ক্ষুধা, অসহায়তা আর মাতৃত্বের ভয়াল যুদ্ধ… শালবাগান থেকে শহর, ভাত-দুধের জন্য এক মায়ের করুণ সংগ্রাম। পড়ুন পিনাকী রঞ্জন পালের এই হৃদয়বিদারক মানবিক গল্প, যা চোখে জল আনবেই।
শালবাগান। নাম শুনলে মনে হয় শালগাছের ছায়ায় ঘেরা সবুজ গ্রাম। কিন্তু বাস্তবতা তার উল্টো – একটা ধূসর, রুক্ষ, খরাপীড়িত জনপদ। এই গ্রামে বর্ষা আসে প্লাবন নিয়ে, রাজনীতি আসে শুধুই ভোটের ঠিক আগের রাতে। আর মানুষ? তারা আসে আর যায় – ক্ষুধার ছায়ায় ঢেকে যাওয়া জীবনের দিকে তাকিয়ে।
এই গ্রামেরই মেয়ে গৌরী সাহা। গায়ের রং মাটির মতোই ম্লান, চোখ দু’টি যেন অচেনা এক নদীর নীরব ব্যথা বহন করে। দশ বছর বয়সে মা হারায়, আর ষোলোতেই বিয়ের সাজে বসে – যেখানে মেয়েদের নিজের জীবন বেছে নেওয়ার কোনো অধিকার নেই।
স্বামী বিরেন সাহা – একজন রিকশাওয়ালা। ভালোবাসা ছিল, কিন্তু সামর্থ্য ছিল না। জীবন তাকে বারবার পরাজিত করেছে। হঠাৎ একদিন শরীরে ধরা পড়ে ক্যানসার। জীবিকার চাকা থেমে যায়। বিছানাই হয়ে ওঠে বিরেনের ঠিকানা।
গৌরীর কোলজুড়ে আসে সদ্যোজাত শুভ। ক্ষুধায় কাঁদে, মা বললেই হাসে। সেই মুখ দেখে প্রতিদিন গৌরীর মনে হয় – “যতদিন আমি আছি, ও না খেয়ে থাকবে না।” কিন্তু কথাগুলো যে কথার মধ্যেই আটকে থাকে।
বাড়ি বলতে বাঁশ, পলিথিন আর ভাঙা কুঠুরির মতো একটা ঘর। সন্ধ্যা নামলেই বৃষ্টির শব্দ পলিথিনে চিৎকার করে ওঠে, ভিতরে বিরেন কাশে – চাপা, ভেজা কাশি। গৌরী শুভকে কোলে নিয়ে বাইরে যায় – বাসন্তীর বাড়ি। বাসন্তী এখন শহরে কাজ করে, একটু আধুনিক, একটু কড়া।
“তুইও শহরে যা। সুন্দরীরা হোটেলেও কামায়… লোকে মুখ দেখে রে, গৌরী,” – বলে বাসন্তী, একগাল বাস্তবতার চেহারা।
গৌরী হাসে না। চুপ করে শুভকে জড়িয়ে ধরে। খালি কৌটোয় বাসন্তী কিছু চিড়া আর চিনি দেয়।
“বাচ্চাটা কি না খেয়ে মরবে, গৌরী?”
সে কিছু বলে না। হাঁটতে হাঁটতে ফিরতে ফিরতে তার পায়ের নিচে শুধু ধুলো, আর মনজুড়ে চুপচাপ অন্ধকার।
পরদিন সকালে গৌরী ঠিক করে – এবার সে বিডিও অফিসে যাবে। শুনেছে নতুন কোনো ‘মাতৃত্ব সহায়তা যোজনা’ এসেছে। একটু দুধ, সামান্য চাল-পয়সা মিলবে যদি…
বিরেন বলে, “কিছু হবে না। তারা শুধু ফর্ম নেয়, ফিরিয়ে দেয়।”
তবু, গৌরী থামে না। শুভকে আঁচলে জড়িয়ে ছ’কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে যায় বিডিও অফিসে। অফিসে বসে সদ্য কলেজ পাস করা মৃণাল – টাইপ মেশিনের ঠকঠক শব্দ আর মোবাইল স্ক্রলের মাঝে আটকে থাকা আধা-কর্মঠ সরকারি যুবক।
“রেশনকার্ড?”
“নেই, দাদা।”
“ঠিকানা প্রমাণ? ছবি? অ্যাকাউন্ট?”
“শুধু খেতে চাই, দাদা… ছেলেটা কাঁদছে।”
মৃণাল ক্লান্ত গলায় বলে, “সব কাগজ ঠিকঠাক থাকলে পরে দেখা যাবে।”
“পরে দেখা যাবে” – এই চারটে শব্দ যেন গৌরীর বুক ছিঁড়ে বেরোয়। কিন্তু সে চিৎকার করে না। শুধু চুপচাপ বেরিয়ে আসে।
ফেরার পথে একটা সরকারি স্কুলে উঁকি দেয়। বাচ্চারা মিড ডে মিল খাচ্ছে – ভাত, ডাল আর আলুভাজা। শুভ ক্ষুধায় কেঁদে ওঠে।
“একটু ভাত, দিদি?” – বলে গৌরী এক শিক্ষিকাকে।
“এটা কি রাস্তার ভিখারিদের জায়গা?” – ধমক আসে মুখে।
গৌরী ফিরে আসে। বাসন্তীকে দেখে বলে, “ফর্ম আছে, ভাত নেই।”
সেই রাতে ঘরে ভাত নেই, দুধ নেই, শুধু নিঃশব্দ একটা কান্না – শিশুর না, একটা নিরুপায় মায়ের।
একদিন, এক নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে, গৌরী শুভকে বুক থেকে নামিয়ে দেয় – ঠিক সেই মুহূর্তে একটা গলা চিৎকার করে ওঠে – “ও মা, কী করছো!”
মানুষ ছুটে আসে। শুভ উদ্ধার হয়। গৌরী চুপ। শুধু ফিসফিস করে বলে, “ওকে দুধ খাওয়াও… ওর গলা শুকিয়ে গেছে।”

শালবাগানের বর্ষা মানে কেবল জল নয়, মানে গলে যাওয়া স্বপ্ন, ভেসে যাওয়া ঘর আর থমকে যাওয়া ক্ষুধার আর্তনাদ।
পলিথিনের ছাউনিতে ঠকঠক করে পড়ে বৃষ্টি। গৌরী জানে, ভিজে উঠবে চাল-ডাল, নরম হয়ে যাবে দেওয়ালের মাটির প্রলেপ। কিন্তু তার ভয়ের আসল জায়গা শুভ। দিন দুয়েক ধরে ওর গায়ে জ্বর, পেটটা ফুলে উঠছে অদ্ভুতভাবে। বাসন্তী বলেছে, “পুষ্টিহীনতায় এমন হয়… ডাক্তার দেখাতে হবে।”
কিন্তু কী নিয়ে যাবে সে ওকে? দু’মুঠো চাল, না একটা শিশুর হাত?
সেই রাতেই, শুভ চিৎকার করে ওঠে। খিদে না জ্বর – গৌরী বুঝে না। তার বুকের দুধ শুকিয়ে গেছে বহুদিন, দোকানের দুধের দাম শুনলেই মাথা ঝিমঝিম করে। শরীরেও নেই আর জোর, চোখের পাতা ভারি হয়ে আসে কান্না না কাঁদেই।
ভোরবেলা বাসন্তীকে ডাকে গৌরী – “তুই বলেছিলি, শহরে কাজ আছে, না? তুই নিয়ে যা আমায়। শুভকে রেখে যাব না। যেখানেই যাব, ওকে নিয়ে যাব।”
বাসন্তী থমকে যায়। এতদিন ধরে বলেছে, আজ গৌরী বলছে! “শহরে কাজ মানে সোজা নয় রে। বাসন মাজা, বাজার করা, কেউ কেউ খারাপ কিছু চাইতেও পারে… সব সহ্য করতে পারবি?”
গৌরী একবার চোখ মেলে শুভর দিকে চায়।
“আমি ক্ষুধা সহ্য করতে পারছি না। বাকিটা করে দেখবো।”
সেই দিন বিকেলেই দু’জন রওনা দেয় শহরের দিকে। সাইকেলভ্যানে চেপে, কাঁদতে থাকা শিশুটিকে আঁচলে জড়িয়ে, মাথায় একটা পুরনো ব্যাগ। মফস্বলের সীমা পেরিয়ে যত শহরের দিকে এগোয়, গৌরীর চোখে নতুন আলো না হয়ে কেবল ঘোলা ধোঁয়া নামে।
শহর মানে আশ্রয় নয়, শহর মানে লড়াই। বাসন্তী যাদের জানে, সেই এক মধ্যবিত্ত পরিবারের রান্নাঘরের কাজ জোটে। সকাল সাতটা থেকে রাত আটটা। খাওয়া একবার, মজুরি সামান্য, ঘুম – শুধু গ্যারেজ ঘরের এক কোণে। শুভকে সঙ্গে রাখা যাবে না, তাই বাসন্তীর এক আত্মীয়ের কাছে রেখেই কাজে নামতে হয়।
প্রথম দিনেই বুঝে যায় গৌরী – এই শহরে কেউ কারও মা নয়, কেউ কারও সন্তান নয়। এখানে শুধু দামের খেলা, ঘাম দিয়ে টাকা কেনা আর সম্মান হারানোর আগে কাজের তালিকা ঠিক করে ফেলা।
তিন দিন কেটে যায়। শুভ ভালো নেই। বাসন্তীর আত্মীয় রমা বলল, “এভাবে আর রাখা যাবে না, গৌরী। ওর তো ওষুধ লাগবে। এ বাড়িতে এমন কান্নাকাটি করলে আমি পারবো না।”
গৌরী কী করবে বুঝে ওঠে না। নিজের কাজের জায়গায় নিতে পারে না, ফেরত নিতে গেলে শালবাগানে যেতে হবে – সেই পথে আবার খরচ।
চতুর্থ দিন রাতে গৌরী যখন রান্নাঘরে ভাত চড়িয়ে বসে, তখন হঠাৎ তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে শুভর কান্না ভেজা চোখ, আর সেই প্রশ্ন -“আজ কি খাবে কিছু?”
সেই রাতে, ভাত হয়ে গেলে সে একটা প্যাকেটে সামান্য তুলে নেয়। অনেকক্ষণ ধরে ভাবে – এই ভাতটা ওকে খাওয়াবে সকালে। কিন্তু সকালে ফোন আসে – “গৌরী, তোর ছেলেটার শরীর খারাপ। কাল রাত থেকে বমি করছে।”
অন্য কিছু না ভেবেই ছুটে যায় সে। শুভকে কোলে তুলে নেয় গৌরী – ওর শরীর গরম, চোখ কোটরে ঢুকে গেছে। তখন আর কোনো যুক্তি থাকে না, কোনো লজ্জাও না। পথের ধারে বসে থাকা এক হকারের থেকে এক কাপ দুধ চায় সে।
“আন্টি, একটু দুধ দেবেন? টাকা পরে দেব…”
হকার মুচকি হেসে বলে, “মাফ করবেন, আমরা ভিখারি নই, দোকানি। এখানে বাকিতে দুধ চলে না।”
গৌরী চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। তখনই হঠাৎ হাত ধরে টান দেয় শুভ – চোখ বুজে গেছে, মুখ হালকা নীলচে।
রাস্তায় তখন কোলাহল – গাড়িঘোড়া, লোক, বাজারের ডাকে হারিয়ে যায় এক মায়ের কান্না।
হাসপাতাল। নামটা খুব বড়, কিন্তু দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কেবল একটাই শব্দ – ‘ইমারজেন্সি’। গৌরী কাঁপা হাতে নিয়ে আসে শুভকে। নার্স বলে, “কার্ড আছে? ফর্ম ফিলআপ?”
“আমার বাচ্চাটা মরছে… পরে করব…”
“নিয়ম মানতেই হবে, আগে কার্ড…”
এক তরুণ ডাক্তার এগিয়ে আসেন – নামপ্লেটের উপর লেখা Dr. Avishek Ray। চোখে ক্লান্তি, কিন্তু কণ্ঠে স্নিগ্ধতা।
“দাও ওকে, আমি দেখি।”
শুভকে নিয়ে যান, স্ট্রেচারে শুইয়ে দেন, নার্স স্যালাইন লাগায়। গৌরী দরজার বাইরে বসে থাকে। বুক কাঁপে, পা জমে যায়। তার মনে পড়ে – শুধু এক মুঠো ভাত, এক চুমুক দুধের জন্য শিশুটি কেঁদেছে।
আড়াই ঘণ্টা পর, ডাক্তার এসে বলে, “বাচ্চাটার অবস্থা ক্রিটিক্যাল, পুষ্টিহীনতা, ডিহাইড্রেশন… আমরা চেষ্টা করছি।”
গৌরীর মনে হয়, সবকিছু ঘুরছে। সে চেয়ারে বসে মাথা নিচু করে। হঠাৎ তার মনে পড়ে, বিরেনের শেষ কথাটা – “তুই যদি খাওয়াতে না পারিস, আমি মরেও শান্তি পাবো না…”
সে ভাবে, এই সমাজে কি আদৌ একজন মা হয়ে বাঁচা যায়?
বাইরে তখন বৃষ্টি শুরু হয়। জানালার কাঁচে টুপটাপ শব্দ—একটা শহরের ভিতর আরেকটা পৃথিবীর কান্না।
হাসপাতালের করিডোরে সেই রাতটা কেবল গৌরীর, আর শুভর। রাত এগারোটা বাজে – বাইরে ঝিরঝিরে বৃষ্টি। আকাশে চাঁদ নেই, শুধু বাষ্পে ঢাকা কিছু আলো, আর এক নিঃশব্দ ব্যথা।
ভিতরের ঘর থেকে স্যালাইনের ফোঁটা ফোঁটা শব্দ আসছে। শুভ নিঃসাড়। তার মুখে অক্সিজেন মাস্ক, শরীরটা কুঁকড়ে গেছে।
গৌরী দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে। চোখে জল নেই, শুকিয়ে গেছে আগেই। সে জানে, শহরটা তার নয়। হাসপাতালে থাকা এই আলোও তার জন্য নয়। কেবল শুভ – ওইটুকু মুখ – যেটা দেখে ওর সকাল হতো, ক্ষুধার মধ্যেও যে মুখে হাত বুলিয়ে সে স্বপ্ন দেখত।
হঠাৎই একজন নার্স ছুটে আসে – “আপনি গৌরী? বাচ্চার মা?”
সে মাথা নাড়ায়।
“ডাক্তার বলছেন, ভেতরে আসুন।”
ভেতরে গিয়ে দেখে শুভর গায়ে কম্বল ঢাকা। ডাক্তার অভিষেক মুখ নিচু করে বললেন, “ও আর নেই…”
গৌরী যেন শুনেও শুনল না। চোখ ঘুরিয়ে শুভর মুখের দিকে তাকায়। চোখ বুজে আছে, শান্ত, কষ্টহীন। এক মুহূর্তে একটা শব্দ বুকের মধ্যে গুঁড়ি মেরে ওঠে – “মা…”
না, বলেনি শুভ কিছু। কিন্তু গৌরী শুনেছে। হয়তো অন্তরে। অথবা নিজের অপরাধে। সে এগিয়ে গিয়ে কোলে তুলে নেয় ছেলেটাকে। মুখে চুমু খায়। ঠাণ্ডা ঠোঁট। নিঃশব্দ। তারপর ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকে বাইরে।
ডাক্তার পেছন থেকে ডাকেন, “গৌরীদেবী, ডেথ সার্টিফিকেট, ফর্ম ফিলআপ…”
সে কিছু শোনে না। শুধু হাঁটে। বৃষ্টি আর শহরের আলো তাকে পথ দেখায় না, তার চোখেই আজ ছায়া নামে। একটা মৃত শিশু আর এক জীবন্ত মৃতা – একটা শহর তাদের দেখে, কিন্তু কিছুই করে না।
পরদিন সংবাদপত্রের ছোট্ট কলাম : “এক ভিখারিণী মায়ের কোলে শিশুর মৃত্যু, শহরের ব্যস্ত রাস্তার ধারে। কারও চোখে জল ছিল না, কেবল গলে যাওয়া ভাতের গন্ধে মিশে গিয়েছিল বিষের ছোঁয়া। তদন্ত চলছে।”
শেষ

ছবি এআই
© পিনাকী রঞ্জন পাল