অরুণ কুমার : বিধানসভা নির্বাচনের পরপরই ঠিক হয়েছিল তিনি আসবেন পশ্চিমবঙ্গের সফরে। কিন্তু সেই সময় পরিস্থিতি এবং অন্যান্য কারণে সফর বাতিল হয়েছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের। যখনই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজ্য সফরে আসেন তখন একদিকে কেন্দ্র ও রাজ্য প্রশাসন এবং কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন ও রাজ্যের বিরোধীদলের তৎপরতা আরম্ভ হয়ে যায়, সাজো সাজো রব আরম্ভ হয়ে যায়। অনেক না বলা কথা, জমিয়ে রাখা ইস্যুগুলো তুলে ধরার প্রক্রিয়া আরম্ভ হয়ে যায় বিরোধী দলের নেতৃবৃন্দের মধ্যে। গতবার সেরকম হলেও এবার সেই চেষ্টা দেখা দিয়েছে রাজ্যের বিরোধী দলের নেতৃবৃন্দের মধ্যে। রাজ্যে নানারকম ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে তারাও ইতিমধ্যেই হোমওয়ার্ক করতে আরম্ভ করে দিয়েছেন কি বলবেন তারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে।
জানা গেছে, সীমান্ত এলাকায় গোরু পাচার রুখতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর হস্তক্ষেপের দাবী জানাবে বিজেপি। আগামী ৫ই মে উত্তরবঙ্গ সফরে আসছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ। এই সফরে তিনি সরকারি ও দলীয় কাজে অংশগ্রহণ করবেন। সফরে শিলিগুড়িতে রাত কাটানোর কথা রয়েছে অমিত শাহের। পাশাপাশি শিলিগুড়িতে একটি দলীয় কর্মসূচি ছাড়াও তিনি যাবেন কোচবিহারের বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী তিনবিঘা করিডর পরিদর্শনে৷
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রের খবর, আসার আগে গত কয়েক মাসে হইচই ফেলা রাজ্যের বিভিন্ন ঘটনার বিস্তারিত রিপোর্ট খতিয়ে দেখছেন তিনি। যার তালিকায় রয়েছে উলুবেড়িয়ার ছাত্রনেতা আনিস খানের মৃত্যুর ঘটনা। রয়েছে হাঁসখালিতে নাবালিকাকে ধর্ষণ ও মৃত্যু, পানিহাটির তৃণমূল কাউন্সিলর অনুপম দত্ত খুন এবং ঝালদার কংগ্রেস কাউন্সিলর তপন কান্দুর খুনের মতো ঘটনাও।বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বীরভূমে রামপুরহাটের বগটুই গ্রামে অগ্নিদগ্ধ হয়ে ১০ জনের মৃত্যুর ঘটনাকেও।
উল্লেখ করা যেতে পারে যে, আনিস ও অনুপমের মৃত্যু ছাড়া আদালতের নির্দেশে বাকি সব ঘটনার তদন্ত করছে সিবিআই। তাতেও সেই সমস্ত ঘটনাকে লঘু করে দেখতে নারাজ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক। সব ক’টি ঘটনায় পুলিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ উঠেছে। কোথাও পুলিশকেই সরাসরি দায়ী করেছে নিহতদের পরিবার। সূত্রের খবর, এই বিষয়গুলির উপর আলোকপাত করেই দিল্লি থেকে এই ঘটনাপ্রবাহ প্রসঙ্গে বিস্তারিত রিপোর্ট তলব করা হয়েছিল। সূত্রের খবর, ইতিমধ্যে এই সমস্ত ঘটনার রিপোর্ট পশ্চিমবঙ্গ থেকে জমা পড়ে গেছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকে। সাধারণ ভাবে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন কোনও রাজ্যে যান, তখন সংশ্লিষ্ট রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত রিপোর্ট তলব করে থাকে দিল্লির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। এ ক্ষেত্রেও সেই নিয়ম মেনে কাজ হয়েছে। তবে, গত কয়েক মাসে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে এ রাজ্যে, যা অতিরিক্ত উদ্বেগের বলে মনে করছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। তাই ওই সমস্ত ঘটনা প্রসঙ্গে পৃথক রিপোর্ট তৈরি করে পেশ করা হয়েছে শাহের কাছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উত্তরবঙ্গ সফরে এই বিষয়গুলি নিঃসন্দেহে গুরুত্ব পাবে বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।
অপরদিকে ,স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উত্তরবঙ্গ সফর নিয়ে যথেষ্ট আশাবাদী বঙ্গ বিজেপি শিবির। দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের উত্তরবঙ্গ সফরকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যে শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার জেলার বিজেপি দপ্তরে বৈঠকের পর বৈঠক হয়েছে। যেখানে অমিত শাহের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কিভাবে কতজন বিজেপি কর্মী সমর্থক যাবেন তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে বিভিন্ন জেলা বিজেপির নেতৃত্ব সূত্রে জানা গেছে। তাঁরা জানিয়েছেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে খোলা সীমান্তে কাঁটাতার সহ এলাকার উন্নয়ন, গোরু পাচার বন্ধ করা সহ সীমান্তের বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরার পাশাপাশি রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি সরকারের হস্তক্ষেপ প্রভৃতি বিষয়ে স্মারকলিপি দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে।
উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ২০২১ এর বিধানসভা নির্বাচনের পর প্রথমবার যদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই পশ্চিমবঙ্গে আসতেন তখন নিঃসন্দেহে তাঁর এই সফর যথেষ্টই তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। সেইসময় সংসদে দাঁড়িয়ে বিস্ফোরক মন্তব্য করে অমিত শাহ বলেছিলেন, ‘ফ্যাসিস্ট শব্দের নতুন সংজ্ঞা তৈরি হয়েছে বাংলায়।’ এমনকী বাংলায় গেলে তিনি খুন হয়ে যেতে পারেন এই আশঙ্কাও প্রকাশ করেছিলেন। বাংলায় যখন আইন- শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উত্তপ্ত পরিস্থিতি, তখন বলাই বাহুল্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলায় এলে তৃণমূলকে নিশানা করতেন। স্বাভাবিকভাবেই আবার কবে অমিত শাহের সফর হবে, সেদিকেই নজর ছিল রাজনৈতিক মহলের।
২০২১ সালে বিধানসভা নির্বাচনের আগে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে নানা কর্মসূচিতে যোগ দিয়ে অমিত শাহ তৃণমূলকে উৎখাতের ডাক দিয়েছিলেন। বিজেপি নেতাকর্মীদের ২০০ আসন জয়ের লক্ষ্যমাত্রাও স্থির করে দিয়েছিলেন তিনি। তবে ভোটের ফল প্রকাশের পর দেখা যায় অমিত শাহ তথা বিজেপির স্বপ্ন চুরমার করে তৃতীয় বারের জন্য বিপুল সংখ্যা গরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে তৃণমূল। বিধানসভা নির্বাচনে ‘অপ্রত্যাশিত’ পরাজয়ের পরেই বাংলায় আসার কথা ছিল অমিতের। বাংলায় এসে কলকাতা তিনটি বৈঠক করার কথা ছিল তাঁর। এমনকী বিজেপি সূত্রে জানা গিয়েছিল, দলের সমস্ত নির্বাচিত বিধায়কদের সঙ্গেও বৈঠক করবেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। পাশাপাশি বাংলায় দলের হেভিওয়েট নেতাদের সঙ্গেও পৃথক বৈঠক করবেন তিনি, এমনটাই শোনা গিয়েছিল। সেই বৈঠকগুলি থেকে তাৎপর্যপূর্ণ বার্তা দেবেন, এমনটাই মনে করা হয়েছিল। তবে শাহের সফর স্থগিত হয়ে যাওয়ার
সেইসময় যাবতীয় কর্মসূচি বাতিল হয়ে গিয়েছিল।
এবার যখন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একুশের নির্বাচনের পর প্রথম এই রাজ্যে সফরে আসছেন তখন একের পর এক ধর্ষণের ঘটনায় বাংলার রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে উত্তপ্ত। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিশানা করে বারবার সুর চড়াচ্ছে বিজেপি সহ অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি। এমনকী অনেকেই বাংলায় ৩৫৬ ধারা প্রয়োগের দাবি জানিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্রধান সেনাপতি অমিত শাহের বাংলা সফরের কথা মাথায় রেখে প্রস্তুতিও শুরু করে দিয়েছে বঙ্গ বিজেপি। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, এখন দেখার বিষয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্বাচন পরবর্তী সময়ে প্রথম পশ্চিমবঙ্গ সফরে বিজেপির বঙ্গ ব্রিগেড কতটা নিজেকে ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে তৎপর হতে পারছে। রাজ্য বিজেপি নেতৃত্ব যখন একে অপরের দিকে কাঁদা ছুঁড়তে ব্যস্ত। দলের অনেক পুরনো নেতা কর্মীরা নিষ্ক্রিয় হয়ে ঘরে বসে আছেন জেলা নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ক্ষোভ তাদের ক্রমশ বাড়ছে। দুই প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি ও বর্তমান সভাপতি
এবং সেই সঙ্গে বিরোধী দলনেতার মধ্যে সমন্বয়ের
ক্ষেত্রে এই সফর কতটা ফলপ্রসূ হবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজ্য সফরে আগামী দিনে এটাই হল লাখ টাকার প্রশ্ন রাজ্যবাসীর কাছে।