ক্রিকেট মানেই উন্মাদনা, কিন্তু IPL? এটা শুধু খেলা নয়, এক বিশাল বাণিজ্যিক সাম্রাজ্য! জানেন কি, এক ধুরন্ধর ব্যবসায়ী কীভাবে ক্রিকেট প্রশাসনের ভিত কাঁপিয়ে দিয়ে জন্ম দিলেন IPL-এর? IPL-এর জন্মের চমকপ্রদ কাহিনি শোনাচ্ছেন পিনাকী রঞ্জন পাল।
ক্রিকেট প্রেমীরা আজ আইপিএল (IPL) মানেই চোখের সামনে ভাসে রঙিন জার্সি, বলিউড গ্ল্যামার, স্টেডিয়ামে উন্মাদনা আর কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য। কিন্তু জানেন কি, এই আইপিএলের জন্মই হয়েছিল এক ধুরন্ধর ব্যবসায়ীর মগজ থেকে? ক্রিকেটের বাইরের এক সাধারণ মানুষ, যার কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না ক্রিকেট প্রশাসনে, তিনি কীভাবে বিসিসিআই-এর ভিত কাঁপিয়ে দিলেন? কিভাবে তৈরি হলো আইপিএল, যা আজ গোটা বিশ্বকে মাতিয়ে রেখেছে? আসুন, জেনে নেওয়া যাক সেই রুদ্ধশ্বাস গল্প— যা যেকোন ওয়েব সিরিজের থ্রিলারকেও হার মানাবে!
২০০৩ সালের ৪ ডিসেম্বর, রাজস্থানে বিধানসভা ভোটের ফল প্রকাশের দিন। সকালে খবরের কাগজে প্রকাশিত এক বিশাল বিজ্ঞাপন বলল, “বিজেপি ১২০ আসন পাবে।” বিকেলেই দেখা গেল, ফলাফল মিলল হুবহু! এই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন ললিত মোদি, যিনি রাজস্থানের রাজনীতি ও ব্যবসার বড় নাম। আর সেদিন রাতে রাজস্থানের সম্ভাব্য মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়ার পার্টিতে দাঁড়িয়ে ললিত মোদি ঘোষণা করলেন— “এবার আমার লক্ষ্য ক্রিকেট! ”কিন্তু প্রশ্ন হলো, কেন তিনি এত আগ্রহী ছিলেন ক্রিকেটে? কারণ, ক্রিকেট মানেই টাকা! কোটি কোটি টাকা!
এরপর যা হলো, তা বলিউডের সিনেমাকেও হার মানাবে। কিভাবে জন্ম নিল আইপিএল?
২০০৫ সালে রাজস্থানে ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিয়ে ফেললেন ললিত মোদি। কিন্তু আসল লক্ষ্য ছিল আরও বড়— ক্রিকেটকে ব্যবসা বানানো। তিনি ২০০১ সালেই বিসিসিআইয়ের কাছে শহরভিত্তিক টি-টোয়েন্টি লিগের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, কিন্তু তৎকালীন বোর্ড প্রেসিডেন্ট জগমোহন ডালমিয়া তাকে পাত্তাই দেননি।
সুযোগ এল ২০০৫ সালে, বিসিসিআই নির্বাচন। মোদি BJP ও রাজনৈতিক সংযোগ কাজে লাগিয়ে শারদ পাওয়ারকে বিসিসিআই প্রেসিডেন্ট বানাতে সাহায্য করলেন। এরপর ক্রিকেটের ক্ষমতার রাশ পুরোপুরি চলে গেল তার হাতে।
২০০৭ সালে জি টিভির মালিক সুভাষ চন্দ্র শুরু করলেন ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লিগ (ICL) — যা ছিল বিসিসিআই-বহির্ভূত একটি বিদ্রোহী লিগ। এতে কপিল দেব, ব্রায়ান লারা -এর মতো তারকারা যোগ দেন।
মোদি বুঝলেন, যদি এটা সফল হয়, তাহলে বিসিসিআই হারিয়ে যাবে। তখনই তিনি বোর্ডকে বোঝালেন— “আমরাও টি-টোয়েন্টি লিগ চালু করি, নয়তো ক্রিকেট বেসরকারি হাতের চলে যাবে।”
কিন্তু ভাগ্য যখন পাল্টায়, তখন সব দিক থেকেই পাল্টায়! ২০০৭ সালে ভারত যখন প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতলো, তখন পুরো দেশে ছোট ফরম্যাটের ক্রিকেটের জন্য এক উন্মাদনা তৈরি হলো। এই সুযোগটাই কাজে লাগালেন মোদি। ২০০৮ সালে জন্ম নিল ‘ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ’ (IPL)।
২০০৮ সালে ঘোষণা হলো “ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ” (আইপিএল)। শহরভিত্তিক ফ্র্যাঞ্চাইজি মডেলে তৈরি হলো আটটি দল। দাম উঠল আকাশছোঁয়া! শাহরুখ খানের KKR, মুকেশ আম্বানির MI, বিজয় মালিয়ার RCB— সবাই কোটি কোটি টাকা ঢাললেন। মোদি নিজেও পিছন থেকে টাকা ঢাললেন— তৈরি হলো জয়পুরের দল (রাজস্থান রয়্যালস)। এমনকি গোপনে কলকাতা নাইট রাইডার্স ও কিংস ইলেভেন পাঞ্জাবেও অর্থ লগ্নি করেছিলেন তিনি!
১৮ এপ্রিল ২০০৮— আইপিএলের প্রথম ম্যাচ! ব্রেন্ডন ম্যাককালামের ১৫৮ রানের ঝড়ো ইনিংস গোটা বিশ্বকে দেখিয়ে দিল, ক্রিকেট শুধু খেলা নয়, এটা এক বিশাল বিনোদন শিল্প!
তারপর যা ঘটলো, তা ইতিহাস! আইপিএল হয়ে উঠলো ক্রীড়া ও বিনোদনের সবচেয়ে বড় মঞ্চ। বলিউডের তারকা, ব্যবসায়ীদের বিপুল বিনিয়োগ আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটারদের অংশগ্রহণ এটিকে বিশ্বের অন্যতম ধনী লিগে পরিণত করলো। তবে এখানেই শেষ নয়!
টাকার লোভে আইপিএলের মধ্যেই কালো ছায়া পড়তে শুরু করলো— ম্যাচ ফিক্সিং, বেটিং, ক্ষমতার লড়াই! আর এসবের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন ললিত মোদি নিজেই! দুর্নীতির অভিযোগে ২০১০ সালে বিসিসিআই থেকে বহিষ্কৃত হন তিনি। আর মোদি বিদেশে পালিয়ে যান!
কিন্তু তিনি না থাকলেও, তার সৃষ্টি আইপিএল এখনো টিকে আছে। বরং আরও বড় হয়েছে, আরও জনপ্রিয় হয়েছে! আজ এটি শুধু ক্রিকেট নয়, এটি ভারতীয় অর্থনীতির এক বিশাল অংশ, যা কোটি কোটি টাকা আয় করে প্রতি বছর। আজ আইপিএল শুধু একটা লিগ নয়, এটা একটা “ব্র্যান্ড”, একটা “উৎসব”!
তবে প্রশ্ন থেকে যায়— ক্রিকেট না কি ব্যবসা, কোনটা বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে এই আইপিএলে?