রাজ্য সভাপতির আত্মসমালোচনা, অর্জুনের আন্দোলনের হুমকি – জোড়া বিড়ম্বনায় বঙ্গ বিজেপি

অরুণ কুমার : একদিকে রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের আত্মসমালোচনা, অপরদিকে সাংসদ অর্জুন সিং এর কেন্দ্রের বিরুদ্ধে আন্দোলনের হুমকি – এই জোড়া বিড়ম্বনায় কার্যত জেরবার বিজেপির বঙ্গ ব্রিগেড। আর কয়েকদিন পরেই পশ্চিমবঙ্গ সফরে আসতে চলেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সেনাপতি অমিত শাহ। দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই সফরের আগে বঙ্গ বিজেপির দুই হেভিওয়েট নেতার উক্তি নিঃসন্দেহে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতাদের রাজনৈতিক দিক থেকে বিড়ম্বনায় ফেলেছে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই বলে মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল ।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সফরকালের আগে রাজ্য বিজেপির সভাপতির মুখে স্বীকারোক্তি বা আত্ম সমালোচনা দলের বাকি অংশের কাছে ব্যুমেরাং হয়ে পড়তে পারে বলে রাজনৈতিক মহলের ধারণা।

উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বেশ কয়েক’দিন ধরেই প্রাক্তন ও বর্তমান দলের রাজ্য সভাপতির মধ্যে টানাপড়েন নিয়ে তোলপাড় বঙ্গ বিজেপি। নিজেদের মধ্যে দলাদলিই যে বিজেপির রাজ্য জয়ের স্বপ্ন নষ্ট করেছে, তা স্পষ্ট করেছেন রাজ্য সভাপতি। গত বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে গেরুয়া শিবির যে আওয়াজ দিয়েছিল, ‘এ বার দুশো পার’। বাস্তবে অবশ্য দুশো ছাপিয়ে গেছে তৃণমূল। আর বিজেপিকে থামতে হয়েছে একশোরও অনেকটা আগে। সুকান্তের কথায়, ‘‘আমাদের একজন টিকিট পেয়েছে, আর দু’জন মিলে তাঁর পিছনে লেগে যাচ্ছে। এই ভেবে যে তিনি হারলে পরের বার আমার সুযোগ হবে। এই মানসিকতা থেকে যতক্ষণ না পর্যন্ত আমরা বেরোতে পারব, ততক্ষণ বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসতে পারবে না।’’ রাজ্যে ক্ষমতায় আসার যোগ্য হয়ে ওঠেনি বিজেপি -এই আত্ম সমালোচনার সুরে এমন মত শোনা গেল খোদ দলের রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের মুখে। শুধু তা-ই নয়, ভোটের লড়াইয়ের কৌশল তৃণমূলের কাছ থেকে শেখার পরামর্শও দিয়েছেন তিনি।

রবিবার মেদিনীপুরে দলের সাংগঠনিক বৈঠকে ফলাফলের পর্যালোচনা করতে গিয়ে রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার এই মন্তব্য করেছেন, ‘‘আমরা কর্মীদের বলছি, কিছু বলার থাকলে উপরে বলবেন। আর আমরা নিজেরাই চায়ের দোকানে গিয়ে অন্যের সম্পর্কে বলছি। মানুষ অত বোকা নয়। মানুষ সব দেখে। আমরা ক্ষমতায় আসার যোগ্য হইনি।’’ বিধানসভা ভোটের সময় রাজ্য সভাপতি পদে ছিলেন দিলীপ ঘোষ। তাঁকে পাশে বসিয়েই সুকান্ত বলেছেন, ‘‘আমরা দুশোর স্বপ্ন নিয়ে এগোলাম। ‘সরকার গড়ছি, সরকার গড়ছি’, এমন একটা হাইপে চলে গেলাম। লোককে স্বপ্ন দেখানোর কথা ছিল। উল্টে নিজেরাই স্বপ্ন দেখে সেই স্বপ্নের মধ্যে নাচতে শুরু করলাম। তারপর যা হয়, বেশি স্বপ্ন দেখলে। ধপাস করে নীচে পড়লাম।’’ মেদিনীপুরে বিজেপির এই সাংগঠনিক বৈঠকে আগাগোড়া আত্মসমালোচনার সুর ছিল সুকান্তের গলায়।

নিজের বক্তব্যের শুরুতে ‘ভারত মাতা কি জয়’ ধ্বনি তোলেন তিনি। তারপরেই বলেন, ‘‘এই হলে ১০-১২ জন আছেন, যাঁরা মুখই খুললেন না (জয় বললেন না)। হাততালি দেওয়ার সময়েও সবার হাততালি পড়ে না। আর আমরা পরিবর্তন করব? কেউ ভোট দেবে না আমাদের এই অবস্থা দেখলে।’’ দিলীপকে পাশে রেখে সুকান্ত আরও চাঁচাছোলা শব্দে বলেছেন, ‘‘আগে ছিল পার্টিকে ছোট থেকে বড় করার চ্যালেঞ্জ। এখন চ্যালেঞ্জ অন্য। আপনি পরীক্ষায় ১০ পাচ্ছেন। ১০ থেকে ৪০ বা ৫০ বা ৬০ পাওয়া সোজা। কিন্তু ৬০ থেকে ৯০ পাওয়া বেশ কঠিন।’’ এরপরেই তৃণমূলকে দেখে শেখার কথা বলেছেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি। বৈঠকে সুকান্তের মন্তব্য, ‘‘তৃণমূলকে দেখুন। গোটা বছর নিজেরা মারামারি করছে। কিন্তু যখন ভোট আসে, সব চোর একসঙ্গে হয়ে যায়। কারণ ওরা জানে, ভোটটা যদি জিততে না-পারি, তা হলে আর তোলাটা তুলতে পারব না। আর আমরা করছি উল্টোটা। গোটা বছর সবার সঙ্গে হাত ধরে ‘ভারত মাতা কি জয়’ বলতে বলতে যাচ্ছি। আর ভোটের সময়ে যেই প্রার্থী ঘোষণা হয়ে গেল, শুরু হয়ে গেল কেমন করে তাঁকে হারানো যায়, সেটা ভাবা। এ ভাবে ভোটে জেতা যায় না।’’

কর্মীদের উদ্দেশে সুকান্তের আরও বার্তা ‘‘আমাদের বুথ সভাপতিও আশা করেন, রাজ্য সভাপতিকে ফোন করব। তৃণমূলের একটা ব্লক সভাপতিকে বলুন তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ফোন করতে। আসলে আপনি নিজের দলের রাজ্য সভাপতিকেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সমগোত্রীয় মনে করছেন না। সেটা দিলীপদা হোক, আমি হই কিংবা যেই হন। আপনি তো আপনার নেতাকেই যোগ্য মনে করছেন না। তা হলে জনগণ কেন মনে করবে?’’ এ তো গেল রাজ্য সভাপতির আত্মসমালোচনার বিভিন্ন দিক।

অপরদিকে, দলের আরেক হেভিওয়েট সাংসদ অর্জুন সিংও কয়েক দিন ধরে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে আন্দোলনের হুমকি দিয়ে আসছেন। প্রথমে বস্ত্রমন্ত্রী পীযূষ গোয়েল এর বিরুদ্ধে ও তারপর জুট কর্পোরেশন এর অফিসের সামনে আন্দোলনের হুমকি দিয়েছেন তিনি। এর ফলে যারপরনাই বিরম্বনায় বিজেপির বঙ্গ ব্রিগেড। ব্যারাকপুরের সাংসদ অর্জুন সিং বলেছেন, জুট কর্পোরেশনের দুর্নীতির কারণেই পাটশিল্প ধ্বংসের মুখে। ১৩ ডিসেম্বর আমি ও লকেট জুট কর্পোরেশনের সঙ্গে বৈঠক করেছি। সরকারি বৈঠকের মিনিটস কেন প্রকাশ করা হচ্ছে না? প্রত্যেক টনে আড়াই হাজার টাকা ক্ষতি করে কতদিন চলবে জুটমিল?

সাংসদ অর্জুন সিং এর আরো অভিযোগ,
ইতিমধ্যেই ১৪টি কারখানা বন্ধ হয়েছে, আরও ১০টি বন্ধ হবে।’’ তাঁর অভিযোগ, “ধারাবাহিকভাবে পাটশিল্পকে ধ্বংস করার চেষ্টা চলছে। জুট কর্পোরেশনের কর্তা মলয় চক্রবর্তী প্লাস্টিক লবিকে ঢোকানোর চেষ্টা করছেন। ব্যারাকপুরে বর্তমানে মাত্র ১৭টি জুটমিল চালু আছে।‘’ একইসঙ্গে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটির গঠনের দাবিও করে ব্যারাকপুরের বিজেপি সাংসদ বলেন, “বর্তমান জুট কমিশনার দুর্নীতিগ্রস্ত। বর্তমান জুট কমিশনার মলয় চক্রবর্তী প্লাস্টিক লবির কাছের লোক। এই দুর্নীতি খুঁজতে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি তৈরি করা হোক। কেন্দ্রীয় বস্ত্রমন্ত্রীকে অনুরোধ করছি, সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করুন। প্রধানমন্ত্রীকেও চিঠি দিয়ে অনুরোধ করেছি। দ্রুত প্রধানমন্ত্রী হস্তক্ষেপ করুন, কারণ ২ কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। মুখ্যমন্ত্রী বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখুন। বাংলা, ওড়িশা, অসম, বিহারের মুখ্যমন্ত্রীর সরব হওয়া দরকার। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ট্রেড ইউনিয়নগুলির সঙ্গে আলোচনা করুন। দিলীপ ঘোষ, সুকান্ত মজুমদার, শুভেন্দু অধিকারী আমায় সমর্থন করেছেন। তৃণমূল ও বাম শ্রমিক সংগঠনও আমায় সমর্থন করেছেন। দু-একদিনের মধ্যে জুট কমিশনারের অফিসে ধর্না দেব।”

এদিকে রাজ্য বিজেপির শীর্ষনেতৃত্বের এই মূল্যায়ন নিয়ে কটাক্ষ করতে ছাড়েনি রাজ্যের ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস। দলের মুখপাত্র সুখেন্দু শেখর রায় বলেন, ‘‘ওঁরা হেরেছেন কিন্তু হারের কারণ বোঝেননি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হারাতে গেলে তাঁর বিকল্প চাই। তাঁর লড়াই, ভাবনা, পরিকল্পনা, কাজের বিকল্প বিজেপিতে কোথায়? এটা যতক্ষণ না বুঝবেন ততক্ষণ মায়াকল্পে থাকবেন। দখলদারির মনোভাব নিয়ে গণতন্ত্রে জয় পাওয়া যায় না।’’ সাংসদ অর্জুন সিং এর আন্দোলনের হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে তার প্রতিক্রিয়া, এবার হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে ওই দলের সাংসদরা তাই অর্জুন সিং আন্দোলনের হুমকি দিয়েছেন, এরপর অনেকেই আসবেন।

দেশের অন্যতম হেভিওয়েট নেতা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের পশ্চিমবঙ্গ সফরের আগে রাজ্য বিজেপি নেতাদের এ ধরনের উক্তি ও আচরণ কেন্দ্রীয় নেতাদের অজানা থাকার কথা নয়। তাই এখন দেখার বিষয় যে কেন্দ্র রাজ্য নেতৃত্ব যে বিষয়ে কি পদক্ষেপ নিতে চলেছেন আগামী দিনে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *