পিনাকী রঞ্জন পাল
ভয়ের আয়নায় বন্দি এক নারীর আত্মা, স্বামী অভ্রর রহস্যময় মৃত্যু, আর স্ত্রীর লড়াই—সব মিলিয়ে এক মনস্তাত্ত্বিক হরর কাহিনি। মুক্তির বিনিময়ে ভয়, আয়নায় লুকিয়ে অজানা অতীতের ছায়া। এখনই পড়ুন।
অধ্যায় ১: অমঙ্গলের পূর্বাভাস
কলকাতার উপকণ্ঠে সুমিত্রার ফ্ল্যাটে যখন রাত গভীর হয়, তখন সময়টা যেন তার নিজস্ব ছন্দে এক স্থবিরতা নিয়ে আসে। বাইরে তখন কালবৈশাখীর শেষ তাণ্ডব চলছে; গাছের ডালপালা ভেঙে পড়ার শব্দ, বাতাসের হিসহিসানি আর বিদ্যুতের ঝলকানি যেন প্রকৃতিকেও এক অশুভ খেলায় মত্ত করে তুলেছে। গত তিনদিন ধরে এই একই দৃশ্য। প্রকৃতি যেন সুমিত্রার ভেতরের গভীর শোক আর মনস্তাত্ত্বিক যন্ত্রণার প্রতিচ্ছবি। মাসখানেক হলো তার স্বামী, অভ্র সেন, এক মর্মান্তিক পথ দুর্ঘটনায় চিরতরে হারিয়ে গেছেন। সুমিত্রা এখন এই বিশাল, শতাব্দী প্রাচীন ফ্ল্যাটে একা। বাবা-মা বহু আগেই গত, অভ্রই ছিল তার একমাত্র অবলম্বন, তার জীবনের ধ্রুবতারা। এখন সব যেন অন্ধকার।
আরো পড়ুন : ভৌতিক থ্রিলার : মৃত্যুকূপ
তার বিষণ্ণতা আর একাকীত্ব যেন এই ফ্ল্যাটের প্রতিটি কোণাকে গ্রাস করে নিয়েছে। আসবাবপত্রে ধুলোর স্তর জমছে, যা যেন তাদের ওপর নেমে আসা সময়ের ভারের প্রতীক। নীরবতা এতটাই গাঢ় যে, নিজের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দও যেন কানে বাজছে। সুমিত্রা বিছানায় শুয়ে ছিল, কিন্তু ঘুম তার চোখে নেই। প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি প্রতিধ্বনি যেন তার মনকে আরও অস্থির করে তুলছে। তার ভেতরের শূন্যতা এক অদেখা ভয়ের রূপ নিচ্ছিল।
আজ বিকেলটা ছিল আরও বিষণ্ণ। অভ্রর পুরোনো জিনিসপত্র গোছাতে গিয়ে সুমিত্রা তার স্টাডি রুমের এক কোণায়, পুরোনো বইয়ের স্তূপের নিচে, একটা ছোট, খোদাই করা সিন্দুক খুঁজে পায়। সিন্দুকটা ছিল মেহগনি কাঠের তৈরি, তার গায়ে অদ্ভুত সব প্রাচীন নকশা খোদাই করা, যেন কোনো অজানা রহস্যের প্রতীক। সিন্দুকটা খুলতেই ভেতরে এক চাপা, স্যাঁতসেঁতে গন্ধ ভেসে আসে, যা পুরনো কাগজ আর এক ধরণের মিষ্টি ফুলের ঘ্রাণের মিশ্রণ। ভেতরে ছিল কয়েকটি জীর্ণ বই, কিছু অস্পষ্ট কাগজপত্র— আর তার মাঝে একটা মোড়ানো কাপড়। কাপড়টা খুলতেই সুমিত্রার হাত কেঁপে ওঠে। ভেতরে ছিল একটা ভাঙা আয়না।
আরো পড়ুন : ভৌতিক/ রহস্য গল্প : বুমসিরার বাটি
আয়নাটা সাধারণ ছিল না। তার কাঠের ফ্রেমে জটিল কারুকার্য, যেন শতাব্দী প্রাচীন কোনো কারিগরের হাতে তৈরি। কিন্তু কাঁচটা ছিল ভাঙা, অসমান টুকরোগুলো যেন অজস্র চোখ হয়ে সুমিত্রাকে দেখছে। প্রতিটি ভাঙা টুকরোতে তার নিজের মুখটা যেন হাজারটা বিকৃত প্রতিবিম্ব হয়ে ফুটে উঠছিল। আয়নাটা হাতে নিতেই সুমিত্রার গা ছমছম করে ওঠে। তার মনে হলো, আয়নাটা যেন তার হাতের ওপর ভর করে আছে, তার ওজন যেন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। হঠাৎ একটা ঠাণ্ডা স্রোত তার শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে যায়, যেন বরফ-শীতল কোনো অদৃশ্য হাত তার মেরুদণ্ড ছুঁয়ে গেল। তার মনে হলো, আয়নাটা যেন নিঃশ্বাস নিচ্ছে।
ভাঙা আয়নার পাশেই পড়ে ছিল একটা পুরোনো ডায়েরি। ডায়েরিটার মলাট ছিল চামড়ার তৈরি, তার রং বিবর্ণ, আর কোণগুলো ক্ষয়ে গেছে। সুমিত্রা সাবধানে ডায়েরিটা হাতে তুলে নিল। তার পাতার রঙ হলদেটে, আর তাতে প্রাচীন কালির ছোপ। পাতা উল্টাতেই সুমিত্রা চমকে ওঠে। এ তো অভ্রর হাতের লেখা! কিন্তু সে অভ্রকে কোনোদিন ডায়েরি লিখতে দেখেনি। অভ্র ছিল খুবই বাস্তববাদী, এসব ব্যক্তিগত অনুভূতি লিখে রাখার প্রতি তার কোনো আগ্রহ ছিল না। তাহলে এই ডায়েরি কোথা থেকে এলো? আর কেনই বা সে তার স্ত্রীকে এর অস্তিত্ব জানায়নি?
আরো পড়ুন : পৌরাণিক রোমাঞ্চ গল্প : অরণ্যবালার আত্মকথা
প্রথম পাতায়, মোটা কালিতে লেখা ছিল একটা বাক্য, যা সুমিত্রার মনকে এক গভীর উদ্বেগের অতলে টেনে নিয়ে গেল: “মৃত্যু যখন দরজায় কড়া নাড়ে, তখনো কেউ জানে না কী অপেক্ষা করছে।” এই লাইনটা যেন অভ্রর শেষ আর্তনাদ। সুমিত্রার মনে হলো, এই ডায়েরি হয়তো অভ্রর মৃত্যুর রহস্যের চাবিকাঠি। হয়তো অভ্রর মৃত্যু কেবল একটা দুর্ঘটনা ছিল না, এর পেছনে লুকিয়ে আছে কোনো গভীর, অন্ধকার রহস্য। বিদ্যুতের ঝলকানি আবারও ঘরের ভেতরটা আলোকিত করে তুললো, আর ভাঙা আয়নার কাঁচের টুকরোগুলো যেন এক বীভৎস হাসি হাসলো।
বাইরের ঝড় আরও তীব্র হলো। সুমিত্রা আয়না আর ডায়েরি নিয়ে বিছানায় বসলো। তার মন অস্থির, শরীর কাঁপছে। সে অনুভব করতে পারছিল, এই ফ্ল্যাটে সে একা নয়। আয়না থেকে যেন এক অদৃশ্য দৃষ্টি তাকে অনুসরণ করছে। তার মনে হলো, এই ডায়েরি শুধু অতীত নয়, ভবিষ্যতেরও কিছু ইঙ্গিত দিচ্ছে। অভ্রর শেষ কথাগুলো, তার অজানা ভয়, আর এই রহস্যময় আয়না—সবকিছু মিলে যেন এক অন্ধকার জালের মতো তাকে ঘিরে ধরছিল। সুমিত্রা জানত না, এই আয়নার গভীরে লুকিয়ে আছে এমন এক বিভীষিকা, যা তার বাস্তবতার ধারণাকেই ভেঙে দেবে। রাত যত গভীর হচ্ছিল, তার ভয় ততই বাড়ছিল। সে অনুভব করছিল, ফ্ল্যাটের প্রতিটা কোণায় যেন এক অদৃশ্য উপস্থিতি দানা বাঁধছে, এক অশুভ ছায়া যেন তার দিকেই এগিয়ে আসছে।
আরো পড়ুন : সুপারন্যাচারাল থ্রিলার : অন্ধকারের ছায়া
অধ্যায় ২: ফাটলের ওপার
সুমিত্রা অভ্রর ডায়েরি হাতে নিয়ে বিছানায় স্থির বসে ছিল, তার হৃৎপিণ্ড দ্রুত লয়ে ধুকপুক করছিল। বাইরে তখনো ঝড়ের তাণ্ডব চলছে, বিদ্যুতের প্রতিটি ঝলকানি আর মেঘের গম্ভীর গর্জন যেন বাড়ির প্রতিটি অন্ধকার কোণ থেকে এক অশুভ নীরবতাকে চিরে দিচ্ছিল। ডায়েরির প্রথম কিছু পাতা ছিল অভ্রর দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ দিনলিপি—তার কাজ, তার প্রিয় শখ, তার আর সুমিত্রার ভালোবাসার ছোট ছোট মুহূর্তগুলো। কিন্তু হঠাৎ করেই, তারিখের পালাবদলের সাথে সাথে লেখার সুর পাল্টে গেল। প্রায় এক মাস আগের একটি তারিখ, আর তার নিচে অভ্রর হাতে লেখা কিছু লাইন যেন সুমিত্রার শ্বাস বন্ধ করে দিল:
“আজ শহরের এক পুরোনো অ্যান্টিক শপ থেকে একটা আয়না কিনলাম। বিক্রেতা হাসিমুখে বললো, এটা নাকি অনেক পুরোনো, এর নাকি নিজস্ব ইতিহাস আছে। রহস্যময় একটা অনুভূতি হলো। আমার বেশ পছন্দ হলো।”
সুমিত্রা নিজের হাতের ভাঙা আয়নাটার দিকে তাকালো। এর প্রতিটি ফীর্ণ কাঁচের টুকরো যেন তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, হাজারো চোখ হয়ে। এটাই কি সেই আয়না? অভ্রর কেন এমন একটি ভাঙা আয়না পছন্দ হলো? তার মনের কোণে হাজারো প্রশ্ন কিলবিল করছিল। এই আয়না যেন শুধু একটি বস্তু নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক অজানা ইতিহাস।
ডায়েরির পরের পাতায় লেখা ছিল: “আয়নাটা ঘরে আনার পর থেকে আমার কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে। মনে হচ্ছে, কেউ আমাকে দেখছে। যদিও আমি একা, তবুও… সব সময় একটা চাপা উপস্থিতি অনুভব করছি।”
এই লাইনগুলো পড়ে সুমিত্রার গা শিউরে উঠলো। সে মনে করার চেষ্টা করলো, অভ্রর মৃত্যুর প্রায় এক মাস আগে থেকেই তার আচরণে পরিবর্তন এসেছিল। সে রাতে একা ঘুমাতে চাইতো না, অকারণে অস্থির থাকতো, এমনকি ঘরের মধ্যে হাঁটাহাঁটি করতে গিয়েও যেন সে কোনো অদৃশ্য কিছুকে এড়িয়ে চলতো। সুমিত্রা তখন ভেবেছিল, হয়তো অফিসের কাজের চাপ বা কোনো ব্যক্তিগত দুশ্চিন্তা তাকে অস্থির করে তুলছে। কিন্তু এখন সে বুঝতে পারছিল, এর পেছনে হয়তো অন্য কোনো কারণ ছিল। অভ্র কি তখন থেকেই কোনো অশুভ শক্তির মুখোমুখি হচ্ছিল?
হঠাৎই, বাইরে এক বিকট শব্দে বিদ্যুৎ চমকে উঠলো। তার আলোয় ঘরটা মুহূর্তের জন্য আলোকিত হয়ে উঠলো। ভাঙা আয়নার কাঁচের প্রতিটি টুকরোয় সুমিত্রার নিজের মুখটা যেন হাজারো বিকৃত প্রতিবিম্ব হয়ে দেখা গেল, যা তার মনের ভয়কে আরও বাড়িয়ে দিল। আয়নার কাঁচগুলো থেকে যেন একটা ঠান্ডা, নীলচে আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছিল, যা ঘরের অন্য সব আলোকে গ্রাস করে নিচ্ছিল। সে অনুভব করলো, ঘরের তাপমাত্রা যেন হুট করে কমে গেছে, হাড় পর্যন্ত কাঁপিয়ে দেওয়া এক হিমশীতল বাতাস তার গা ছুঁয়ে গেল। বাতাসটা যেন কোথাও থেকে ভেসে আসছিল না, বরং ঘরের ভেতরেই জমাট বেঁধেছিল।
ডায়েরির পরবর্তী পাতায় অভ্রর লেখা ছিল: “স্বপ্নে একটা নারীমূর্তি দেখছি। তার চোখগুলো খুব পরিচিত, কিন্তু তাকে চিনতে পারছি না। তার হাসিটা কেমন যেন ভয়ংকর, অথচ তার কণ্ঠস্বর খুব মিষ্টি।”
এই লাইনগুলো যেন সুমিত্রার শিরদাঁড়া বেয়ে এক শীতল স্রোত নামিয়ে দিল। অভ্র কি কোনো বিভীষিকার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল? স্বপ্নের সেই নারীমূর্তি কি কেবল কল্পনা ছিল, নাকি এর পেছনে লুকিয়ে ছিল কোনো বাস্তব অস্তিত্ব? সুমিত্রার মনে পড়লো, অভ্রর শেষের দিনগুলোয় সে প্রায়ই ঘুমের মধ্যে ছটফট করতো, অস্ফুটে কিছু বলতো, যা সে স্পষ্ট শুনতে পেত না। তখন সে বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, সেই ঘুমের বিকারগুলো হয়তো ছিল অভ্রর মনের গভীরে বাসা বাঁধা এক অজানা আতঙ্কের বহিঃপ্রকাশ।
ডায়েরির সেই অংশে অভ্র আরও বিস্তারিত লিখেছিল নারীমূর্তিটি সম্পর্কে: “সে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে, তার চোখ যেন আমাকে অনুসরণ করে। প্রথমে ভেবেছিলাম, এটা নিছকই দুঃস্বপ্ন। কিন্তু রাতের পর রাত যখন একই মুখ দেখি, তখন আমার মনে ভয় ধরে। সে আমাকে কোনো কথা বলে না, শুধু তাকিয়ে থাকে। তার চোখের দৃষ্টিতে একটা গভীর শূন্যতা আর এক অদ্ভুত আকর্ষণ। আমি পালাতে চাই, কিন্তু পারি না।”
সুমিত্রা নিজেকে প্রশ্ন করলো, এই নারী কি তবে আয়নারই কোনো ভূতপূর্ব মালকিন? হয়তো সেই আয়নার সঙ্গে এই নারীমূর্তির কোনো গভীর সম্পর্ক আছে, যা অভ্রকে ধীরে ধীরে তার দিকে টেনে নিচ্ছিল। ডায়েরির পাতা উল্টাতেই সুমিত্রা দেখতে পেল, সেই পৃষ্ঠার এক কোণে একটি অস্পষ্ট আঁকিবুঁকি—একটা নারীর মাথার আদল, যার চোখের স্থানে দুটি কালো গর্ত, আর মুখটা যেন অসম্পূর্ণ। অভ্র কি নিজেই সেই নারীমূর্তি আঁকার চেষ্টা করেছিল? এই চিত্রটি যেন আরও রহস্যময় করে তুললো সবকিছু।
বাইরের ঝড়ের শব্দ ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে আসছিল, কিন্তু সুমিত্রার ভেতরের ঝড়টা আরও তীব্র হচ্ছিল। তার মনে হচ্ছিল, এই ডায়েরি শুধু অভ্রর জীবনের শেষ দিনগুলোর বর্ণনা নয়, এটা যেন এক অভিশপ্ত আত্মজীবনী। সে আয়নাটা নিজের হাতে আরও শক্ত করে ধরলো, যেন এর ভেতর থেকে কোনো উত্তর খুঁজে পেতে চাইছে। কিন্তু আয়নাটা তখনো ভাঙা, তার প্রতিটি ফাটল যেন এক অন্ধকার রহস্যের দ্বার উন্মোচন করছিল। সুমিত্রা জানত না, এই ভাঙা কাঁচের প্রতিবিম্বে তার জন্য কী অপেক্ষা করছে, কিন্তু তার মন বলছিল, সে এখন এক এমন সত্যের মুখোমুখি হতে চলেছে, যা তার জীবনকে চিরতরে পাল্টে দেবে।
অধ্যায় ৩: অশুভের ছায়া
পরের দিন সকালটা সুমিত্রার জন্য এক নতুন মাত্রার অস্বস্তি নিয়ে এল। ভোরের আলো ফ্ল্যাটের জানালায় এসে পড়লেও, তার মন থেকে রাতের আঁধার কাটেনি। অভ্রর ডায়েরি তাকে ভেতরে ভেতরে এক অদৃশ্য পোকার মতো কুরে খাচ্ছিল, তার প্রতিটি পাতায় যেন লুকিয়ে ছিল এক অজানা ভয়। অভ্রর লেখা প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি লাইন যেন সুমিত্রার চারপাশে এক অদৃশ্য জাল বুনে দিচ্ছিল, যার থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন। তার মনে হচ্ছিল, এই ফ্ল্যাটের প্রতিটি কোণ, প্রতিটি জিনিস যেন এক অশুভ শক্তির প্রভাবে প্রভাবিত।
রান্নাঘরে গিয়ে সুমিত্রা যখন চা বানাতে গেল, তখন সে এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখল। গ্যাসের উনানে ফ্লেমগুলো যেন অস্বাভাবিকভাবে নাচছে, তাদের নীল আভা কখনো ছোট হচ্ছে, কখনো বড়, যেন কোনো অদৃশ্য সত্তা সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করছে। সুমিত্রা দ্রুত হাতে কাপে কফি ঢালতে গেল, কিন্তু তার হাত থেকে কফির কাপটা হুট করে পড়ে গেল, মেঝেতে সশব্দে ভেঙে চৌচির হয়ে গেল। অথচ, তার হাত থেকে কোনোদিন কিছু পড়ে না। তার বুকটা ধড়ফড় করে উঠলো। এ কি কেবল মনের ভুল, নাকি তার চারপাশে সত্যি সত্যিই কিছু একটা ঘটছে, যা তার বাস্তবতাকে চ্যালেঞ্জ করছে? সুমিত্রা স্পষ্ট বুঝতে পারছিল, এই বাড়িতে কিছু একটা আছে, যা সাধারণ যুক্তি বা বিজ্ঞানের আওতার বাইরে।
দুপুরের খাবারের পর, সুমিত্রা তার মনের অস্থিরতা কাটাতে আবার ডায়েরিটা নিয়ে বসল। তার মন বলছিল, উত্তরটা এই জীর্ণ পাতার ভাঁজেই লুকিয়ে আছে। অভ্রর লেখাগুলো যেন তাকে আরও গভীরে টেনে নিচ্ছিল, এক অজানা রহস্যের গভীরে। সে দেখল, ডায়েরির পরবর্তী পাতায় অভ্র লিখেছে:
“সে নারীমূর্তিটা এখন আমার সাথে কথা বলছে। তার কণ্ঠস্বর অদ্ভুত, বাতাসের মতো মৃদু, অথচ আমার কানের পর্দায় স্পষ্ট আঘাত করে। সে বলছে, সে নাকি এই আয়নাতেই বন্দি। সে মুক্তি চাইছে… আমার কাছে।”
এই লাইনগুলো পড়ে সুমিত্রার হাত কাঁপছিল। আয়নায় বন্দি? এটা কি করে সম্ভব? অভ্র কি তাহলে ধীরে ধীরে মানসিক ভারসাম্য হারাচ্ছিল? নাকি এই নারীমূর্তি সত্যি সত্যিই এক অশরীরী সত্তা, যে তার মুক্তির জন্য অভ্রকে ব্যবহার করছিল? সুমিত্রার মনে পড়লো, অভ্রর শেষের দিনগুলোয় সে প্রায়ই একা একা কথা বলতো, যেন সে কোনো অদৃশ্য শ্রোতার সঙ্গে কথোপকথন করছে। তখন সুমিত্রা বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়নি, ভেবেছিল মানসিক চাপ। কিন্তু এখন সবকিছুর যেন অন্যরকম অর্থ দাঁড়াচ্ছে।
ডায়েরির এই অংশটিতে অভ্র আরও লিখেছিল: “আমি জানি না কী করব। তার কণ্ঠস্বর আমার মস্তিষ্কের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। সে আমাকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, যদি তাকে মুক্তি দিই, তাহলে সে আমাকে শান্তি দেবে। কিন্তু আমার মনে ভয়, তাকে মুক্তি দিলে কী হবে?”
সন্ধ্যা নামতেই বাড়ির পরিবেশটা যেন পুরোপুরি পাল্টে গেল। বাইরে ঝিরঝির বৃষ্টি পড়ছিল, যা কাঁচের জানালায় মৃদু আঘাত করছিল। কিন্তু তার ভেতরের থমথমে নীরবতা যেন আরও গাঢ় হচ্ছিল। ঘরের প্রতিটি কোণায় যেন এক অদৃশ্য উপস্থিতি দানা বাঁধছিল। সুমিত্রা দেখল, ডাইনিং টেবিলের ওপর রাখা ফুলদানির তাজা ফুলগুলো হঠাৎই শুকিয়ে গেছে, তাদের প্রাণবন্ত রঙ ফিকে হয়ে এসেছে, যেন এক লহমায় তাদের জীবন কেড়ে নেওয়া হয়েছে। ঘরের কোণে রাখা দোলনাটা একা একাই দুলছে, ধীর গতিতে, যেন কোনো অদৃশ্য শিশু তাতে বসে দোল খাচ্ছে। এই দৃশ্য দেখে সুমিত্রার শরীর হিম হয়ে আসছিল, তার হৃৎপিণ্ড দ্রুত গতিতে ধুকপুক করছিল।
সুমিত্রা নিশ্চিত হলো, অভ্রর ডায়েরিতে লেখা সব কথা সত্যি। এই বাড়িতে কিছু একটা আছে। সে একা নয়। ফ্ল্যাটের প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি ছায়া যেন তাকে এক অজানা বিপদের ইঙ্গিত দিচ্ছিল। তার মনে হলো, আয়নাটা যেন নিঃশ্বাস নিচ্ছে, তার ভাঙা কাঁচের টুকরোগুলো থেকে এক অদৃশ্য শক্তি নির্গত হচ্ছে, যা ঘরের সবকিছুকে প্রভাবিত করছে। সে অনুভব করলো, যেন সেই নারীমূর্তি তার খুব কাছেই দাঁড়িয়ে আছে, তার প্রতিটি পদক্ষেপ অনুসরণ করছে। এই অনুভূতি এতটাই তীব্র ছিল যে, সুমিত্রা ভয়ে নিজের নিশ্বাসও আটকে রাখল।
রাত যত গভীর হচ্ছিল, বাড়ির নীরবতা ততই গাঢ় হচ্ছিল, যা যেন এক আসন্ন বিপদের পূর্বাভাস দিচ্ছিল। সুমিত্রা জানত না, এই অশরীরী উপস্থিতি থেকে সে কিভাবে বাঁচবে, বা আদৌ বাঁচতে পারবে কি না। সে অনুভব করছিল, সে এক এমন জালে আটকা পড়েছে, যার থেকে মুক্তি পাওয়া অসম্ভব। তার একমাত্র ভরসা ছিল এই ডায়েরি, যা হয়তো তাকে এই রহস্যের গভীরে নিয়ে যাবে, অথবা তাকে চিরতরে এক অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেবে।
অধ্যায় ৪: ছায়ার পিছুটান
রাত গভীর হওয়ার সাথে সাথে ফ্ল্যাটের নিস্তব্ধতা যেন এক অশুভ ভারী নিঃশ্বাসে ভরে উঠলো। সুমিত্রার বিছানায় ছটফটানি বাড়ছিল, ঘুম তার চোখে আসছিল না। বাইরের ঝড়ের শব্দ ক্ষীণ হলেও, তার মনের ভেতরের ঝড় তখনো থামেনি। প্রতিটি মুহূর্ত যেন এক অনন্ত অপেক্ষার মতো মনে হচ্ছিল। হঠাৎই, সে তার বন্ধ দরজার বাইরে থেকে এক খসখস শব্দ শুনতে পেল। শব্দটা ছিল মৃদু, কিন্তু এতটাই স্পষ্ট যে, সুমিত্রার গা শিউরে উঠলো। মনে হচ্ছিল, কেউ যেন তার দরজার সামনে ধীর পায়ে হাঁটছে, তার প্রতিটি পদক্ষেপ মেঝের পুরোনো কাঠকে কাঁপিয়ে তুলছে।
শব্দটা একবার এদিক থেকে ওদিক যাচ্ছিল, আবার থেমে যাচ্ছিল, যেন অদৃশ্য কেউ তাকে পরীক্ষা করছে। সুমিত্রা চোখ বন্ধ করে নিজেকে বোঝাতে চাইল, এটা নিছকই মনের ভুল, কিন্তু তার শরীরের প্রতিটি লোমকূপ যেন সতর্ক হয়ে উঠেছিল। কয়েক মিনিট পর, শব্দটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল, যেন অদৃশ্য সত্তাটা সেখান থেকে চলে গেছে।
এক অদম্য কৌতূহল আর চাপা ভয় নিয়ে সুমিত্রা বিছানা ছেড়ে উঠলো। তার হাত কাঁপছিল, কিন্তু সে জানত, এই রহস্যের গভীরে প্রবেশ না করলে তার মুক্তি নেই। টর্চ জ্বেলে সে সাবধানে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। দরজার নিচে একটা সরু আলোর রেখা দেখা যাচ্ছিল, যা যেন বাইরে থেকে আসছে। মনে হলো, কেউ যেন তার দরজার সামনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তার দিকেই তাকিয়ে ছিল। সুমিত্রার বুকটা ধুকপুক করছিল, তার গলা শুকিয়ে কাঠ। সে দ্রুত দরজা খুললো। কিন্তু কেউ নেই। দরজার বাইরে ঘন অন্ধকার আর নিস্তব্ধতা। শুধুমাত্র একটা মিষ্টি, অপরিচিত গন্ধ বাতাসে ভেসে আসছিল, যা তার চেনা কোনো ফুলের গন্ধ ছিল না। গন্ধটা ছিল কেমন যেন পুরোনো, আবদ্ধ স্থানের মতো, যা তার মনে আরও ভয় জাগিয়ে তুলল।
ডায়েরিটা তার কাছে এখন একমাত্র আশ্রয়। সুমিত্রা দ্রুত ডায়েরির আরও কিছু পাতা উল্টাল। অভ্রর হাতে লেখাগুলো যেন আরও অস্থির হয়ে উঠেছিল, কালির ছোপগুলো যেন গাঢ় হয়ে আসছিল। অভ্র লিখেছে:
“সে মুক্তি চাইছে। তার কণ্ঠস্বর এখন আরও স্পষ্ট, সে আমার মস্তিষ্কের প্রতিটি কোণায় অনুরণিত হচ্ছে। সে বলছে, যদি আমি তাকে মুক্ত না করি, তাহলে সে আমার সবকিছু কেড়ে নেবে। আমার প্রিয়জন, আমার শান্তি, আমার জীবন।”
এই কথাগুলো পড়ে সুমিত্রার শরীর হিম হয়ে গেল। তার চোখগুলো ভয়ে বড় বড় হয়ে উঠলো। অভ্রর মৃত্যু কি এই অশরীরীরই কাজ? অভ্র কি তার জীবন দিয়ে এই সত্তার মুক্তি কিনেছিল? সুমিত্রার মনে পড়লো, অভ্রর শেষের দিনগুলোয় সে কতটা অবসন্ন আর ভীত ছিল। সে সব সময় একা থাকতে চাইতো না, যেন অদৃশ্য কোনো শক্তি তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল।
হঠাৎই, ঘরের মধ্যে এক তীব্র ঠান্ডা স্রোত প্রবেশ করলো, যেন ঘরের তাপমাত্রা এক লহমায় হিমাঙ্কের নিচে নেমে গেছে। সুমিত্রার শরীর কাঁপতে শুরু করল। সে অনুভব করলো, কেউ যেন তার খুব কাছে চলে এসেছে। বাতাস ভারী হয়ে উঠলো, তার কানের কাছেই সে কারো শ্বাসের শব্দ শুনতে পেল, যা ছিল ভারী, যেন দীর্ঘ পরিশ্রমের পর কেউ হাঁপাচ্ছে। সুমিত্রা ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল। তার সামনে, ঘরের মাঝখানে, একটা আবছা ছায়ামূর্তি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
নারীমূর্তিটা ছিল অস্পষ্ট, তার আকৃতি স্পষ্ট নয়, কিন্তু তার চোখের আলো ছিল তীব্র, যেন দুটি আগুনের ফুলকি তার অশরীরী শরীর থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে। চোখগুলো ছিল পরিচিত, যেমনটা অভ্র ডায়েরিতে লিখেছিল, কিন্তু একইসাথে অচেনা। সুমিত্রা ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেল, তার পা যেন মেঝের সঙ্গে আটকে গেছে। ছায়ামূর্তিটার চারপাশ থেকে এক অদ্ভুত, নীলচে আভা নির্গত হচ্ছিল, যা ঘরের অন্ধকারকে আরও গাঢ় করে তুলছিল।
তারপরই, ভাঙা আয়নাটার কাঁচের টুকরোগুলো থেকে এক তীব্র আলোর ঝলকানি বের হলো। প্রতিটি টুকরো যেন জীবিত হয়ে উঠলো, তাদের ধারালো প্রান্তগুলো থেকে এক অজানা শক্তি বিচ্ছুরিত হচ্ছিল। আয়নার প্রতিটি ফাটল যেন এক একটি দরজা, যা এক অন্ধকার জগতের প্রবেশপথ। সুমিত্রা বুঝতে পারল, এই ছায়ামূর্তিই সেই সত্তা, যে আয়নায় বন্দি ছিল। তার উপস্থিতি এতটাই তীব্র যে, সুমিত্রার পক্ষে তা সহ্য করা কঠিন হয়ে পড়ছিল।
ছায়ামূর্তিটা ধীরে ধীরে সুমিত্রার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। তার প্রতিটি পদক্ষেপ যেন নীরব, অথচ তার উপস্থিতি যেন সুমিত্রার হৃদপিণ্ডের প্রতিটি স্পন্দনকে অনুভব করছিল। সুমিত্রা জানত না, এই মুখোমুখি লড়াইয়ে সে কিভাবে জিতবে, কিন্তু তার মন বলছিল, তার জীবন এখন এক চরম বিপদের মুখে। এই ফ্ল্যাটটা এখন তার জন্য নিরাপদ নয়, এটি এখন এক অশরীরী শক্তির লীলাক্ষেত্র।
অধ্যায় ৫: প্রতিশোধের অগ্নিশিখা
ছায়ামূর্তিটা ধীরে ধীরে সুমিত্রার দিকে এগিয়ে আসছিল, তার প্রতিটি অদৃশ্য পদক্ষেপে যেন ঘরের বাতাস আরও ভারী হয়ে উঠছিল। সুমিত্রা ভয়ে জমে গিয়েছিল, তার গলা শুকিয়ে কাঠ, মস্তিষ্ক যেন অবশ হয়ে গেছে। সে পিছু হটতে হটতে দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকালো, আর পালানোর কোনো পথ নেই। তার হৃদপিণ্ড প্রচণ্ড বেগে ধুকপুক করছিল, মনে হচ্ছিল যেন তা বুকের খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে আসবে। ছায়ামূর্তিটা তার খুব কাছে এসে দাঁড়ালো, এতটাই কাছে যে সুমিত্রা তার শীতল উপস্থিতি স্পষ্ট অনুভব করতে পারছিল। নারীমূর্তিটির ঠোঁটে ছিল এক ভয়ংকর, শীতল হাসি, যা দেখে সুমিত্রার রক্ত হিম হয়ে গেল। সেই হাসি যেন শত শত বছরের জমে থাকা ঘৃণা আর প্রতিশোধের বহিঃপ্রকাশ ছিল। সুমিত্রা অনুভব করলো, তার শরীর দ্রুত অবশ হয়ে আসছে, যেন তার ভেতরের সমস্ত শক্তি শুষে নেওয়া হচ্ছে।
ঠিক সেই মুহূর্তে, সুমিত্রা দেখল এক অবিশ্বাস্য ঘটনা! নারীমূর্তিটা তার আবছা, দীর্ঘ হাত বাড়িয়ে দিল আয়নার ভাঙা টুকরোগুলোর দিকে। মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা সেই ধারালো কাঁচের টুকরোগুলো যেন এক অদৃশ্য শক্তির টানে একে অপরের দিকে ছুটে আসতে লাগল। চোখের পলকে, ভাঙা টুকরোগুলো যেন জাদুর মতো এক হয়ে যাচ্ছিল, আবার একটি সম্পূর্ণ আয়নার রূপ নিচ্ছিল। কিন্তু আয়নাটি এবার আর আগের মতো সরল ছিল না; তার কাঁচের গভীরে যেন এক ঘোর কালো আভা খেলা করছিল, যা এক অশুভ শক্তিকে ধারণ করছিল।
পূর্ণাঙ্গ আয়নাটি তৈরি হওয়ার পর, নারীমূর্তিটি সেদিকে তাকালো। তার চোখ দুটোতে জ্বলে উঠলো প্রতিশোধের এক তীব্র আগুন, যেন হাজার বছরের বন্দিত্বের যন্ত্রণা সেই মুহূর্তে ফেটে পড়ছে। তার মুখের হাসিটা আরও চওড়া হলো, যা তার পৈশাচিক উদ্দেশ্যকে স্পষ্ট করে তুলছিল। নারীমূর্তিটির কণ্ঠস্বর এবার আরও স্পষ্ট, আরও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলো। তার কন্ঠস্বরে ছিল এক অদ্ভুত অনুরণন, যেন ফ্ল্যাটের প্রতিটি দেয়াল তার কথায় প্রতিধ্বনিত হচ্ছে:
“তুমি জানো না, কতদিন ধরে আমি এখানে বন্দি! কতদিন ধরে আমি এই মুক্তির অপেক্ষা করছিলাম! প্রতিটি মুহূর্ত ছিল এক একটি নরক। এবার আমার পালা। এবার তুমি আমার যন্ত্রণা অনুভব করবে!”
তার এই কথাগুলো শুনে সুমিত্রার বুকের ভেতরটা হিম হয়ে গেল। এই নারী যে কেবল একটি অতৃপ্ত আত্মা নয়, সে এক প্রতিহিংসাপরায়ণ সত্তা, যে তার মুক্তির জন্য সব কিছু করতে পারে। সুমিত্রার মনে পড়লো, অভ্রর ডায়েরিতে লেখা শেষ বাক্যটা: “সে আমাকে নিয়ে যাচ্ছে। আমি আর পারছি না।” এই কথাগুলো যেন অভ্রর শেষ আর্তনাদ ছিল। এই মুহূর্তে সুমিত্রা স্পষ্ট বুঝতে পারছিল, অভ্রর মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না। তার স্বামী কোনো পথ দুর্ঘটনায় মারা যাননি, বরং এই নারীমূর্তিই ছিল তার মৃত্যুর কারণ। অভ্র হয়তো এই অশরীরীকে মুক্ত করার চেষ্টা করছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজেই তার ফাঁদে আটকা পড়েছিল। এই ভাবনা সুমিত্রার মনের ভেতর এক তীব্র যন্ত্রণার সৃষ্টি করলো। তার ভালোবাসা, তার বিশ্বাস, সব যেন মিথ্যে প্রমাণ হয়ে যাচ্ছিল।
নারীমূর্তিটি তখন সম্পূর্ণ আয়নাটি সুমিত্রার দিকে ধরে রাখলো। সুমিত্রা আয়নার দিকে তাকাতে বাধ্য হলো। আয়নার কাঁচের গভীরে তার নিজের প্রতিবিম্ব দেখা গেল। কিন্তু সেটা তার চেনা মুখ ছিল না। সেটা ছিল এক বিকৃত, ভয়ার্ত প্রতিবিম্ব। তার মুখটা ফ্যাকাশে, চোখগুলো কোটরাগত, আর তার চোখে ছিল এক গভীর আতঙ্ক, যেন সে এক অজানা বিভীষিকার মুখোমুখি। সুমিত্রা দেখলো, তার শরীরের ভেতরের প্রাণশক্তি যেন সেই আয়নার গভীরে শুষে নেওয়া হচ্ছে, তার শরীর থেকে এক অদৃশ্য আলোকচ্ছটা বেরিয়ে আয়নার দিকে ছুটে যাচ্ছে।
নারীমূর্তিটি তখন তার সেই ভয়ংকর, শীতল হাসি হাসছিল। সেই হাসিটা যেন হাজার হাজার বছর ধরে জমাট বাঁধা যন্ত্রণার প্রকাশ। তার হাসি যেন সুমিত্রার প্রতিটি শিরা-উপশিরায় মিশে যাচ্ছিল, তার রক্তকে জমাট বাঁধিয়ে দিচ্ছিল। সে বললো, “তুমি আমার জায়গায় আসবে। তুমি অনুভব করবে, বন্দিত্ব কী। আর আমি মুক্ত হবো।” এই কথাগুলো যেন সুমিত্রার কানে কেবল শব্দ নয়, এক ভয়ংকর ভবিষ্যৎবাণী হয়ে বাজছিল। সুমিত্রা বুঝতে পারলো, এটাই তার শেষ। সে এখন সেই আয়নার পরবর্তী শিকার, যা অভ্রকে গ্রাস করেছিল।
সুমিত্রা প্রাণপণে শক্তি সঞ্চয় করে চিৎকার করার চেষ্টা করলো, কিন্তু তার গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না। তার শরীর ক্রমশ ঠাণ্ডা হয়ে আসছিল, যেন তার রক্ত জমাট বাঁধছিল। সে দেখলো, তার চারপাশে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে, যেন এক অদৃশ্য পর্দা তার চোখের সামনে নেমে আসছে। তার চোখে অভ্রর মুখটা ভেসে উঠলো, তার প্রিয় স্বামীর শেষ মুহূর্তের যন্ত্রণা যেন সে নিজে অনুভব করছিল। এই ফ্ল্যাটটা, যা তার নিরাপদ আশ্রয় ছিল, সেটাই এখন তার কবর হয়ে উঠছিল।
অধ্যায় ৬: প্রতিবিম্বের নরক
সুমিত্রা নিজের সেই বিকৃত প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো, তার শরীর থেকে যেন প্রাণশক্তি শুষে নেওয়া হচ্ছে। তার শরীরের প্রতিটি কোষ থেকে এক অদৃশ্য আলোকরশ্মি বেরিয়ে আয়নার গভীরে প্রবেশ করছিল। সে অনুভব করলো, তার ভেতরের জীবনীশক্তি ধীরে ধীরে ফুরিয়ে আসছে, তার পেশিগুলো শিথিল হয়ে পড়ছে, তার হৃদয় যেন দুর্বল হয়ে আসছে। প্রতিটি নিঃশ্বাসে সে যেন আরও ক্লান্ত হয়ে পড়ছিল।
নারীমূর্তিটি তখন এক ভয়ংকর, শীতল হাসি হাসছিল। তার হাসিটা ছিল নির্মম, অট্টহাসির মতো তীক্ষ্ণ, যা সুমিত্রার মস্তিষ্কের প্রতিটি তন্ত্রীতে আঘাত করছিল। তার হাসিটা যেন শত শত বছর ধরে জমাট বাঁধা যন্ত্রণার প্রকাশ, প্রতিশোধের এক উন্মাদ উল্লাস। তার কণ্ঠস্বর এবার আরও স্পষ্ট, আরও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলো, যেন সেই ফ্ল্যাটের প্রতিটি দেয়াল তার কথায় প্রতিধ্বনিত হচ্ছে:
“তুমি আমার জায়গায় আসবে। তুমি অনুভব করবে, বন্দিত্ব কী। হাজার হাজার বছর ধরে এই কাঁচের কয়েদে বন্দি থাকার যন্ত্রণা তুমি নিজের শরীরে অনুভব করবে। আর আমি মুক্ত হবো। আমি চিরতরে মুক্ত হবো!”
এই কথাগুলো সুমিত্রার কানে কেবল শব্দ নয়, এক ভয়ংকর ভবিষ্যৎবাণী হয়ে বাজছিল। সে স্পষ্ট বুঝতে পারলো, এটাই তার শেষ। তার সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই। সে অভ্রর ডায়েরিতে লেখা সেই ভয়ংকর সত্যের মুখোমুখি হয়েছিল, যা অভ্রর জীবন কেড়ে নিয়েছিল। এই নারী এখন তার জীবনও কেড়ে নেবে, তাকেও আয়নার কাঁচের গভীরে বন্দি করবে।
সুমিত্রা প্রাণপণে শক্তি সঞ্চয় করে চিৎকার করার চেষ্টা করলো, কিন্তু তার গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না। তার ফুসফুস অক্সিজেনের জন্য ছটফট করছিল, কিন্তু তার কণ্ঠনালী যেন অবশ হয়ে গেছে। তার শরীর ক্রমশ ঠাণ্ডা হয়ে আসছিল, যেন তার রক্ত জমাট বাঁধছিল। তার ত্বক বরফের মতো শীতল হয়ে গেল। সে অনুভব করলো, তার চোখের সামনে সব কিছু অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে, যেন এক অদৃশ্য কালো পর্দা ধীরে ধীরে তার চোখের সামনে নেমে আসছে। তার চেতনা লুপ্ত হওয়ার শেষ মুহূর্তে, তার চোখে অভ্রর মুখটা ভেসে উঠলো। তার প্রিয় স্বামীর শেষ মুহূর্তের যন্ত্রণা যেন সে নিজে অনুভব করছিল।
নারীমূর্তিটি তখনো হাসছিল, তার হাসি ফ্ল্যাটের বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল, যেন এক নতুন বন্দির আগমনী বার্তা দিচ্ছিল। সুমিত্রা অনুভব করলো, সে নিজেই সেই আয়নার একটি অংশ হয়ে যাচ্ছে, তার চেতনা কাঁচের গভীরে হারিয়ে যাচ্ছিল। এই ছিল এক অতৃপ্ত আত্মাকে মুক্তি দেওয়ার ভয়ঙ্কর মূল্য।
অধ্যায় ৭: শান্তির শুভ্র প্রভাত
যখন সুমিত্রার জ্ঞান ফিরলো, তখন ভোরের প্রথম আলো জানালার পর্দা ভেদ করে ঘরের মেঝেতে এক নরম আভা ছড়াচ্ছে। তার চোখ খুলতেই সে দেখলো, সারা ঘর এক অদ্ভুত শান্তিতে ভরা। গত রাতের বিভীষিকা যেন এক দুঃস্বপ্ন ছিল, যার রেশ এখনো তার শরীর জুড়ে, কিন্তু মনে এক আশ্চর্য রকমের প্রশান্তি। তার শরীরটা ছিল অবসন্ন, যেন সে দীর্ঘ পথ হেঁটে এসেছে, কিন্তু তার মনটা ছিল শান্ত, এক গভীর নীরবতায় আচ্ছন্ন। সে বিছানায় শুয়ে ছিল, পাশেই খোলা পড়ে আছে অভ্রর ডায়েরি, আর তার হাতে ধরা সেই ভাঙা আয়নাটা। আয়নার কাঁচের টুকরোগুলো এখনো ভাঙা, কিন্তু সেগুলোকে আর ভয়ের প্রতীক মনে হচ্ছে না। বরং এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা তাদের ঘিরে রেখেছে।
ধীরে ধীরে সুমিত্রা উঠে বসল। তার শরীর তখনো ভারী, কিন্তু মনে এক অদ্ভুত হালকা অনুভব। সে জানালার দিকে তাকালো। বাইরে বৃষ্টির ছাঁট নেই, কালবৈশাখীর তাণ্ডব পুরোপুরি থেমে গেছে। আকাশ পরিষ্কার, ঝলমলে সূর্যের রোদ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে, প্রতিটি গাছপালা যেন নতুন করে প্রাণ পেয়েছে। বাতাসের মিষ্টি গন্ধ, পাখির কিচিরমিচির শব্দ—সবকিছুই যেন এক নতুন ভোরের আগমনী বার্তা দিচ্ছিল। সুমিত্রা অবাক হয়ে দেখলো, তার ঘরের মধ্যে কোনো অশরীরী উপস্থিতি নেই। গত রাতে যে শীতল বাতাস তাকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল, যে অশুভ ছায়া তাকে ঘিরে ধরেছিল, তার কোনো অস্তিত্ব নেই। ঘরটা সম্পূর্ণ শান্ত, যেন গতকাল রাতে কিছুই ঘটেনি। কিন্তু সুমিত্রা জানত, কিছু একটা ঘটেছিল, যা তার জীবনকে চিরতরে বদলে দিয়েছে।
সে ডায়েরিটা আবার হাতে তুলে নিল। পাতা উল্টে অভ্রর লেখাগুলো খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য যেন নতুন অর্থ নিয়ে ধরা দিচ্ছিল। অভ্রর লেখা সব সত্যি ছিল। নারীমূর্তিটা সত্যিই আয়নায় বন্দি ছিল, হাজার হাজার বছর ধরে সেই কাঁচের গভীরে একাকী যন্ত্রণায় ছটফট করছিল। কিন্তু এখন সে মুক্ত। সুমিত্রা অনুভব করলো, তার ভেতরের ভয়টা যেন কেটে গেছে, তার হৃদয়ে আর কোনো আতঙ্ক নেই। এক অদ্ভুত শান্তি তাকে আচ্ছন্ন করে আছে, যা সে আগে কখনো অনুভব করেনি। এটা কি সেই মুক্তি, যা অভ্র চেয়েছিল? নাকি তার নিজের মুক্তির সূচনা?
ডায়েরির মাঝের পাতায়, যেখানে নারীমূর্তির বন্দিত্বের বর্ণনা ছিল, সেই অংশটি এখন সম্পূর্ণ ভিন্ন দেখাচ্ছিল। অভ্রর অস্থির হাতে লেখা শব্দগুলো যেন মসৃণ হয়ে উঠেছে, আর পাতার পরতে পরতে যেন এক ধরণের আভা খেলা করছে। সুমিত্রা দেখলো, কিছু নতুন লাইন যোগ হয়েছে, যা অভ্রর হাতে লেখা ছিল না। সেখানে লেখা: “মুক্তির স্বাদ… এক অনন্ত শান্তি… ধন্যবাদ।”
সুমিত্রা বুঝতে পারলো, নারীমূর্তিটি হয়তো অভ্রর মাধ্যমে কথা বলছে, অথবা তার আত্মা এখন শান্তিতে আছে। তার মনে হলো, আয়নাটা হয়তো এক ধরণের সেতু ছিল, যা এই দুই জগতের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করেছিল। এখন যেহেতু নারীমূর্তিটি মুক্ত, তাই সেই সেতুও হয়তো বন্ধ হয়ে গেছে। তার মনে হলো, অভ্রর আত্মাও হয়তো সেই নারীমূর্তির সাথে এক ধরণের শান্তি খুঁজে পেয়েছে। তার হৃদয়ে যে ভারী শোক ছিল, তা যেন ধীরে ধীরে হালকা হয়ে আসছিল।
সেদিন সকালে সুমিত্রা এক নতুন জীবন শুরু করার সিদ্ধান্ত নিল। তার চারপাশে যে অদৃশ্য শক্তি ছিল, তা যেন এখন এক অদৃশ্য আশীর্বাদে পরিণত হয়েছে। সে ভাঙা আয়নার টুকরোগুলোর দিকে তাকালো, সেগুলো এখন আর ভয়ের প্রতীক নয়, বরং এক দীর্ঘমেয়াদী বন্দিত্ব থেকে মুক্তির এক স্মারক। সুমিত্রা জানত, সে একা নয়। অভ্রর ভালোবাসা এবং তার নিজের ভেতরের শক্তি তাকে যেকোনো পরিস্থিতির মোকাবিলা করার সাহস দেবে। এই নতুন ভোর, নতুন আলো, নতুন শান্তি—সবকিছুই যেন তাকে এক নতুন জীবনের দিকে আহ্বান করছিল, যেখানে ভয় নয়, বরং মুক্তিই তার পথপ্রদর্শক।
অধ্যায় ৮: শান্তির প্রতিবিম্ব
সুমিত্রা, এক গভীর শ্বাস নিয়ে, অভ্রর ডায়েরির শেষ পাতাটা খুললো। তার হাতে ধরা ভাঙা আয়নাটা এবার আর বিভীষিকার উৎস নয়, বরং এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতার প্রতীক। শেষ পাতায় অভ্রর হাতের লেখাগুলো ছিল স্পষ্ট, যেন তার শেষ বার্তা: “সে মুক্ত হয়েছে। সে আমার কাছে ক্ষমা চেয়েছে। সে এখন শান্তিতে আছে।” এই বাক্যগুলো সুমিত্রার মনে এক গভীর শান্তি এনে দিল। অভ্রর যন্ত্রণা, তার অস্থিরতা—সবকিছুর অবসান হয়েছে। নারীমূর্তিটি, যে এতকাল আয়নার কাঁচের গভীরে বন্দি ছিল, সে অবশেষে মুক্তি পেয়েছে।
কিন্তু সুমিত্রার চোখ আটকে গেল অভ্রর লেখার ঠিক নিচে। সেখানে ছিল একটি ছোট হাতে লেখা। সুমিত্রা চমকে উঠলো, কারণ এই লেখা অভ্রর হাতের লেখা ছিল না। অক্ষরগুলো ছিল সূক্ষ্ম, যেন বাতাসের ওপর দিয়ে ভেসে যাওয়া কোনো অদৃশ্য সত্তার ছোঁয়া। সেখানে লেখা ছিল: “আমি মুক্ত। ধন্যবাদ।”
এই কয়েকটি শব্দ সুমিত্রার মনে এক নতুন উপলব্ধি এনে দিল। এটা কি তবে সেই নারীমূর্তির বার্তা? সে কি সত্যিই মুক্তি পেয়ে সুমিত্রাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে? সুমিত্রার মনে হলো, এই লেখাটা যেন শুধু অক্ষর নয়, এটা ছিল এক অতৃপ্ত আত্মার শেষ নিঃশ্বাস, এক গভীর কৃতজ্ঞতার প্রকাশ। তার মনে হলো, নারীমূর্তিটি হয়তো শুধু প্রতিহিংসাপরায়ণ ছিল না, সে নিজেও ছিল হাজার বছরের বন্দিত্বের শিকার, একাকীত্বের যন্ত্রণায় জর্জরিত।
সুমিত্রা বুঝলো, অভ্রর আত্মাও হয়তো শান্তি পেয়েছে। হয়তো অভ্র সেই নারীমূর্তিকে মুক্তি দিয়ে নিজেই মুক্তি পেয়েছিল এবং তার আত্মাও সেই নারীমূর্তির সাথে এক ধরণের শান্তি খুঁজে পেয়েছে। তার হৃদয়ে যে ভারী শোকের পাথর জমে ছিল, তা যেন ধীরে ধীরে হালকা হয়ে আসছিল। সে অনুভব করলো, সে আর একা নয়। অভ্রর আত্মা তার সাথে আছে, এক অদৃশ্য সুরক্ষার মতো তাকে ঘিরে রেখেছে।
সে ভাঙা আয়নাটার দিকে তাকালো। আয়নার টুকরোগুলো আগের মতোই ভাঙা, কিন্তু এখন সেগুলোর দিকে তাকালে তার আর ভয় লাগছে না। বরং এক অদ্ভুত শান্তি অনুভব করছে সুমিত্রা। আয়নার প্রতিটি ফাটল, প্রতিটি ভাঙা অংশ যেন এখন এক একটি গল্পের শেষ, এক নতুন শুরুর ইঙ্গিত। এটি এখন আর এক অশুভ শক্তির বাহক নয়, বরং এক অতৃপ্ত আত্মার শান্তির প্রতীক হয়ে উঠলো। সুমিত্রা আয়নাটাকে যত্ন করে তুলে রাখলো, যেন এটি তার জীবনের এক নতুন অধ্যায়ের স্মারক।
সুমিত্রা জানতো, তার জীবন নতুন মোড় নিয়েছে। অভ্রর অনুপস্থিতি তাকে একা করে দিলেও, সে এখন আর ভীত নয়। তার ভেতরের শক্তি, যা এই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে সে অর্জন করেছে, তা তাকে যেকোনো পরিস্থিতির মোকাবিলা করার সাহস দেবে। সে জানত, অভ্রর ভালোবাসা এবং তার নিজের ভেতরের অদম্য সাহস তাকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে।
ফ্ল্যাটের চারপাশের বাতাস ছিল শান্ত, যেন দীর্ঘদিনের জমে থাকা এক বিষণ্ণতা কেটে গেছে। সূর্য জানালার বাইরে উজ্জ্বলভাবে জ্বলছিল, যেন এক নতুন জীবনের আহ্বান জানাচ্ছিল। সুমিত্রা জানত, এই ভাঙা আয়নাটা শুধু একটি বস্তু নয়, এটি তার জীবন, অভ্রর জীবন, এবং সেই নারীমূর্তির জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে থাকবে। হয়তো কিছু রহস্য অনুন্মোচিতই থেকে যাবে, কিন্তু সুমিত্রা এখন নতুন করে বাঁচতে প্রস্তুত। ভাঙা আয়নার প্রতিবিম্ব এখন আর ভয়ের প্রতিচ্ছবি নয়, বরং তা ছিল মুক্তি ও শান্তির এক নীরব সাক্ষ্য।
শেষ

ছবি এআই
© পিনাকী রঞ্জন পাল