Cricket : IPL নিলামে বাংলাদেশি ক্রিকেটাররা উপেক্ষিত : কারণ কী?

পিনাকী রঞ্জন পাল : দুদিনব্যাপী আইপিএলের ২০২৪ মেগা নিলামে খরচ হয়েছে ৬৩৯.১৫ কোটি টাকা। দল পেয়েছেন ১৮২ জন ক্রিকেটার। কিন্তু বিস্ময়ের বিষয় হলো, এই বিশাল নিলামের তালিকায় থাকা ১২ জন বাংলাদেশি ক্রিকেটারের কেউই দল পাননি। এমনকি নিলামে ডাক পেয়েছেন মাত্র দুইজন—পেসার মুস্তাফিজুর রহমান এবং লেগ স্পিনার রিশাদ হোসেন। কিন্তু তাঁদের নাম ঘোষণার পরও দর হাঁকেনি কোনো দল। ফলে তাঁরা রয়ে গেলেন “Unsold” তালিকায়। প্রশ্ন উঠছে, কেন এমনটা হলো?

মুস্তাফিজুর: অতীতের তারকা, বর্তমানে অনাগ্রহের শিকার

মুস্তাফিজুর রহমান, যিনি ২০১৬ সালে আইপিএলে অভিষেকেই সানরাইজার্স হায়দরাবাদের হয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন, তাঁর প্রতি এবার কেন আগ্রহ দেখানো হলো না? প্রথম আসরেই সেরা উদীয়মান খেলোয়াড়ের পুরস্কার জয়ী মুস্তাফিজ, আইপিএলের মতো একটি মঞ্চে ধারাবাহিকভাবে নিজের প্রতিভার ছাপ রেখেছেন। ২০১৬ সালে ১৬ ম্যাচে ১৭ উইকেট নিয়ে সানরাইজার্সকে শিরোপা জিতিয়েছিলেন। এরপর মুম্বই ইন্ডিয়ান্স, রাজস্থান রয়্যালস, দিল্লি ক্যাপিটালস এবং চেন্নাই সুপার কিংসের মতো শীর্ষ দলগুলোতে খেলেছেন।

কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তাঁর ফর্ম নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। গত ভারত সফরের তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজে ১১.২৭ ইকোনমি রেটে কেবল ৪ উইকেট নেওয়া মুস্তাফিজকে ঘিরে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর আস্থা কমেছে। তাছাড়া, তাঁর বেস প্রাইস ২ কোটি টাকা, যা অনেক দলই হয়তো অতিরিক্ত মনে করেছে। মুস্তাফিজের ফর্মের সাথে বিসিবি’র আচরণও দলগুলোর সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলেছে। গত মৌসুমে চেন্নাই সুপার কিংসের হয়ে দুর্দান্ত ছন্দে থাকলেও তাঁকে হঠাৎ বাংলাদেশ দলের খেলার জন্য তুলে নেওয়া হয়। এর ফলে তাঁর ফর্মে ছেদ পড়ে, যা ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর অসন্তোষ বাড়িয়েছে।

সাকিব: একসময়ের নির্ভরযোগ্য নাম এখন কেন উপেক্ষিত?

সাকিব আল হাসান, যিনি এক সময় আইপিএলের অন্যতম সফল অলরাউন্ডার হিসেবে পরিচিত ছিলেন, এবারও দল পাননি। সাকিবের পড়তি ফর্ম এবং বয়স সম্ভবত এর পেছনের কারণ। একসময় কলকাতা নাইট রাইডার্সের হয়ে টানা ছয় বছর খেলেছেন এবং দুটি শিরোপা জিতেছেন। পরবর্তীতে হায়দরাবাদে সফল দুই বছর কাটানোর পর আবার কলকাতায় ফিরে যান। আইপিএলে তাঁর পরিসংখ্যান যথেষ্টই ভালো—৭১ ম্যাচে ৬৩ উইকেট এবং ৭৯৩ রান।

তবুও, সাম্প্রতিক সময়ের পারফরম্যান্স এবং ফ্র্যাঞ্চাইজিদের প্রতি বিসিবি’র আচরণের কারণে তাঁকে নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। গতবারও সাকিব দল পাননি, যা তাঁর বাজারমূল্যকে প্রভাবিত করেছে। সাকিবের মতো একজন অভিজ্ঞ অলরাউন্ডারকে নিয়ে এমন সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য হতাশাজনক।

তরুণ প্রতিভারা কেন অবিক্রিত?

এবারের নিলামে থাকা অন্যান্য বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের মধ্যে তাসকিন আহমেদ, তাওহীদ হৃদয়, লিটন দাস এবং হাসান মাহমুদের মতো তরুণ প্রতিভারা দল পাওয়ার ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েন। তাঁদের অনেকেরই আন্তর্জাতিক মঞ্চে পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতা না থাকা বা আইপিএলে খেলার অতীত না থাকায় ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো তাঁদের নিয়ে ঝুঁকি নিতে চায়নি।

রিশাদ হোসেনের বেস প্রাইস ছিল ৭৫ লক্ষ টাকা। তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাঁর পারফরম্যান্স এখনো অজানা হওয়ায় ফ্র্যাঞ্চাইজিরা তাঁকে দলে নেওয়ার আগ্রহ দেখায়নি। এছাড়া, লিটন দাসের মতো ক্রিকেটার, যিনি গত মৌসুমে কলকাতা নাইট রাইডার্সের হয়ে খেলেছিলেন, তিনিও এবার দল পাননি।

বিসিবি’র ভূমিকা: সমস্যা কোথায়?

বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) আচরণ এবং ক্রীড়াসূচির অস্বচ্ছতা এবার বড় ভূমিকা রেখেছে। অন্যান্য দেশের বোর্ড আগেই আইপিএল সূচির সঙ্গে নিজেদের আন্তর্জাতিক সূচি সমন্বয় করে। ফলে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো সহজেই বুঝতে পারে, কোন খেলোয়াড়কে কতদিন পাওয়া যাবে। বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি অনুপস্থিত।

গতবার লিটন দাস এবং মুস্তাফিজুর রহমানকে মাঝপথে আইপিএল থেকে তুলে নিয়ে আন্তর্জাতিক সিরিজে খেলানো হয়। এতে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর প্রতি বিসিবি’র উদাসীন মনোভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আইপিএল দলগুলো কেবল পারফরম্যান্স নয়, পেশাদারিত্ব এবং নির্ভরযোগ্যতাকেও গুরুত্ব দেয়। বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের ঘিরে এমন অনিশ্চয়তা তাই তাঁদের প্রতি ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর আস্থা কমিয়েছে।

বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কী?

বাংলাদেশি ক্রিকেটাররা আইপিএলে দল না পাওয়ার এই পরিস্থিতি কেবল হতাশাজনক নয়, বরং বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য বড় একটি শিক্ষাও। যদি ভবিষ্যতে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের আইপিএলে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হয়, তাহলে বিসিবি’কে তাদের ক্রীড়াসূচি আরও সুসমন্বিত করতে হবে। পাশাপাশি খেলোয়াড়দের আইপিএল মঞ্চে নিজেদের ফিটনেস এবং ফর্ম ধরে রাখতে হবে।

মুস্তাফিজুর, সাকিব, বা তরুণ তারকা তাওহীদ হৃদয়দের মতো প্রতিভারা আইপিএলের মতো প্রতিযোগিতায় অংশ নিলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের অবস্থান আরও শক্তিশালী হবে। তবে তার জন্য প্রয়োজন সঠিক দিকনির্দেশনা, কৌশলগত সমন্বয়, এবং পেশাদারিত্ব।

বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের প্রতি এই উপেক্ষা সাময়িক হলেও, এটি একটি কঠিন বাস্তবতা। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেট বোর্ড এবং খেলোয়াড়দের আত্মবিশ্লেষণের সুযোগ তৈরি হয়েছে। সঠিক পদক্ষেপ নিলে, হয়তো আগামীতে আইপিএলের মঞ্চে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের আরও উজ্জ্বল উপস্থিতি দেখা যাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *