গপলুর চালাকি (রাজস্থানের উপকথা)

পিনাকী রঞ্জন পাল

পাঁচ বন্ধু ছিল—চিক্কী ইঁদুর, মিক্কী হুলো বেড়াল, গপলু শিয়াল, শফলু হায়না, আর চিতরু নেকড়ে বাঘ। পাঁচজনে মিলেমিশে শিকার করত এবং তা ভাগাভাগি করে খেত।

একদিন ভোরে রাতে পাঁচ বন্ধু বসে বসে শিকারের কৌশল ঠিক করেছিল। এমন সময় সামনে দিয়ে একটি হরিণ দৌড়ে চলে গেল। ব্যস, আর কি চাই। পাঁচজনেই হরিণের পিছু ধাওয়া করতে লাগল। ছুটছে তো ছুটছেই, কিন্তু হরিণকে ধরা যাচ্ছে না। ছুটতে ছুটতে সবাই যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ল তখন গপলু বলল ‘আরে এভাবে ছুটে কোন লাভ হবে না। হরিণ আমাদের সবার চেয়ে দ্রুত ছুটতে পারে। তাই চালাকির মাধ্যমেই একমাত্র ওকে মারা যেতে পারে। শোন টিঙ্কী, তুই এক কাজ কর, হরিণ যখন ক্লান্ত হয়ে কোন গাছের নিচে বিশ্রাম করবে তখন তুই আস্তে করে গিয়ে ওর পায়ের শিরাগুলো কেটে দিবি। তবেই হরিণ খতম হয়ে যাবে।

দৌড়-ঝাঁপ শেষ হলে হরিণ এক ঝোপের ছায়াতে বসে বিশ্রাম করতে লাগল। ক্লান্ত থাকায় শীঘ্রই ওকে ঘুম জড়িয়ে ধরল। সুযোগ বুঝে টিক্কী ধীরে ধীরে ঘুমন্ত হরিণের পায়ের সমস্ত শিরা দাঁত দিয়ে কেটে ফেলল। এবার হরিণের পক্ষে দৌড়ান তো দুরের কথা দাড়িয়ে থাকাও অসম্ভব হয়ে পড়ল। তাই পাঁচজনকে দেখে ছুটে পালাতে গিয়ে দড়াম করে পড়ে গেল। আর পাঁচজনে মিলে তাকে চেপে ধরল।

পাঁচ বন্ধুর মধ্যে গপলু ছিল অত্যধিক লোভী আর চালাক। হরিণের টাটকা সুস্বাদু মাংস খাবার জন্য ওর লোভী মন নেচে উঠল। হরিণের মাংস কি করে একা খাওয়া যায় ও সেই কৌশল মনে মনে ভাঁজতে লাগল। সকলে যখন মাংসের ওপর হামলে পড়তে যাচ্ছে তখন গপলু বলল, এইভাবে কেন তোরা ক্ষুধার্তের মত ঝাঁপিয়ে পড়ছিস ? যেন কখনও মাংস খাসনি। আমি তো সকালে স্নান করেই এসেছিলাম। যা তোরাও সবাই গিয়ে স্নান করে আয়, নিত্যকার নিয়ম ভাঙলে পাপ হয়। তারপর সবাই মিলে একে খাবো।

গপলুকে মাংসের পাহারায় রেখে সবাই স্নানের জন্য জলাশয়ের খোঁজে বেরিয়ে পড়ে। সবার আগে চিতরু নেকড়ে স্নান সেরে ফিরে এসে দেখে গপলু উদাসভাবে চুপচাপ মৃত হরিণের ওপর নিজের মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে। চিতরু জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে গপলু, এমন উদাসভাবে বসে আছিল কেন ?

মুখে কৃত্রিম দুঃখ ফুটিয়ে গপলু বলে, আরে উদাস হব না তো কি খুশি হব। বন্ধুত্বের মধ্যেও তোর-আমার করি আমরা। এই মাত্র টিঙ্কী বলছিল যে, শিকার ও করেছে আর খাওয়ার জন্য সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। চিতরু নেকড়ের মত শক্তিশালী জীব ও আমার নির্ভরশীল হয়ে থাকে পেট ভরাবার জন্য।

কথা শুনে চিতরু নিজেকে অপমানিত বোধ করতে থাকে এবং নিজের ক্ষমতা প্রমাণ করে দেওয়ার জন্য ও বলল, এখন তো আমি নিজের হাতে করা শিকারকেই খাব। টিঙ্কীর কি সামর্থ্য যে ও আমার পেট ভরাবে। আর এ কথা বলে চিতরু ওই মরা হরিণকে একবারও না দেখেই সেখান থেকে চলে গেল।

এরপর শফলু হায়না স্নান করে এসে গপলুকে এভাবে বসে থাকতে দেখে বলল, এভাবে উদাস মুখে বসে আছিস কেন?

গপলু বলে, আমাদের আসন্ন দুঃখের দিনগুলির কথাই ভাবছি বসে বসে। তোদের তো । বুঝিয়ে বুঝিয়ে হেরে গেছি। কতবার না বলেছি নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করিস না, বাজে কথা বলিস না। কিন্তু কেউ শুনবে সে কথা! তুই চিতরুকে কি খারাপ কথা বলেছিস ? ও তোর ওপর খুব ক্ষিপ্ত হয়ে এসেছিল। তোদের এতো ঝগড়া কিসের ? সুমতিতেই সমস্ত সুখ বুঝলি। চিতরু তো তোকে মেরে ফেলতে চায়। বল এরপরেও আমি কি করে খুশি থাকি ?

এতটা শুনেই শফলু ভয়ে কেঁপে ওঠে দৌড় লাগাল। একবারও পেছনে ফিরে দেখল না।

ততক্ষণে মিক্কী হুলো বেড়াল স্নান সেরে ফিরে এসেছিল। গপলু তো সঙ সেজে বসেই ছিল। তা দেখে মিক্কী জিজ্ঞেস করল, মনের মত শিকার পাবার পরেও তুই এরকম নিরাশ মুখে বসে আছিস কেন?

রুদ্ধ কণ্ঠে গপলু বলল, আজ যে ভয়ানক ঘটনা ঘটে গেছে তার পরেও তুই এই সামান্য শিকারের কথা বলতে পারলি। অমাবস্যার কালো রাতে আমরা এই অসহায় হরিণকে হত্যা করেছি। ভেবে দ্যাখ কত পাপ হবে! চিতরু আর শফলু তো গেছে পাপ ধোওয়ার জন্য। তুই খেলে খা, আমিও প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য যেতে চাই। তুই পাহারা দে এই হরিণকে, আমি গেলাম….. বলে গপলু চলে যেতে উদ্যত হয়।

গপলুকে চলে যেতে দেখে মিক্কী বেড়াল বলে, যখন তুইও প্রায়শ্চিত্ত করতে যাচ্ছিস তখন আমি কেন একা শুধু এই পাপের বোঝা বইব। তাই আমি তোর আগেই চললাম। বলে ও ছুটে সেখান থেকে চলে গেল।

সবশেষে স্নান করে ফিরল টিঙ্কী ইঁদুর। গপলুকে বলে, কিরে, উদাস কেন তুই ? আমার তো ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছে।

গপলু বলে, ক্ষিদে পেয়েছে বুঝি ? কিন্তু আমি যে তোর ওপর ভীষণ রেগে আছি। কতবার না তোকে বলেছি এসব করিস না, তবুও তুই শুনিস না। জানি না বাবা, কেন তোর মুখ সবসময় কোন কিছু কাটার জন্য ব্যস্ত থাকে। তুই মিক্কীর গোঁফ কেটেছিস কেন? ও এখন তোকে ছাড়বে না। তোকেই খুঁজতে বেরিয়েছে। এই পর্যন্ত শুনেই টিঙ্কীর প্রচণ্ড ভয় হল। ও আর এক মুহূর্তও সেখানে দাঁড়াল না।

এইভাবে বন্ধুদের সঙ্গে প্রতারণা করে নিশ্চিন্ত মনে আয়েশ করে একাই সম্পূর্ণ হরিণটাকে খেয়ে ফেলল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *