ্য ১৮ ফুট। এই শীর্ষ রোয়াক তৈরি হয়েছে বারটি বড় বড় পাথর দিয়ে। ওপর থেকে নিচের সমস্ত পাথরে সচিত্র লেখা খোদাই করা আছে। সবচেয়ে উঁচু খুফুর পিরামিডের ভিত্তিরেখা ২৩০ মিটার। ১৩ একর জমির ওপর এটি অবস্থিত। এক লক্ষ লোক একনাগাড়ে কুড়ি বছর ধরে পরিশ্রম করে এই পিরামিডটি গড়ে তুলেছিল। এতে ২২ টন ওজনের ২৩ লক্ষ চুনাপাথরের চাঁই ব্যবহৃত হয়েছে। সব চাঁইয়ের মিলিত আয়তন ২৫,৬৮,০০০ বর্গমিটার। প্রত্যেকটি চাঁই ৯ মিটার লম্বা। প্রতি তিন মাস অন্তর অন্তর এর শ্রমিকদের পরিবর্তন করা হত। কর্মরত শ্রমিকদের খাবার হিসাবে রসুন-পেঁয়াজও দেওয়া হত।

ছবি প্রতীকি
পিরামিডের আকার দেখে সহজেই অনুমান করা যায় যে, এর শীর্ষে চড়া বা তা থেকে নামা কোন ঠাট্টা-তামাশা নয়। প্রতিটি পাথর আড়াই টন ভারী, কঠিন আর খোদাই করা। এর ওপর চড়ার জন্য চিতার মত লাফ দিয়ে এক একটি রোয়াক পার করতে হবে। সামান্য পা হড়কে গেলেই একেবারে মৃত্যুপুরী পৌঁছে যেতে হবে। এখন যদি তোমাদের বলা হয় যে, মাত্র ৬ মিনিটে এই ৪৮০ ফুট পিরামিডের শীর্ষে চড়ে নেমে আসা কি সম্ভব ? তোমরা প্রত্যেকেই নাক কুঁচকে বলে উঠবে, এটা অসম্ভব। কিন্তু আবুনাবীর কাছে এটা ছিল সত্যিই এক সাধারণ খেলা। আবুনাবী লাফ মেরে পিরামিডের শীর্ষে উঠে যেত আবার নেমে আসত মাত্র ৬ মিনিটে।
মিশরবাসী যুবা আবুনাবী না জানি কোন্ ধাতু দিয়ে তৈরি ছিল। এই অসম্ভব মনে হওয়া কাজকে ও হাসতে হাসতে শেষ করত। এটাই নয়, আবুনাবী একদিনে বেশ কয়েকবার এই ম্যাজিক খেলা খেলত।
নিচের থেকে চড়াই শুরু করার পর আবুনাবী সাড়ে চার মিনিটে শীর্ষে পৌঁছে যেত। পিরামিডের মাথায় পৌঁছে তার বিশ্রাম নেবারও অবসর থাকত না। শীর্ষে পৌঁছে সে শুধুমাত্র নিজের দু’হাত নাড়িয়ে বিশেষ ইশারা করত, এক জোরদার চিৎকার করে পুনরায় বিদ্যুৎগতিতে নিচে নেমে আসত। নামার সময় মনে হত আবুনাবী এই পৃথিবীর কোন প্রাণী নয়, বরং সে অন্য কোন গ্রহের বাসিন্দা এবং তার শরীর বিদ্যুৎ দ্বারা চালিত। আবু পাক খেত, গোল হয়ে যেত, লাফ মারত আর হাওয়ায় ভেসে যেন নিচে নেমে আসত। কারণ, তার কাছে মাত্র নামার সময় দেড় মিনিট সময়ই বেঁচে থাকত। দূর থেকে দেখলে মনে হত যেন কোন ফূর্তিবাজ বাঁদর বা চিতা পিরামিড থেকে নিচে নামছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা দমবন্ধ করে অবাক বিস্ময়ে এই দৃশ্য দেখত আর যখন আবু তার অসম্ভব অভিযান শেষ করে নিচে আসত, তখন তারা আশ্চর্য আর খুশিতে তালি দিত এবং আবুকে ধন্যবাদ জানাত।
আবুর এই খেলা যে দেখেছে, সে প্রশংসা না করে পারেনি। ১৯৫৭ সালে যুগোস্লাভিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো মিশরে সরকারি ভ্রমণে এসে সেখানকার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে পিরামিড দেখতে গেলে আবুনাবীর সঙ্গে তাঁদের পরিচয় করান হয়। মার্শাল টিটোও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না যে, কোন মানুষ মাত্র ছ’মিনিটের মধ্যে এই সুউচ্চ পিরামিডের শীর্ষে উঠে নেমে আসতে পারে। টিটোর মতে, এই কাজের জন্য কুড়ি মিনিটও অনেক কম। একথা শুনেই আবু পিরামিডের দিকে ছুটে যায়। সেদিন মাত্র সাড়ে পাঁচ মিনিটে আবু পিরামিড জয় করে দেখিয়েছিল। মার্শাল টিটো এই কাজে এতটাই খুশি হয়েছিলেন যে, তিনি তাড়াতাড়ি নিজের পকেট থেকে সোনার সিগারেট কেস বার করে আবুকে পুরস্কার স্বরূপ দিয়ে তার প্রশংসা করেন। সেই বছরই শাহ সউদ যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরার পথে মিশরের পিরামিড দেখতে গিয়েছিলেন, তখন তাঁকেও আবু তার অদ্ভুত খেলা দেখিয়ে সউদের কাছ থেকে এক হাজার পাউন্ড পুরস্কার পেয়েছিল।