আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবসে কিছু কথা কিছু দায়বদ্ধতা

অরুণ কুমার : আজ আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস বা বিশ্ব নৃত্য দিবস। নৃত্য হচ্ছে মানুষের মনোজাগতিক প্রকাশভঙ্গি। কেননা, নৃত্য ও এর ভাষা কাজ করে একসূত্রে। সারা বিশ্বে প্রতিবছরের মতো ২৯ এপ্রিল দিনটি নানা বিভিন্ন উৎসব- অনুষ্ঠান আয়োজনের মধ্য দিয়ে দিনটি পালিত হয়। দিবসটি উদ্‌যাপন করা হয় ব্যালে নৃত্যের স্রষ্টা জ্যঁ জর্জ নভেরের জন্মদিন উপলক্ষে।

নৃত্য বিশেষজ্ঞদের মতে, এই নৃত্য বা নাচ হলো মানসিক এবং শারীরিকভাবে সুস্থ থাকার জন্য‌ অন্যতম থেরাপি এবং ব্যায়াম। ভারতীয় ধ্রুপদী নৃত্য’ বা ‘শাস্ত্রীয় দেবেশ’, হল বৃহত্তর শব্দ, যার মূলে রয়েছে বিভিন্ন পরিবেশন শিল্পকলার জন্য হিন্দু ধর্মীয় নৃত্য গীতের নাট্যশালার শৈলী, যার তত্ত্ব ও অনুশীলন সংস্কৃত পাঠ নাট্য শাস্ত্র -এ পাওয়া যায়। আমরা জানি যেকোনো দেশের মানুষের এগিয়ে যাওয়ার পেছনে প্রেরণা রূপে কাজ করে সে দেশের সংস্কৃতি। সংস্কৃতির মাধ্যমেই মানুষ বৃহৎ পরিসরে নিজেকে মেলে ধরতে পারে। সংস্কৃতির মধ্য দিয়েই একজন মানুষের যেমন, তেমনি একটি জাতির রুচিবোধেরও পরিচয় মেলে। সংস্কৃতিচর্চার মধ্য দিয়েই তৈরি হয় সংহতি, সহমর্মিতা, ভ্রাতৃত্ববোধ, সহযোগিতার বন্ধন।

সব সংস্কৃতির আদি জননী হচ্ছে নাচ বা নৃত্য। নাচ সাংস্কৃতিক শিক্ষার অন্যতম মাধ্যম। ফলে গবেষণা ও শিক্ষার উপাদান হিসেবে সারা বিশ্বেই নাচের জনপ্রিয়তা রয়েছে। নাচ মানুষের মেধা ও মননকে বিকশিত করে। নাচে দেহভঙ্গিমার মাধ্যমে শৈল্পিকভাবে পার্থিব ও অপার্থিব সব ভাবকে মানুষ প্রকাশের সুযোগ পায়। এই প্রকাশভঙ্গিতে থাকে গতি ও ছন্দ। সেই গতি ও ছন্দের তালে তালে ফুটে ওঠে প্রেম, ভালোবাসা, রাগ, অনুরাগ, প্রতিবাদ। সমাজ কিংবা গল্প-ইতিহাসের কথাও নাচের মাধ্যমে উঠে আসে। নাচের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা যায় জীবনের কথা, চাওয়া-পাওয়া বা না-পাওয়ার কথা। সব মিলিয়ে নাচ শুধু বিনোদনমাত্র নয়, নাচ জীবনের প্রতিবিম্বও। নৃত্য হচ্ছে মানুষের মনোজাগতিক প্রকাশভঙ্গি। কলা তথ্য থেকে রসতত্ত্ব ও সৃষ্টিতত্ত্বর নান্দনিক আঙ্গিক প্রকাশ মাধ্যমের ভাবনাতত্বক উপস্থাপনা হল এই নৃত্য।

উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ব্যালে নৃত্যের স্রষ্টা জ্যঁ জস নুভেরের জন্মদিনে দিবসটি উদযাপিত হয়ে‌ থাকে এই শিল্পীকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য ১৯৮২ সালে ইউনেস্কো ২৯ এপ্রিলকে আন্তর্জাতিক নৃত্যদিবস নির্ধারণ করে। সুর ও ছন্দের সঙ্গে হস্তমুদ্রা, পদসঞ্চালন ও অঙ্গভঙ্গিমা দ্বারা মনের ভাব প্রকাশকেই নৃত্য বলে।

যুগে যুগে কালে কালে নৃত্যের আবির্ভাব হয়েছে প্রাকবৈদিক যুগে ও বৈদিক যুগে নৃত্যের প্রচলন ছিল। তা নৃত্যরত ও নৃত্যরতা মূর্তি থেকে সুস্পষ্ট। চর্যাপদে প্রাচীন বাংলার বাদ্যযন্ত্র, একতারা, বীণা, ডমরু, ডমরুলি, বাঁশি, মাদল পটহের কথা স্থান পেয়েছে।আধুনিককালে ১৮০০ শতাব্দী থেকে বাইজি ও অল্পকিছু দরবারি নৃত্য প্রথা ভেদ করে জনসাধারণের হৃদয়ে নিজের আসন প্রতিষ্ঠিত করে নিল। আমরা একে একে পেলাম ঈশ্বর প্রসাদজি, ভানুজি, গিরিধারিজি, বৃন্দাদীন, কালকা প্রসাদ প্রমুখ দিকপাল নৃত্যশিল্পীদের। এর পর যারা আরও পরিশীলিত ও উন্নততর করে নৃত্যের ইতিহাসে নিজেদের আসন প্রতিষ্ঠিত করেন- তাদের মধ্যে উদয় শংকর, শম্ভু মহারাজ, রুশ্বিনী দেবী, বিরজু মহারাজ, অচ্ছন মহারাজ, গোপীকিষান, সীতারা দেবী, গুরু আমুবী সিংহ, গুরু বিপিন সিংহ, গুরু পাকা সিংহ, কেলুচরণ মহাপাত্র, সংযুত্তা পানিগ্রাহী প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।

গত দু’বছর করোনা পরিস্থিতিতে, স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল সাধারন জনজীবন। ধীরে ধীরে তার থেকে বেরিয়ে এসে আবারো একটু একটু করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসছে মানুষ। ঠিক এইরকম সময়েই আরো বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হয়েছে নৃত্য। উদ্যমহীন স্বার্থপরতা অবসাদ থেকে চেতনা বৃদ্ধির অন্যতম উপায় নৃত্য। সারা পৃথিবী দেশ রাজ্যের বিভিন্ন যায়গায় এই দিনটি পালন করতে দেখা যায়।

ইন্টারন্যাশনাল ডান্স কমিটি এবং ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউট আইটিআই ১৯৮২ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে প্রতি বছর পালিত হয়ে আসছে আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস। প্রতিবছর এই আন্তর্জাতির নৃত্য দিবসে মে বার্তা প্রেরণ করা হয় তাহলো বিভিন্ন অঞ্চলের সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে বিশেষ বার্তা দেওয়া এবং এই দিনটিতে নাচের মাধ্যমে মানুষকে একত্রিত করা। আজকের দিনে তুলে ধরা ভারতের প্রধান প্রধান ১০ ধারার নৃত্যকলার হদিশ‌ আপনাদের সামনে।

এদের মধ্যে অন্যতম হলো ভারতনাট্যম– ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যকলার একটি বিশেষ ধারা হল ভারতনাট্যম। দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যে এই নৃত্যকলার উৎপত্তি। ভারতনাট্যমে ভাগ, রাগ ও তালের অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে। অনেকের মতে, এই তিনটি শব্দের প্রথম বর্ণ নিয়ে গঠিত হয়েছে ভারতনাট্যম নৃত্যকলা। প্রথমদিকে মন্দিরের দেবদাসীরা এই নৃত্য পরিবেশন করত। পরে ভারতনট্যম নৃত্যের চর্চা বেড়েছে।

এরপর কত্থক– ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যের মধ্যে একটি হল কত্থক। এটি উত্তর ভারতের যাযাবর সম্প্রদায় থেকে উদ্ভুত হয়েছে। কত্থক বা কথক নৃত্যে প্রধানত রাধা কৃষ্ণের লীলা কাহিনি পরিবেশিত হয়। দীর্ঘকাল ধরে ধর্মীয় উৎসব ও মন্দির কথক পরিবেশিত হত। কথক নৃত্যের সব থেকে বিকাশ ঘটে উনবিংশ শতাব্দীতে লখনউ-এর আসাফুদ্দৌলা ও ওয়াজীদ আলশাহ-এর দরবারে।

কথাকলি– ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যের একটি অন্যতম প্রধান ধারা হল কথাকলি। এই নাচের মধ্য দিয়ে একটি কাহিনি তুলে ধরা হয়। বিভিন্ন রূপসজ্জা, পোশাক ও মুখোশ পরা হয় এই নাচের সময়। এই ভারতের মালয়ালন ভাষী দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চলে হিন্দু প্রদর্শন কলা। কথা শব্দের অর্থ কাহিনি ও কলি শব্দের অর্থ অভিনয়।

কথাকলি পর মণিপুরী নৃত্য- মণিপুরী নৃত্য জাগই নামেও পরিচিত। এর উৎপত্তি মণিপুরে। এই নৃত্য মণিপুরের সুপ্রাচীন নৃত্যধারা হিসেবে বিবেচিত। ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যের একটি অন্যতম প্রধান ধারা। মণিপুরি লাই শব্দের অর্থ হল দেবতা, হারাউবা শব্দের অর্থ হল আনন্দ নৃত্য। মণিপুরের বৈষ্ণব ধর্ম প্রাধান্যলাভের আগে, শৈবমতের ব্যাপক প্রভাব ছিল।

এরপর আসছে কুচিপুড়ি – কুচিপুড়ি ভারতীয় ধ্রুপদী নৃত্যের প্রধান আটটি নৃত্যশৈলীর মধ্যে একটি হল এটি। দক্ষিণ ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যের কুচিপুড়ি গ্রামে এই নাচের উৎপত্তি। এই নাচের পোশাক ও আদবকায়দার সঙ্গে ভারতনাট্যমের কিছু মিল আছে। প্রাচীন হিন্দু সংস্কৃত ভাষায় নাট্য শাস্ত্র পুঁথিতে এই নাচের উল্লেখ আছে। কুচিপুড়ি মূলত হিন্দু দেবতা কৃষ্ণের বৈষ্ণব রীতি হিসেবে বিকাশ লাভ করেছে।

অন্যতম নৃত্য ওড়িশি– পূর্ব ভারতের ওড়িশা রাজ্যের এই ওড়িশি নৃত্য ভারত খ্যাত। এটি ধ্রুপদী নৃত্যশৈলীর মধ্যে অন্যতম। ভারতীয় নৃত্যের আদগ্রন্থ নাট্যশাস্ত্র এই নৃত্যশৈলীটিকে ওড্র মাগধী নামে অভিহিত করা হয়েছিল। এই নৃত্যের তিনিটি ঘরানা আছে। মহারি, নর্তকী ও গোতিপুয়া। ওড়িশার মন্দিরগুলোতে এই নৃত্য প্রদর্শীত হত এক সময়। বর্তমানে এর চর্চা ভারত তথা বিশ্বের সর্বত্র।

আরও একটি নৃত্য হলো ভাংড়া– ভারত ও পাকিস্তানের পাঞ্জাব অঞ্চলের এটি একটি নৃত্যকলা। বর্তমানে শিখ সম্প্রদায় এই নৃত্যেকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দরবারে তুলে ধরে এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করেছে। এই নাচের জনপ্রিয়তা বিশ্ব জোড়া। এই নাচের সঙ্গে গানেরও জনপ্রিয়তা বিস্তর। অন্যান্য নাচের মতো এই নাচের খ্যাতিও বিশ্ব জোড়া।

বিহু– অসমের বিহু উৎসবের খ্যাতি বিশ্ব জোড়া। পুরুষ ও মহিলারা উভয় মিলিত হয়ে সমবেত লোকনৃত্য পরিবেশন করে থাকে এই সময়। এই নৃত্য প্রদর্শনীতে ঢুলীয়ার ঢোল ওর সঙ্গে মুগার মেখেলা চাদর পরে নৃত্য প্রদর্শন করা হয়। অসমীয়া জাতির সঙ্গে জড়িত রয়েছে এই নৃত্য।

বিহুর পর গাড়বা– গুজরাতের গাড়বা নৃত্যকলার খ্যাতি বিশ্ব জোড়া। এটি গুজরাটের সর্বাধিক পালিত সাংস্কৃতিক নৃত্য শৈলী। আজ আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবসে এই নৃত্যের গুরুত্বকের কথা অস্বীকার করা যায় না। গুজরাতের ঐতিহ্যকে তুলে ধরে গাড়বা। এদিকে, প্রতিবছর এই আন্তর্জাতির নৃত্য দিবস একটি করে বার্তা প্রেরণ করা হয়। বিভিন্ন অঞ্চলের সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে বিশেষ বার্তা দেওয়া হয়।

মোহিনীঅট্টম– কেরল রাজ্য থেকে বিকশিত হয়েছে মোহিনীঅট্টম নৃত্য। বিষ্ণুর সম্মোহিনী অবতার মোহিনীর সমোমহিী শক্তি ব্যবহার করা হয় এই নাচে।। এক সময় মন্দিরে প্রদর্শীত হত এই নৃত্য। নাট্য শাস্ত্রে বর্ণিত লাস্য শৈলী অনুসরণ করে উপস্থাপন করা হয় মোহিনীঅট্টম। মোহিনীঅট্টম সাধারণত আবৃত্তি সব সোপান শৈলীর গানের সঙ্গে বিশুদ্ধ এবং ভাবপূর্ণ নৃত্য নাট্য হিসেবে মঞ্চস্থ করা হয়।

এর বাহিরেও আরো প্রচুর আঞ্চলিক এবং স্থানীয় ক্ষেত্রে প্রচুর নৃত্য শৈলী রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। এইভাবে আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবসে আমরা তুলে ধরার চেষ্টা করলাম আমাদের দেশের প্রধান প্রধান অঞ্চলের বিভিন্ন নৃত্য শৈলীর নানান দিক সম্পর্কে কিছু কথা। এই নৃত্য শৈলী গুলিকে বাঁচিয়ে রাখার ক্ষেত্রে ‌ নিরন্তর প্রয়াস করে চলেছেন বিভিন্ন শিল্পীরা আমাদের তাদের পাশে থেকে উৎসাহিত করা উচিত এবং সেগুলিকে সংরক্ষণের ক্ষেত্রে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন মনে হয় আজকের পরিবর্তিত দ্রুত কমিউনিকেশনের যুগে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *