অনন্যা এক বর্ণময় ব্যক্তিত্ব – রানী ২য় এলিজাবেথের জীবন

অরুণ কুমার : সাত দশক ধরে ব্রিটেনের রানি হিসাবে ছিলেন তিনি। প্রয়াত রানী ২য় এলিজাবেথ। রানীর প্রয়াণে শেষ হল ব্রিটিশ রাজ পরিবারের একটা অধ্যায়ের। অপরদিকে ৭৩ বছর বয়সে ব্রিটেনের রাজা হয়েছেন চার্লস। সম্পূর্ণ জীবন সমাপ্ত করে ওনার আত্মা আজ অজানার পথে । কিছু কাল অবধি যা ছিল বাস্তব, আজ ইতিহাস । কবি’র ভাষায় “ঋজু শাল অশ্বত্থের শিকড়ে শিকড়ে যত ক্ষুধা সব তুমি সয়েছ, বসুধা।” উনি ই ছিলেন লন্ডন এর ট্যুরিজম এমব্লেম। ব্রিটেনের দীর্ঘতম দায়িত্ব পালনকারী রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ কিছু সময়ের জন্য বালমোরাল ক্যাসেলে ছিলেন। বলে রাখা প্রয়োজন, শরীর ভাল যাচ্ছিল না রানীর। গত বছর অক্টোবর থেকেই পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপ হতে থাকে। হাঁটাচলা প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়ে ছিল বলেও খবর।

রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ এর বর্নময় জীবন। এলিজাবেথ এর জন্ম ১৯২৬ সালে ২১ এপ্রিল, লন্ডনের ১৭ ব্রাটন সেন্টে। নৌ অফিসার ফিলিপ মাউন্টব্যাটেনকে বিয়ে করেছিলেন তিনি। তাদের চার সন্তান রয়েছে- প্রিন্স চার্লস, প্রিন্সেস অ্যান, প্রিন্স অ্যান্ড্রু এবং প্রিন্স এডওয়ার্ড। দীর্ঘ সময় একা কাটিয়েছেন রানি। রানীর স্বামী রাজা ফিলিপ ২০২১ সালের এপ্রিলে ৯৯ বছর বয়সে প্রয়াত হন। এলিজাবেথ ১৯৫২ সালে তার পিতার মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসেন।

রানী এলিজাবেথ তিনি যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড, জ্যামাইকা, অ্যান্টিগুয়া এবং বারবুডা, বাহামা, বেলিজ, গ্রেনাডা, পাপুয়া নিউ গিনি, সলোমন দ্বীপপুঞ্জ, সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিস, সেন্ট লুসিয়া, সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিস সহ ১৫ টি অঞ্চলের রানী হিসাবে দায়িত্ব সামলেছেন।

৯৬ বছর বয়সে প্রয়াত হয়েছেন এই রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ। নিয়ম অনুযায়ী যুবরাজ চার্লসই হয়েছেন ইংল্যান্ড এবং ১৫টি কমনওয়েলথ দেশের রাজা। মায়ের মৃত্যুর ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই চার্লসকে অনুষ্ঠানিকভাবে রাজা ঘোষণা করা হয়েছে ।এর আগে মায়ের অসুস্থতার খবর পেতেই স্কটল্যান্ডের বালমোরাল প্রাসাদে পৌঁছে যান চার ছেলে-মেয়ে— যুবরাজ চার্লস (৭৩), রাজকুমারী অ্যান (৭২), যুবরাজ অ্যান্ড্রিউ (৬২), যুবরাজ এডওয়ার্ড (৫৮)। চার্লসের বড় ছেলে যুবরাজ উইলিয়ামও পৌঁছে যান। সুদূর আমেরিকা থেকে ছুটে আসেন উইলিয়ামের ভাই হ্যারি এবং তার স্ত্রী মেগান। তার পরই আসে রানির মৃত্যুর খবর।৭৩ বছর বয়সি চার্লস ১৯৫২ বাকিংহ্যাম প্যালেসে মাথায় যুবরাজের মুকুট পরেন। তার উপাধি ‘প্রিন্স অব ওয়ালেশ’ এখন যাবে তার বড়ে ছেলে উলিয়ামের মাথায়। মায়ের মৃত্যুর ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই লন্ডনের সেন্ট জেমস প্রাসাদে একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে চার্লসকে রাজা ঘোষণা করা হয়েছে। প্রথা অনুসারে সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন প্রিভি কাউন্সিলের সদস্যরা, সরকারি আধিকারিক, কমনওয়েলথের হাই কমিশনারগণ এবং লন্ডনের মেয়র। রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর পর বাকিংহ্যাম প্যালেস থেকে একটি বিবৃতি জারি করে শোকপ্রকাশ করা হয়। সেই বিবৃতিও জারি করা রাজার তরফ থেকে।এই নিয়মতান্ত্রিক
আনুষ্ঠানিকতা পালন করা হয়।

উল্লেখ করা যেতে পারে যে, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উইনস্টন চার্চিল যখন দায়িত্ব পালন করছিলেন, সে সময় পিতা রাজা ষষ্ঠ জর্জের মৃত্যুর পর তিনি উত্তরাধিকারী হিসেবে দায়িত্ব নেন। এরপর তাঁর অধীনে আরও ১৫ জন প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব পালন করেছেন। বৃটেনের পঞ্চদশ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে লিজ ট্রাসকে মঙ্গলবার নিয়োগ দেওয়ার মাত্র ৪৮ ঘণ্টা পর তাঁর জীবনাবসান ঘটল। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর আগে অন্তত আরও দুজনের জন্ম তাঁর রানি হিসেবে অভিষিক্ত হওয়ার অনেক পরে। তাঁর জীবদ্দশায় তিনি শুধু যুক্তরাষ্ট্রেরই প্রায় এক ডজন প্রেসিডেন্টকে তাঁর প্রাসাদে স্বাগত জানিয়েছেন। তাঁর বড় ছেলে তৃতীয় চার্লস ৭৩ বছর বয়সে রাজা হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন বলে প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস জানিয়েছেন। চার্লসের রাজা হওয়ার বিষয়টি তাঁর তিন বছর বয়সের সময়েই ঠিক হয়ে ছিল। ক্ষমতা হস্তান্তরের পালা প্রত্যাশা অনুযায়ী সম্পন্ন হয়েছে। চার্লসের স্ত্রী ক্যামিলাকে পূর্ণ রানি না বলে কুইন কনসর্ট বলা হবে।

গত বৃহস্পতিবার দুপুরে হঠাৎ করে বাকিংহাম প্রাসাদ থেকে যখন জানানো হয় যে রানি চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে রয়েছেন, তখনই তাঁর স্বাস্থ্য নিয়ে শুরু হয় জল্পনা । তাঁর পরিবারের সদস্যরা যুক্তরাজ্যের নানা প্রান্ত থেকে স্কটল্যান্ডের বালমোরাল প্রাসাদে জড়ো হওয়ার পর স্থানীয় সময় সন্ধ্যা সাতটার কিছু আগে ঘোষণা করা হয় যে দুপুরে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। রানির মৃত্যুর পর কীভাবে তা প্রচার করা হবে, তাঁর শেষকৃত্যের আয়োজন এবং রাজা হিসেবে চার্লসের দায়িত্ব গ্রহণের বিষয়গুলো আগে থেকেই মোটামুটি পরিকল্পনা করা ছিল এবং তা নিয়ম অনুযায়ী পালন করা হবে।

জানা গিয়েছে, পরিকল্পনা অনুযায়ী রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের শেষকৃত্য রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় অনুষ্ঠিত হবে মৃত্যুর দিন ঘোষনা থেকে ১০ দিন পর লন্ডনে। পরবর্তী ১০ দিন লন্ডন, এডিনবরা, কার্ডিফ ও বেলফাস্টে বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা পালন করা হবে। রানির রাষ্ট্রীয় শেষকৃত্যে তিনি যেসব দেশের (যেমন অস্ট্রেলিয়া, কানাডা) রানি ছিলেন, সেসব দেশের নেতারা, বিশ্বের অন্যান্য রাজপরিবারের প্রতিনিধিরা এবং অন্যান্য দেশের সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানেরা অংশ নেবেন বলে আশা করা হচ্ছে।

রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ছিলেন বিশ্বের সর্বাধিক পরিচিত রাজতন্ত্রের প্রতিভূ। ৭০ বছর রাজকার্য পরিচালনা করেন তিনি। মাত্র ২৫ বছর বয়সে ব্রিটিশ রাজত্বের দায়িত্ব গ্রহণকারী রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের ৭০ বছরের রাজকার্য পরিচালনার অনন্য ইতিহাসের ইতি ঘটেছে। যুক্তরাজ্যে তাঁর মতো দীর্ঘ সময় সিংহাসনে আসীন থাকার রেকর্ড আর কারও নেই। ৯৬ বছর বয়সে রাজকার্য পরিচালনাও একটি বিরল ঘটনা। যুক্তরাজ্য ছাড়াও তিনি ছিলেন ১৪টি দেশ ও অঞ্চলের রানি। তিনি ৫৪ সদস্যের জোট কমনওয়েলথের প্রধান, যে দেশগুলোর অধিকাংশই অতীতে ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল। এককথায় রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ছিলেন বিশ্বের সর্বাধিক পরিচিত রাজতন্ত্রের প্রতিভূ।

গ্রেট ব্রিটেনের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় সিংহাসন অলংকৃত করেছেন এই রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ। বৃহস্পতিবার স্কটল্যান্ডের বালমোরাল প্যালেসে ৯৬ বছর বয়সে রাজ সিংহাসন এর মায়া ত্যাগ করে তিনি না ফেরার দেশে চলে গেলেন। ব্রিটেনের রাজতন্ত্রের উত্থান–পতনের সাক্ষী ছিলেন রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ। বর্ণাঢ্য ছিল তাঁর জীবন।

Photo Credit- Pixabay.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *