অ্যামুন্ডসেনের কুমেরু বিজয়

দক্ষিণ মেরুতে পদার্পণকারী বিশ্বের সর্বপ্রথম ব্যক্তি হলেন নরওয়ের রোয়ান্ড অ্যামুন্ডসেন। যদি ইচ্ছা শক্তি প্রবল হয় আর কঠিন পরিস্থিতির বিরুদ্ধে সংঘর্ষ করার ভাবনা ব্যক্তির মধ্যে থাকে, তবে তার বিজয় সুনিশ্চিত। অ্যামুন্ডসেনের দক্ষিণ মেরু বিজয়ের কাহিনীই আজ শোনাচ্ছেন পিনাকী রঞ্জন পাল।

নরওয়ের দশ বছরের বালক রোয়ান্ড। অ্যামুন্ডসেন স্বপ্ন প্রায়ই দেখতো। সকালে ওঠে যখন সে রাতের স্বপ্নে দেখা কাহিনী শোনাতো তখন সবাই চমকে উঠতেন। স্বপ্নে সে এমন সব শব্দ করতো, মা শুনে মনে হত সে কোনো জাহাজ চালাচ্ছে। স্বপ্নে সে কখনো অন্তরীক্ষে ঘুরে বেড়াতো, আবার কখনো নৌকা নিয়ে সমুদ্রের ঢেউয়ের বুক চিরে এগিয়ে যেত। পর্বতশীর্ষে আরোহন করে সে পতাকা পুঁতে আসতো আবার কখনো স্বপ্নে সে উত্তর তথা দক্ষিণ মেরু ভ্রমণ করতো। সকালে সে রাতের দেখা স্বপ্নের কথা স্মরণ করে ভাবতো তার দেখা স্বপ্ন কি কোনদিনও সত্যি হবে।

আরো কিছুটা বড় হবার পরে অ্যামুন্ডসেন কঠিন থেকে কঠিনতর যাত্রা করা আর নতুন নতুন জায়গা খোঁজার সংকল্প করে। সে সাহসিক কাহিনি পড়তে ভীষণ ভালোবাসতো। অ্যাম্বুন্ডসেন বই পড়ে জেনেছিল যে উত্তর মেরুতে পৌঁছানো ভীষণ কঠিন। সেখানে বরফের ঝড় হতে থাকে আর হাজার হাজার মাইল শুধু বরফই দেখা যায়। সে বরফ কেটে নিজের যাওয়ার জন্য রাস্তা ভানাবার অভ্যাস করতো। সে উত্তর আর দক্ষিণ মেরুর ভৌগলিক এবং জলবায়ু সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করেছিল।

একদিন অ্যাম্বুন্ডসেন কে তাঁর এক অধ্যাপক ডেকে বলেন, ‘তুমি দারুণ সাহসী। কিন্তু একজন সফল | অনুসন্ধানকারীকে শুধু সাহসী হলেই চলবে না, পাশাপাশি শারিরীক দিক দিয়ে সুস্থ থাকতে হবে। নয়তো সে যাত্রাপথের কষ্ট সহ্য করতে পারবে না।”

অধ্যাপকের কথা শুনে অ্যামুন্ডসেন কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়ে। সে এক বন্ধুকে বলে, ‘আমি উত্তর মেরুতে পদার্পণকারী বিশ্বের প্রথম ব্যক্তি হতে চাই। আমার স্বাস্থ্য কি তার উপযুক্ত নয় ?’

বন্ধু জবাব দেয়, ‘তোমার স্বাস্থ্যই শুধু ভালো নয়। তোমার ভেতরে দৃঢ় নিশ্চয় আর ইচ্ছা শক্তি প্রবল রয়েছে। তুমি অবশ্যই তোমার স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে।

অ্যামুন্ডসেনের কাছে বন্ধুর এই বাক্য ‘বরদান’ বলে প্রমাণতি হয়। সে উত্তর মেরু সম্পর্কে বিস্তর পড়াশোনা করে। প্রচুর নকশা দেখে এবং নিজের হাতে তৈরি করে। অভিজ্ঞ যাত্রীদের সাথে কথা বলে। নরওয়ের জঙ্গলে ভরা পাহাড়ি এলাকাতে ভ্রমণ করে। সমুদ্র সম্পর্কেও বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে। রাতে যখন বরফ বড়তো, তখন সে ঘরের জানালা খুলে ঘুমাতো আর বরফের ওপর দিয়ে মাইলের পর মাইল দৌড়াতো। এর ফলে তার স্কুলের পড়াশোনা বিঘ্নিত হচ্ছিল, কিন্তু সে মনকে বোঝাতো, ‘কোনও নতুন স্থানের সন্ধান করা কি এক ধরনের পড়াশোনা নয় ?

সময় তার নিজস্ব গতিতে এগিয়ে চলে। অ্যামুন্ডসেন বড় বড় নৌকা আর জাহাজ চালানোই শুধু নয়, নিজের সঙ্গীদের সাহায্যে সেসব তৈরি করা এবং খারাপ হয়ে গেলে সেগুলো মেরামত করাও শিখেছিল। একদিন সে সঙ্গীদের ডেকে ঘোষণা করলো, ‘বন্ধুরা, আমরা এখন উত্তর মেরু যাত্রার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত। সেখানে পৌঁছে আমরা নিজেদের দেশের পতাকা তুলবো আর বিশ্ববাসীকে এই সংবাদ দেব যে মানুষের পক্ষে কোনও কাজই কঠিন নয়।

১৯০৯ সালের মে মাসের একটি দিন। সব যাত্রীর মধ্যে ভীষণ উৎসাহ ছিল। প্রস্তুত ছিল নৌকাও। অ্যামুন্ডসেনদের শুভকামনা জানাবার জন্য নরওয়েবাসীরা একত্রিত হয়েছিলেন। তখনই বজ্রপাত হল। তাদের কাছে আমেরিকা থেকে সংবাদ এল যে রবার্ট এডুইন পিয়েরি নামের এক মার্কিন অনুসন্ধানকারী উত্তর মেরুতে আর নিজের দেশের পতাকা পুঁতে এসেছেন গত মাসেই (১৯০৯-র এপ্রিল)। এই সংবাদে অ্যামুন্ডসেন ভীষণ আঘাত পান। তাঁর মনে হল যেন নিজের দেশের নাক কাটা গেল এই সংবাদে।

তবুও অ্যামুন্ডসেন নিজের আত্মবিশ্বাস হারান না। যাত্রা করবার সমস্ত তৈয়ারী হয়ে গিয়েছিল। এইজন্য সে সঙ্গীদের উত্তর মেরুকে ভুলে তৎক্ষণাৎ দক্ষিণ মেরুর দিকে রওনা হওয়ার পরামর্শ দেন আর নতুন পথে তাদের যাত্রা আরম্ভ হয়।

কিন্তু কিছুদিন পরেই তারা জানতে পারলেন যে ইংরেজ যাত্রী ক্যাপ্টেন স্কার্টও দক্ষিণ মেরুর দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। এই সংবাদ মুহূর্তের জন্য হলেও অ্যামুন্ডসেনকে ভীত করে তোলে। আর মনে হল এবারও সে বোধহয় স্কটের কাছে হেরে গেল।

প্রায় দেড় বছরের লাগাতার যাত্রার পর অ্যামুন্ডসেনরা ‘হ্রাস বৈরিয়ার’ নামক একটি স্থানে পৌঁছান। তাদের যাত্রাপথের সব থেকে ভয়ানক আর মারাত্মক অংশ এখান থেকেই শুরু হয়। এখান থেকে যাত্রা করা কোনো যাত্রীই কোনদিনও জীবিত ফিরে আসেননি।

অ্যামুন্ডসেন তাঁর সঙ্গীদের ডেকে বললেন, “বন্ধুরা, আমরা দেড় বছর ধরে পথ চলছি। একত্রে আমরা প্রচুর সমস্যার | সম্মুখীন হয়েছি এবং তাদের সমাধান করেছি। এরই মাঝে কয়েকজন সঙ্গী আমাদের ছেড়ে ঈশ্বরের কাছে চলে গেছেন। কিন্তু তবুও আমরা সাহস হারাইনি। এখন থেকে শুরু হচ্ছে সবচেয়ে দুর্গম যাত্রাপথ, বাস্তবে যে পথকে বলা হয় মৃত্যুর কুঁয়া। আপনারা কি সকলেই আমার সাথে যেতে প্রস্তুত আছেন।

সকলে সম্মতি জানালে শুরু হয় আসল তৈয়ারি। পোষাক আর জুতো প্রচুর সংখ্যক নেওয়া হয়। ওধুষপত্র নেওয়া হয়। কুকুর দ্বারা টানা স্লেজ গাড়ির যন্ত্রপাতি ঠিক আছে কিনা পরীক্ষা করা হয়। স্লেজ টানার জন্য ৫২টা এক্সিমো কুকুর আনানো হয়। তাঁবুর জন্য খুঁটি, মোটা কাপড় জোগাড় করা হয়। | আরো অন্যান্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে কেটে যায় দীর্ঘ ১০টি মাস। অ্যাম্বুন্ডসেনের চিন্তা বাড়তে থাকে, তাঁর আগেই না ইংরেজ যাত্রী স্কট কুমেরুতে পৌঁছে যান।

সঙ্গীদের বলেন, ‘আজ অক্টোবরের ১৯ তারিখ। ইতিহাসে এই তারিখটি লেখা থাকবে কারণ আজই আমরা এখান থেকে আগে অগ্রসর হচ্ছি।’

তাঁর কয়েকজন সঙ্গী শেষ মুহূর্তে সেখানেই থেকে যায়। আগে যাবার সাহস আর তাদের অবশিষ্ট ছিল না। কিন্তু অ্যাম্বুন্ডসেনের কাছে এই পথটুকু ছিল স্বপ্নপুরণের সুবর্ণ সুযোগ। সে চারটি স্লেজ গাড়ি প্রতিটিতে তেরোটি করে কুকুর জুড়ে দেয়। গাড়িতে সব কিছু বোঝাই করে তারা রওনা দেয়। চলার পথে কিছু দুর অন্তর অন্তর বরফের বড় বড় থাম তৈরি করে তাতে কিছু না কিছু রেখে যেত, যাতে তাঁরা যদি বেঁচে ফিরতে পারে তবে যেন ফেরার রাস্তায় সংকেত পায়।

এইভাবে অ্যামুন্ডসেনরা এগোতে থাকে। পথে কখনো তাদের পাহাড়, কখনো খাদ পড়তো। কখনও বরফের চাঙর ভেঙে পড়ে তার নিচে চাপা পড়তো কুকুর আর স্লেজ গাড়ি। আবার কুকুরদের সেবা যত্ন করে, গাড়ি ঠিক করে তারা এগিয়ে যেত। সমগ্র যাত্রায় খাবার অভাবে তারা একসময় ২৪টি কুকুরকে মেরে খেয়েছিল।

কয়েক সপ্তাহ চলার পর তারা লক্ষ্যের অতি নিকটে পৌঁছে যায়। অবশেষে ১৯১১ সালের ১৪ ডিসেম্বর অ্যাম্বুন্ডসেনের স্বপ্ন পূরণ হয়, তারা দক্ষিণ মেরুতে বিশ্বের সর্বপ্রথম মানুষ হিসাবে পদার্পণ করেন। সেদিন অ্যাম্বুন্ডসেনের সাথে ছিল মাত্র চারজন সাথী। তারা হলেন Olavson Bjaaland, Helmer Hanssen, Sverre H.” Hassell এবং Oskar wisting। সাউথ পোলে অ্যাম্বুন্ডসেন নরওয়ের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। এদিকে অ্যাম্বুন্ডসেনদের সাফল্যে সম্পূর্ণ নরওয়ে উৎসবে মেতে ওঠে। তারা ‘রাস বৈরিয়ার’-এ ফিরে এলে দেশের জাহাজ তাদের স্বাগত জানাতে সেখানে সেজেগুজে প্রস্তুত ছিল। দক্ষিণ মেরু বা কুমেরুতে পদার্পণকারী বিশ্বের সর্বপ্রথম মানুষ হিসাবে ইতিহাসে অমর হয়ে যায় নরওয়ের রোয়াল্ড অ্যামুন্ডসেনের (১৮৭২-১৯২৮ খ্রী:) নাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *