‘বয়ফ্রেন্ড’ মানেই প্রেম নয়—এটি হতে পারে ভরসাযোগ্য বন্ধু, পরামর্শদাতা কিংবা প্রেরণার উৎস। আধুনিক তরুণীরা আজ সচেতন, সম্পর্ক নিয়ে ভাবনাও বাস্তববাদী। এই নিবন্ধে উঠে এসেছে মেয়েদের দৃষ্টিভঙ্গি ও সমাজের দ্বন্দ্ব, যেখানে সম্পর্ক মানেই বাধা নয়, হতে পারে শক্তিও।
সমাজ বদলাচ্ছে। বদলাচ্ছে মানুষের চাহিদা, রুচি, সম্পর্কের সংজ্ঞা এবং নিজস্বতা গড়ার ভাবনা। একবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে দাঁড়িয়ে যেখানে মেয়েরা আকাশ ছুঁতে চাইছে, সেখানে ‘বয়ফ্রেন্ড’ নামক সম্পর্ককে ঘিরে আজও রয়েছে নানা ছুঁৎমার্গ, প্রশ্ন এবং দ্বন্দ্ব। একদিকে যেমন মেয়েরা স্বাধীনচেতা এবং স্বনির্ভরতার পথে এগিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে সমাজের একাংশ এখনো এই বন্ধুত্বকে পুরনো কাঠামোতে বিচার করছে।
‘বয়ফ্রেন্ড’—এই শব্দটি কি কেবল প্রেমের? না কি সে হতে পারে একজন পরামর্শদাতা, সহায়ক, বন্ধুবৎসল সহচর? মেয়েদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে আজ আমরা এই সম্পর্ককে এক নতুন আলোয় দেখতে চাইলাম। আলোচনার ভিত্তিতে থাকল কয়েকজন তরুণীর ব্যক্তিগত মত, যাঁরা তাঁদের জীবন, কেরিয়ার ও বন্ধুত্বের পরিসরে এই সম্পর্ককে কীভাবে দেখছেন, সে কথা অকপটে বলেছেন।
আত্মনির্ভরতার যুগে মেয়েরা: সম্পর্কের সংজ্ঞা কি বদলাচ্ছে?
সাম্প্রতিক বছরগুলিতে মেয়েদের চিন্তাভাবনায় এসেছে স্পষ্ট পরিবর্তন। পৌষালী বোসের কথায় ফুটে ওঠে এই বাস্তবতা। তাঁর বক্তব্য—বয়ফ্রেন্ড থাকা অন্যায় নয়, কিন্তু সেই ‘বন্ধু’র নির্বাচন ঠিক না হলে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এখানে বিষয়টা সম্পর্কের অস্তিত্ব নয়, বরং তার মানদণ্ড কীভাবে নির্ধারিত হবে সেটাই জরুরি।
বয়সন্ধির মনস্তত্ত্ব, কলেজ জীবনের আকর্ষণ এবং কেরিয়ার গঠনের প্রতিযোগিতা—সব মিলিয়ে সম্পর্ক নিয়ে সচেতন থাকার গুরুত্ব বাড়ছে। সম্পর্ক থাকবে, তবে সম্পর্ক যেন লক্ষ্যভ্রষ্ট না করে, এই চেতনা এখন অনেক মেয়ের মধ্যেই দেখা যাচ্ছে।
আধুনিকতা বনাম সমাজ: দীপাঞ্জনার তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ
দীপাঞ্জনা চক্রবর্তীর বক্তব্য আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় এক অস্পষ্ট সংকট—‘বয়ফ্রেন্ড’ থাকা কি শুধুই ফ্যাশন? নাকি সেই সম্পর্কটি ব্যক্তির নিজস্ব চিন্তাধারার ফসল?
তিনি বলেন, বন্ধুত্বের সংজ্ঞা আজ সংকীর্ণ হচ্ছে, কারণ বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড শব্দদুটি যেন সম্পর্কের সার্বিকতাকে এক কোণঠাসা করে ফেলেছে। এই আধুনিকতার দোহাই দিয়ে অনেকেই সম্পর্ককে কেবল বাহ্যিক ‘স্ট্যাটাস সিম্বল’ করে তুলছেন। এমন হলে কেরিয়ারের ক্ষতি অনিবার্য।
এই পর্যবেক্ষণে রয়েছে একটি সতর্কতা—দ্বৈত পথে হাঁটতে গেলে ভারসাম্য হারালে সবকিছু ভেঙে পড়তে পারে। এখানে দীপাঞ্জনা কেবল সতর্ক করছেন না, বরং বলছেন—ক্ষমতা থাকলে দুটি পথেই সফল হওয়া সম্ভব, কিন্তু তার জন্য চাই সচেতনতা ও নিয়ন্ত্রণ।
মৌমিতার মত: বন্ধুত্ব বনাম প্রেম—দুটি ভিন্ন জগৎ
মৌমিতা পালের মতামত সামাজিক মানসিকতার অন্যতম প্রতিচ্ছবি। তিনি সরাসরি বলেন—এই দেশে এখনও ছেলেমেয়ের বন্ধুত্ব মানেই প্রেম বলে ধরে নেওয়া হয়। অথচ তাঁর বক্তব্য, বয়ফ্রেন্ড মানেই প্রেমিক নয়; তিনি একজন ‘সহজ সঙ্গী’ও হতে পারেন।
এই যুক্তি এক গভীর অন্তর্দৃষ্টি এনে দেয়—সম্পর্কের কাঠামোকে ‘লেবেল’ দিয়ে বিচার করা কি আদৌ ঠিক? মৌমিতা একজন বয়ফ্রেন্ডের মধ্যে বন্ধুত্ব, সমঝোতা, শেয়ার করার জায়গা খোঁজেন, যা অনেক সময় বান্ধবীদের মধ্যেও পাওয়া যায় না। সমাজের চোখে যা প্রেম, ব্যক্তির কাছে তা হতে পারে আত্মিক বন্ধুত্বের নামান্তর।
লোপামুদ্রার বিশ্বাস: নির্ভরযোগ্য বন্ধু কি প্রেমিকও?
বন্ধু মানে কে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া যায় লোপামুদ্রা ব্যানার্জির মতামতে। তাঁর ভাষায়, “বন্ধু তাকে বলে যার সঙ্গে সংকোচহীনভাবে মনের কথা বলা যায়।” এই সংজ্ঞা অনুযায়ী তাঁর বন্ধুত্বের সংজ্ঞায় ‘বয়ফ্রেন্ড’ একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে।
তাঁর মতে, মেয়েরা সাধারণত কথোপকথনের মাধ্যমে আবেগ প্রকাশ করতে স্বচ্ছন্দ। কিন্তু বান্ধবীদের সঙ্গে সেই কথোপকথন অনেক সময় ব্যক্তিগততা হারিয়ে ফেলে। অথচ ছেলেবন্ধুর ক্ষেত্রে সেই কথাগুলি থেকে যায় ‘নিরাপদ’ গন্ডিতে।
এখানেই প্রশ্ন উঠে আসে—সমাজ কি সেই নিরাপদ গন্ডিকে মান্যতা দিতে প্রস্তুত? লোপামুদ্রার অভিজ্ঞতা বলছে, সমাজের ধারণা বদলালেও পুরনো মনোভাব এখনো বহু মানুষের মধ্যে বিদ্যমান।
মালবিকার বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি: সম্পর্ক কীভাবে শক্তি হয়ে ওঠে
মালবিকা মুখার্জির বক্তব্যে যে আত্মবিশ্বাসের সুর পাওয়া যায়, তা আজকের মেয়েদের উন্নত মানসিকতার পরিচায়ক। তাঁর কাছে বয়ফ্রেন্ড মানে শুধুই প্রেমিক নয়, বরং একজন সহপাঠী, একজন মেন্টর, একজন অনুপ্রেরণার উৎসও বটে।
তিনি বলেন, “বন্ধুর কাছে যেমন পাওয়া যায় মানসিক সমর্থন, তেমনি বয়ফ্রেন্ডের কাছ থেকেও পাওয়া যেতে পারে জ্ঞানের আদানপ্রদান, দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার।” মালবিকার যুক্তি অনস্বীকার্য—যদি একজন বয়ফ্রেন্ড জীবনকে নতুনভাবে ভাবতে শেখায়, তাহলে কেন নয়?
তবে এই আত্মবিশ্বাস যে সচেতনতার সঙ্গে আসে, তাও মালবিকা স্বীকার করেন। ফ্যাশনের নামে না ভেসে, চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া—এটাই তাঁর বার্তা।
স্বপ্নার সতর্কতা: সম্পর্ক মানেই ‘কেরিয়ার’ এর ছায়া নয়
স্বপ্না মিত্র বাস্তবের জমিতে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন তোলেন—বয়ফ্রেন্ড থাকলে সময় কোথায় কেরিয়ারের জন্য? এই বক্তব্যে উঠে আসে এক অন্য বাস্তবতা—সময় বণ্টনের দক্ষতা। তাঁর মতে, সম্পর্ক যদি সময়গ্রাসী হয়, তবে তা ক্ষতিকর।
এখানে আসল প্রশ্ন: একজন বয়ফ্রেন্ড কি সময় নষ্ট করেন, না কি সময়কে সৃজনশীলভাবে ব্যবহার করতে শেখান? উত্তরটা ব্যক্তি বিশেষের ওপর নির্ভর করে। স্বপ্নার বক্তব্য সতর্ক করে দেয়—সম্পর্ক মানেই হঠাৎ প্রাপ্তি নয়, বরং তার জন্য পরিকল্পনা ও পরিমিতি প্রয়োজন।
অনন্যার হতাশা: বিশ্বাসঘাতকতার অভিঘাত
অনন্যা মিত্রের অভিজ্ঞতা অন্য সুর তোলে এই আলোচনায়। তাঁর মতে, বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে সম্পর্ক অনেক সময় ফাঁকা আবেগের খেলা। বিশ্বাসের জায়গায় ঢুকে পড়ে স্বার্থপরতা। তাঁর অভিযোগ—বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই সম্পর্ক ‘টাইমপাস’ কিংবা ‘এন্টারটেইনমেন্ট’-এ সীমাবদ্ধ থাকে।
এই অভিজ্ঞতা আমাদের সচেতন করে—সব সম্পর্ক নয়ত সার্থক, নয়ত অনুকরণীয়। কিছু সম্পর্কের ছায়া নেতিবাচক। অনন্যা হয়তো তারই ভুক্তভোগী।
তবে এই বক্তব্যও একটি পক্ষের অভিজ্ঞতা। এতে অস্বীকার করা যায় না যে, কিছু সম্পর্ক সত্যিই ক্ষতিকর হতে পারে। কিন্তু তাতে ‘সম্পর্ক’ শব্দটির সার্বিক গ্রহণযোগ্যতা কি প্রশ্নের মুখে পড়ে? প্রশ্নটা রয়ে যায়।
সমাজ বনাম অভিভাবক: দ্বন্দ্ব চলছেই
সামাজিক রীতিনীতি আর অভিভাবক-প্রজন্মের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে আজও রয়েছে এক বিরাট ব্যবধান। মৌমিতা যেভাবে বলেন, অভিভাবকরা আজও ভয় পান মেয়েরা নির্জনে বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে মিশলে ‘বিপথে’ যাবে, তা আসলে একটা গভীর অনাস্থা ও অবিশ্বাসের প্রতিফলন।
সমাজ বদলালেও মানসিকতা কতটা বদলেছে? একজন মেয়ে যদি তার পছন্দের ছেলে বন্ধুর সঙ্গে কোনও সমস্যা ছাড়াই কাটাতে পারে, তাহলে তাতে সমাজ বা পরিবার কেন ভীত হয়ে পড়ে? এখানে আবার ফিরে আসি মূল প্রশ্নে—বিশ্বাস কাকে বলে?
শেষকথা: সম্পর্ক হোক স্বচ্ছ ও সচেতন
একটা সম্পর্ক তখনই কার্যকর হয়, যখন তার মধ্যে থাকে স্বচ্ছতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা, বিশ্বাস এবং লক্ষ্যভিত্তিক সহায়তা। বয়ফ্রেন্ড থাকতে পারে একজন নির্ভরযোগ্য বন্ধু, পথপ্রদর্শক বা প্রেরণা। আবার তিনিই হতে পারেন বিপথগামী এক সঙ্গী, যিনি আপনাকে টেনে নামাবেন।
সবটাই নির্ভর করে নির্বাচন ও প্রয়োগের ওপর। আর এই নির্বাচন যেন হয় চিন্তা-ভাবনা করে, আবেগের ঝড় নয়, বাস্তবের আলোয়। মেয়েরা আজ চায় নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নিতে। তাই তারা চায় এমন এক সমাজ, যেখানে সম্পর্ককে নেতিবাচক ছাঁদে না দেখে, ইতিবাচক সম্ভাবনার আলোয় দেখা হবে।
‘বয়ফ্রেন্ড’ শব্দটি যতটা বিতর্কিত, ততটাই প্রাসঙ্গিক আজকের সামাজিক বাস্তবতায়। মেয়েরা এখন নিজস্বতা ও স্বাধীনতার প্রতীক। তাই তারাও নিজেদের সম্পর্ক বেছে নেওয়ার অধিকার রাখে। তবে সেই সম্পর্ক যেন তাদের সামনে সম্ভাবনার দরজা খুলে দেয়, বাধা নয়।
সেই দিকেই তাকিয়ে আছে আধুনিক সমাজ। আর এটাই আজকের নারীচেতনার আসল বার্তা।